বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বগুড়ায় প্রতিদিন বিক্রি হয় ৩০ লাখ টাকার দই

বগুড়ায় প্রতিদিন বিক্রি হয় ৩০ লাখ টাকার দই

বগুড়াকে দইয়ের শহর বলা হয়। এখানকার দইয়ের খ্যাতি দেশজুড়ে। শুধু দইকে কেন্দ্র করেই এ জেলা পেয়েছে ভিন্ন পরিচিতি। স্বাদে অতুলনীয় হওয়ায় বগুড়ার দইয়ের জনপ্রিয়তা যুগ যুগ ধরে অটুট রয়েছে। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রি হচ্ছে বগুড়ার দই। দেশে-বিদেশে বগুড়ার দইয়ের বিশাল বাজার তৈরির সম্ভাবনা থাকলেও শুধু সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তা সম্ভব হচ্ছে না। অথচ বগুড়া জেলায় প্রতিদিন প্রায় ৩০ লাখ টাকার দই বিক্রি হয়। একটি পণ্য প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা বিক্রি হলেও আজ অবধি ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) স্বীকৃতি পায়নি।

বগুড়ার প্রবীণরা জানান, দইয়ের শুরুটা হয়েছিল জেলা শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দক্ষিণে শেরপুর উপজেলায়। কথিত আছে, ষাটের দশকে গৌর গোপাল পাল নামের এক ব্যবসায়ী প্রথম পরীক্ষামূলক দই তৈরি করেন। তখন দই সম্পর্কে সবার ভালো ধারণা ছিল না। গৌর গোপালের এ দই-ই ধীরে ধীরে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী নবাব পরিবার ও সাতানী পরিবারের কাছে এ দই সরবরাহ করতেন গৌর গোপাল। সে সময়ে এ দইয়ের নাম ছিল নবাববাড়ীর দই। নবাবী আমলে বিশেষ খাবার ছিল দই। এখনো বিশেষ খাবার হিসেবে দইয়ের জনপ্রিয়তা রয়েছে। বিয়ে, জন্মদিন, ঈদ, পূজা, আকিকা, হালখাতা বা পারিবারিক ও সামাজিক যেকোনো অনুষ্ঠানে দই বিশেষ খাবার হিসেবে পরিবেশিত হয়ে থাকে। তাছাড়া প্রতিদিনই দই বিক্রি হয়।

স্বাধীনতার পর বগুড়ায় দই তৈরিতে শহরের গৌর গোপালের পাশাপাশি মহরম আলী ও বাঘোপাড়ার রফাত আলীর নাম ছড়িয়ে পড়ে। সে সময় ছোট ছোট মাটির পাত্রে (স্থানীয় ভাষায় হাঁড়ি) দই ভরানো হতো। ঘোষদের ছোট ছোট দোকান থাকলেও তখন ফেরি করেই দই বিক্রি হতো।

দই তৈরির কারিগরদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দই তৈরির রহস্য এক ধরনের দক্ষতা। দক্ষতা ছাড়া ভালো মানের দই তৈরি করা যায় না। দই তৈরির মূল উপকরণ ভালো মানের দুধ। যত ভালো মানের দুধ হবে দই তত স্বাদের হবে। দই তৈরির কাজে দক্ষ কারিগর না হলে উপকরণ নষ্ট হয়ে যায়।

দই ব্যবসায়ীরা জানান, বগুড়ায় তৈরি দই দেশের বাইরেও নিয়ে যাওয়া হয়। স্থানীয়ভাবে তারা যে প্যাকেটে দই দেন তা শীতকালে থাকে চার-পাঁচদিন। আর গরমকালে থাকে দুই-তিনদিন। উত্তরাঞ্চলে দেশী-বিদেশী পর্যটক বেড়াতে এলে তারা ফেরার সময় দই কিনে নিয়ে যান। হাতে হাতে করেই এ দই পৌঁছে যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। অনেকে ব্যক্তি উদ্যোগে বগুড়ার দই বিদেশে নিয়ে যায়। কিন্তু সরকারি সহযোগিতা নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে দই রফতানি হচ্ছে না।

