রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

কৃষি উদ্যোক্তা জেসমিনের মাসে আয় ৫০ হাজার

কৃষি উদ্যোক্তা জেসমিনের মাসে আয় ৫০ হাজার

বিভিন্ন দেশে স্নাতকোত্তর চাওয়ালা, ফুচকাওয়ালা, ইঞ্জিনিয়ারের চায়ের দোকান ইত্যাদি চোখ ধাঁধানো সংবাদ ভাইরাল হয়। কখনো এমবিএ গুড় বা পাটালি বিক্রেতার কথা শুনেছেন? তা-ও আবার নারী! করোনা মহামারিতে সবেচেয়ে চাঙা ছিল কৃষিখাত। সবকিছু থেমে গেলেও থামেনি কৃষি উৎপাদন। এ অবসরকে কাজে লাগিয়ে কিছু মানুষ তাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে নিয়েছেন। কেউ বা হয়েছেন ব্যর্থ; তবুও কৃষিতে এসেছে আমূল পরিবর্তন।

যশোর সদরের কারবালা সিঅ্যান্ডবি রোড এলাকার মেয়ে জেসমিন রোজ। কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যানেজমেন্টে এমবিএ শেষ করে হয়েছেন উদ্যোক্তা। খেজুর গুড়, পাটালি, সরিষার তেল ও খাঁটি মধু বিক্রি করে তিনি প্রতি মাসে ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা আয় করছেন।

উদ্যোক্তা জেসমিন রোজ বলেন, ‘এমবিএ শেষ করে সরকারি চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। স্বপ্ন দেখতাম চাকরি করবো। বাবা-মা চাইতেন মেয়ে বড় চাকরি করবে। সব সময় মনে হতো, কবে একটা চাকরি পাবো। বাবা-মাকে খুশি করবো। চাকরির খুব প্রয়োজন ছিল।কেননা পড়াশোনা শেষ করার পর বাবা-মায়ের কাছে টাকা চাইতে খারাপ লাগতো। বিভিন্ন জায়গায় পরীক্ষা দিতে দিতে হঠাৎ একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি হয়ে যায়। ২০১৯ সালের নভেম্বরে জয়েন করি। ২০২০ সালের মার্চ মাসে এসে অফিস বন্ধ হয়ে যায়। তারপর থেকে আবার হতাশা কাজ করে। আবার সেই বেকার হয়ে গেলাম। সারাদিন ফেসবুকে সময় কাটাই। পড়াশোনায়ও মন বসে না। ঠিক তখন ‘নিজের বলার মতো একটা গল্প ফাউন্ডেশন’র প্রতিষ্ঠাতা ইকবাল বাহার জাহিদ স্যারের একটি কথা আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। স্বপ্ন দেখুন, সাহস করুন, লেগে থাকুন, সফলতা আসবেই।’

তিনি বলেন, ‘আমি ফেসবুকে একটা ফেক আইডি খুলি। যাতে আমার বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন না থাকে। তারা যেন না জানেন যে, আমি শিক্ষিত হয়ে এখন কাপড়, ঘি, মধু, তেল বিক্রি করি। আমি নিজেও কাউকে বলতাম না যে, আমি অনলাইনে বিজনেস করি। আমার মা অনেক অপছন্দ করতেন। আমি মাকে বোঝাতে থাকি। জাহিদ স্যারের ভিডিও দেখাতে থাকি। বোঝাতে থাকি, এখানে বেশিরভাগ মানুষ চাকরির পাশাপাশি বিজনেস করেন। ফাউন্ডেশনের বিভিন্ন প্রোগ্রামে মাকে নিয়ে যেতে থাকি। অনেক ভাই-বোনের সঙ্গে পরিচয় হয়। বিষয়গুলো মায়ের অনেক ভালো লাগে।’

