রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্ব নারী দিবস স্পেশাল

‘নারীর অবস্থান পরিবর্তনে পরিশ্রম করতে হবে’

‘নারীর অবস্থান পরিবর্তনে পরিশ্রম করতে হবে’

 

ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলদেশের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান এবং সহযোগী অধ্যাপক, ড. ফারজানা আলম। তিনি যুক্তরাজ্য থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করে বর্তমানে নারী উদ্যোক্তা উন্নয়ন বিষয়ে গবেষণা করছেন। এর পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তা উন্নয়নের মাধ্যমে সমজিক ও রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন ও প্রতিষ্ঠানের মানব সম্পদ উন্নয়ন তার গবষণার ক্ষেত্র। সম্প্রতি ডেইলি বাংলাদেশের সঙ্গে কথা বলেন এই গবেষক। কথপোকথনে স্বরলিপি।

ডেইলি বাংলাদেশ: কর্মক্ষেত্রে মেয়েকে মেয়ে হিসেবে ট্রিট করার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে? 

ড. ফারজানা আলম: অনেক সময় মেয়েরাও মেয়েদেরকে মেয়ে হিসেবে ক্লেইম করে। বিভিন্ন সুবিধা চায় যে, আমি মেয়ে আমাকে সন্ধ্যার আগে বাসায় যেতে হবে। বিভিন্ন অসুবিধার কথা বলে। আমার কাছে মনে হয় এটাও উচিত না। একই সঙ্গে সম অধিকার চাচ্ছি, সমান দক্ষতার কথা বলছি; সমানতালে প্রমোশন চাওয়ার কথাও বলছি। সবই ঠিক আছে কিন্তু বাসায় যাওয়ার আগে যদি বার বার সমস্যার কথা বলি’ তখন যদি কেউ মেয়ে হিসেবে ট্রিট করে আমার মনে হয়না এটা ম্যানেজমেন্টের দোষ। একটা মেয়ে যখন ডিসাইড করবে যে, সে কাজ করবে, ক্যারিয়ারকে উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যাবে; নিজের একটা পরিচয় গড়বে প্রথমেই নিজেকে মানুষ হিসেবে জানা উচিত। তখন সে কর্মক্ষেত্রে স্বাভাবিক আচরণ করবে, ছেলে সহকর্মীদের সঙ্গে স্বাভাবিক মানুষের মতো কথা বলবে; মেয়ে কলিগের সঙ্গে স্বাভাবিক কথা বলবে। যদি ছেলে কলিগের সঙেগ্ তার স্ত্রীকে নিয়ে কথা বলি, মেয়ে কলিগের সঙ্গে বাসার বুয়া সমস্যা নিয়ে কথা বলি- তাহলে কিন্তু আমি কেবলমাত্র মেয়ের আচরণ করছি। একটা কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন বয়সের, ভিন্ন জেন্ডারের মানুষের সঙ্গে কাজ করতে হয়; শুধু একটি মেয়ের, -এই মানসিকতা বজায় রেখে আমি আসলে কতদূর যেতে পারবো? নিজেকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করার এই দায়িত্বটুকু আমার। সমাজের অনেক নিয়ম নীতি আছে, কিছু জায়গায় যদি পরিবর্তন চাই; চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কখনই পরিবর্তনটুকু হয়ে যাবে না, তার জন্য পরিশ্রম করতে হবে। নিজেকে পরিবর্তন করার এই দায়িত্বটুকু নিজের। ‘লেভেল প্লেয়িংফিল্ড’ যেটাকে বলে, আগে আমি মানুষের জায়গায় এসে; তারপর আমি ক্লেইম করতে পারি। বলতে পারি, আমিতো মানুষের মতো কথা বলছি- আমাকে কেন মানুষ মনে করা হচ্ছে না! মাঝে-মধ্যে এমন সব মানুষ সম-অধিকার চায় যিনি নিজেই কিন্তু সুবিধা মতন নারী হয়ে যান। আমি কিন্তু এখানেও এই সমস্যাগুলো দেখি। একই মানুষ সুবিধামত অবলা নারী হয়ে যাচ্ছে আবার সমানাধিকার চাচ্ছে, তাকে কিন্তু সম্মান করা যায় না।
 
ডেইলি বাংলাদেশ: নেতৃত্বের জায়গা থেকে নারী-পুরুষের ক্ষেত্র্রে কেমন আচরণ করছেন বা পরামর্শ দিচ্ছেন?

ড. ফারজানা আলম: মানুষের মতো। যেন নারী হওয়ার জন্য বাড়তি কোন সুবিধাও দেয়া হয় না আবার নারী হওয়ার মতো কোনরকম বৈষম্যও করা হয় না। আমাদের ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ নারীবান্ধব প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সকলেই নিয়ম, বেতন, পরিবেশ নিয়ে কতটুকু সন্তুষ্ট এই বিষয়ে আমরা একটা সার্ভে করেছিলাম সেখানে নিজের নাম উল্লেখ না করে প্রত্যেকে মতামত দিয়েছেন। দেখা গেলো যে কিছু বিষয়ে কিছু পরিবর্তন চাইলেও প্রতিষ্ঠানের কর্ম-পরিবেশ এবং বৈষম্য নিয়ে কিছু পাওয়া যায়নি উপরন্তু এই বিষয়টি ছিল সর্বোচ্চ সন্তোষজনক অবস্থানের উপরের দিকে। এই সার্ভেতে টিচার্স থেকে শুরু করে আমাদের ইউনিভার্সিটির ক্লিনার্স পর্যন্ত সকলে অংশ নিয়েছিলেন। এছাড়াও আমি মনে করি একটা প্রতিষ্ঠানের সার্বিক কর্ম-পরিবেশ হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পর্যায়ের ব্যবস্থাপনার সাথে যারা জড়িত তাদের মানসিকতা এবং আচরণের প্রতিফলন। সেক্ষেত্রে আমাদের ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ একটি সফল প্রতিষ্ঠান যেখানে নারীদের জন্য একটি উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হচ্ছে।      

ডেইলি বাংলাদেশ: দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এসে ছেলে শিক্ষার্থীর থেকে মেয়ে শিক্ষার্থীর পরিমাণ কমে যায়। এক্ষেত্রে আপনার কী মতামত? 