বর্তমানে বগুড়া শহরের এশিয়া সুইটমিট ও এনাম দই ঘর, নবাববাড়ীর রুচিতা, কবি নজরুল ইসলাম সড়কের আকবরিয়া দই, বিআরটিসি মার্কেটের দই বাজার, মিষ্টিমহল, সাতমাথা দই ঘর, মহরম আলী, শেরপুর দই ঘর, চিনিপাতাসহ অর্ধশতাধিক শোরুমে দই বিক্রি হচ্ছে। আবার শহরের বাইরে বাঘোপাড়ার রফাত দইঘর, শেরপুরের রিপন দধি ভাণ্ডার, সাউদিয়া, জলযোগ, শম্পা, বৈকালী ও শুভ দধি ভাণ্ডার থেকে প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণে দই বিক্রি হয়। বগুড়া শহরের ঠনঠনিয়া ঢাকাগামী বাসস্ট্যান্ডে রয়েছে সাতটি ভিন্ন নামের দইয়ের শোরুম।

গৌর গোপাল ও মহরম আলীর পর বগুড়ার দইঘরের মালিক আহসানুল কবির দই তৈরি ও বাজারজাতে নতুনত্ব নিয়ে আসেন। তিনি ছোট ছোট পাতিলে দই পাতা শুরু করেন। সেই সঙ্গে প্যাকেজিং ও দই সংরক্ষণেও আনেন নতুনত্ব। সুসজ্জিত শোরুম করে দই বিক্রির প্রচলন করেন তিনি। সেটাও ১৯৯০-এর দিকে। তাদের দই দেশের বাইরেও নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। হাতে হাতে করেই এ দই পৌঁছে যায় বিভিন্ন জেলায়।

বগুড়ার দই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিভিন্ন ব্র্যান্ডের দই পাওয়া যায়। যার প্রতি পাতিল বিক্রি হয় আকার অনুযায়ী ৩৫-২৮০ টাকায়। ছোটবড় বিভিন্ন আকৃতির মাটির পাত্রে দই পাতা হয়। আগে কেজি হিসেবে দই বিক্রি হলেও এখন উপকরণের মূল্য বৃদ্ধির কারণে দই বিক্রি হয় পিস হিসাবে। তবে এতে দইয়ের ওজনে তারতম্য দেখা দিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বগুড়া শহরের চিনিপাতা দই দোকানে মেজবান দই ২৮০ টাকা, স্পেশাল দই ২৬০, সাদা দই ২৪০, টকদই বড় পাতিল ১৮০ ও ছোট পাতিল ১০০, কাপ দই ৬৫, ক্ষীরসা সরা ৫২০ টাকা করে প্রতি পিস বিক্রি হয়। প্রায় একই দামে বগুড়ার সব দোকানে দই বিক্রি হয়।

বগুড়া শহর ও শেরপুর উপজেলায় রয়েছে শতাধিক দোকান। আর জেলার ১২টি উপজেলা মিলিয়ে আনুমানিক ৩০০টি দোকান রয়েছে। ৩০০ দোকানে প্রতিদিন গড়ে ৫০টি করে দই বিক্রি ধরা হলে পিসের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫ হাজার। প্রতি পিস দই ২০০ টাকা হিসাবে টাকার অংক গিয়ে দাঁড়ায় ৩০ লাখ।

বগুড়ার ঝাউতলার এনাম দই ঘরের মালিক এনামুল কবির জানান, দইয়ের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। দই বগুড়া থেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ বিভিন্ন জেলায় চলে যায়। বাসে করে দই পরিবহন হয়ে থাকে। বিভিন্ন জেলা থেকে দই নিতে অর্ডার দিয়ে থাকেন ব্যবসায়ীরা। প্রতিযোগিতার এ বাজারে দইয়ের মান ধরে রাখা কঠিন। বাজারে নিম্নমানের দইয়ের ভিড়ে বেশি দামে ক্রেতাদের কাছে বিক্রি নিয়ে হয় ঝুট-ঝামেলা। আবার দাম কমিয়ে দইয়ের গুণগত মান ঠিক রাখাও যায় না। বর্তমান বাজারে দইয়ের দাম বেড়েছে। ভালো মানের দই নিতে গেলে ২৫০-২৮০ টাকা দাম পড়বে। এছাড়া বাজারে আরো কিছু দই আছে সেগুলো ১৮০-২২০ টাকার মধ্যে পাওয়া যায়।

আকবরিয়া লিমিটেডের চেয়ারম্যান হাসান আলী আলাল জানান, দই তৈরির সব উপকরণের দাম বেড়েছে। বাজারে রয়েছে প্রতিযোগিতা। বাজারে টিকে থাকতে ভালো মানের দই তৈরি করা হচ্ছে। বিভিন্ন জেলায় তাদের তৈরি দইয়ের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।

দৈনিক বগুড়া