জেসমিন বলেন, ‘তারপর নিজ জেলার বিখ্যাত পণ্য খুঁজতে থাকি। ঠিক করি যশোরের ঐতিহ্যবাহী পণ্য নিয়েই কাজ করবো। তখন শীতকাল। যশোরের ঐতিহ্যবাহী খেজুর গুড় পাটালি নিয়ে কাজ শুরু করি। কিন্তু সেটা গোপনে। কারণ পরিবার থেকে কখনোই সমর্থন করবে না। প্রথমে সমর্থন করেনি। আমি যখন পাটালি নিয়ে কাজ শুরু করি, আমার মা হাত থেকে নিয়ে ফেলে দেন। বলেন, ‘এত পড়াশোনা করে পাটালি বেচবো?’ অনেক পরিশ্রম করেছি একা একা। খেজুরের গুড় নিয়ে কাজ করাতে অনেক সাড়া পেয়েছি। পাটালি ছিল আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট।’

কাকডাকা ভোরে স্কুটি চালিয়ে সরাসরি প্রত্যন্ত এলাকা থেকে চাষির মাধ্যমে খেজুর রস সংগ্রহ করে গুড় ও পাটালি বানানোর সব প্রক্রিয়া মুঠোফোনে ধারণ করে ফেসবুক আইডি ও বিভিন্ন গ্রুপে শেয়ার করতেন বলে জানান জেসমিন রোজ। সেখান থেকে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে ক্রেতা। একসময় অবস্থা এমন হয় যে, ক্রেতার চাপ সামলাতে পারতেন না। একবার যেখানে পণ্য যেত, সেখান থেকে বার বার অর্ডার আসতো।

তিনি বলেন, ‘খাঁটি পণ্যের নিশ্চয়তা, নিজে তদারকি করতে পারি এবং পণ্যের শতভাগ মান নিয়ন্ত্রণ হয়। অন্যদিকে প্রান্তিক কৃষক লাভবান হন। কিছুটা বেশি দামে পণ্য বিক্রি করতে পারেন। কৃষিপণ্য নিয়ে কাজ করলে মনে হয় প্রকৃতির সাথে মিশে আছি। প্রকৃতি ও পরিবেশের সাথে ভালো লাগা, ভালোবাসা কাজ করে।’

তিনি উদ্যোক্তা হিসেবেই পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। এখন বাবা-মা তার সফলতা দেখে প্রচণ্ড সাপোর্ট করেন। অনেক রাগ-অভিমান ছিল। অনেক অনেক ইগো ছিল। সেসব আর কিছুই নেই তার মধ্যে। নিজের বলার মতো একটি গল্প তাকে শিখিয়েছে কীভাবে ভালো মানুষ হওয়া যায়। বাবা-মাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে। সব সময় পজিটিভ থাকতে শিখিয়েছে। মানুষের জন্য কাজ করলে নিজের খাদ্যের অভাব হয় না। এছাড়া আরও বিভিন্ন স্কিল যেগুলো উদ্যোক্তা এবং কর্পোরেট দৈনন্দিন জীবনে সহায়তা করেছে। যা তার জন্য খুবই প্রয়োজন ছিল।

জেসমিন রোজ বলেন, ‘উদ্যোক্তাদের মাসিক আয় বলা মুশকিল। প্রথম যখন গুড়, পাটালি, মধু, ঘি ও সরিষার তেল বিক্রি শুরু করেছিলাম; তখন প্রথম মাসে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত সেল করেছি। এখন নতুন কিছু গার্মেন্টস প্রোডাক্ট যুক্ত করেছি। সব মিলিয়ে এখন মাসে ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়।’

বর্তমানে দেশের মোট জিডিপির ১০ শতাংশ আসে নারী উদ্যোক্তাদের হাত ধরে। পরিসংখ্যান বলছে, নারী উদ্যোক্তাদের উন্নয়নে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও দক্ষতা উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণ জোরদার, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক নারীদের উন্নয়নে বিশেষ প্রকল্প প্রণয়ন, সল্প সুদে ঋণ ব্যবস্থা চালু করাসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ পরিচালনা করতে পারলে সমাজের অবহেলিত নারীরা মোট জিডিপির ১২-১৫ শতাংশে উন্নীত করতে ভূমিকা রাখবে।

দৈনিক বগুড়া