ড. ফারজানা আলম: স্ট্রেস নেয়া বা ফাইট করার যে একটা স্কিল এটা একটা আলাদা স্কিল। এর চর্চা করতে হয়। এই স্কিলটা এখনও আমাদের মেয়েদের সকলের নেই। আবার এটা যার আছে সে অত্যন্ত প্রত্যন্ত একটা জায়গা থেকেও উঠে আসতে পারে।  এটা মেয়েদের দোষ না। আশেপাশের মানুষের কিছুটা হলেও এর দায় আছে, তারা খুব বেশি কো-অপারেট করে না। একটা স্টেজে এসে শুধু মেয়ে হওয়ার জন্য সে যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয় প্রবল ওই সময় তার কিছু সাপোর্ট দরকার হয় কিন্তু সে পায় না। এশিয়ান একজন নারী সাধারণত কী দেখে- মা সব কিছু মেনে নিচ্ছে। আবার, মা মেয়েকেও বলছেন মানিয়ে নিতে। তো চারদিক থেকে সহযোগিতা না পেয়ে একটা সময় সে আর এতো ঝামেলায় যেতে চায় না, স্যক্রিফাইস করে নেয়। আবার কেউ আছে স্যাক্রিফাইস না করে সংগ্রাম করে যায়।  যারা কিছুটা সাপোর্ট পায় আর যারা সংগ্রাম করে যায় তারা কিন্তু প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। আর যারা প্রতিষ্ঠিত হয় আমার মনে হয়না এটা তাদের একক ক্রেডিট। এটা একটা যৌথ প্রচেষ্টা। সমাজ, পরিবার, প্রিয়জন, বন্ধু-বান্ধব এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে। 

ডেইলি বাংলাদেশ: আপনার ক্ষেত্রে কী ঘটেছে? 

ড. ফারজানা আলম: পড়ালেখার বিষয়ে বা যে কোন বিষয় নির্ধারণে আমি একেবারে স্বাধীন। আমরা দুই ভাই বোন। আমার বাবা একজন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। উনার পক্ষ থেকে ছেলে মেয়ের সঙ্গে কখনও বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়নি। আমার পরিবার এবং বন্ধুমহলেও নারী-পুরুষ বৈষম্য বুঝতে পারিনি। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে ও গবেষণার কাজে জড়িত হয়ে  বুঝতে পারলাম বৈষম্য আছে।

ডেইলি বাংলাদেশ: নির্যাতন করার মানসিকতা কি চর্চার বিষয়?

ড. ফারজানা আলম: এখন জেলে যে ক্রিমিন্যালগুলো আছে, বিশেষ করে যারা রেইপসহ বিভিন্ন ভায়োলেন্সের সঙ্গে জড়িত এদের যদি ইনডেপথ ইন্টারভিউ নেন আপনি জানতে পারবেন ওরা ছোটবেলা থেকেই রুক্ষ প্রকৃতির ছিল। ওরা যখন যাকে দূর্বল পেয়েছে, তাকেই অ্যাটাক করেছে। সব থেকে ছোট বয়সে আশেপাশে দূর্বল পাওয়া যায় হলো- কুকুর, বিড়াল। দেখা গেল, হাতে গরম পানি আছে তাই সে কুকুর, বিড়ালের শরীরে ছুঁড়ে দিচ্ছে। কেন দিচ্ছে? কারণ, ও কুকুর বা বিড়ালের থেকে দূর্বল তার আশেপাশে আর কেউ নাই। তারপর সে পায় বয়সে ছোট আশে পাশের শিশুদেরকে। শিশুদেরকে তারা মারে। একটা বয়সে সে যখন বিয়ে করে নিজের পাশে দূর্বল হিসেবে পায় একজন নারীকে। তাকেও সে মারধর করে। হুট করেই কিন্তু হয় না। ধীরে ধীরে সেই হয়ে উঠে একজন নির্যাতনকারী- ধর্ষক এবং খুনী।   

ডেইলি বাংলাদেশ: নারী দিবস সম্পর্কে কী বলবেন? 

ড. ফারজানা আলম: এই দিবসটি এখন পর্যন্ত প্রাসঙ্গিক, নাহলে এতো গুরুত্বসহকারে পালন করা হবে কেন! নির্যাতনতো বন্ধ হয়ে যায়নি এখনও।

ডেইলি বাংলাদেশ: নারীর বর্তমান চিত্র নিয়ে কী বলার আছে?

ড. ফারজানা আলম: এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে নানা ঘাত-প্রতিঘাত আছে। সমাজের কঠিন বাস্তবতাকে মোকাবিলা করে নারীরা আজ ক্রমাগত অগ্রসর হচ্ছেন। নারীকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে সরকার আন্তরিক ভূমিকা পালন করছেন। এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকুক।

দৈনিক বগুড়া

সর্বশেষ: