বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বগুড়ায় ৫০ গজের মধ্যে মসজিদ-মন্দির, সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত

বগুড়ায় ৫০ গজের মধ্যে মসজিদ-মন্দির, সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত

একপাশে মন্দিরের উপাসনা, অপর পাশে মসজিদে ইবাদত বন্দেগি। এক পাশে উলুধ্বনি, অন্য পাশে চলছে আজান ও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ। এক পাশে ছড়াচ্ছে ধূপকাঠি, অন্য পাশে আতরের সুঘ্রাণ। মাত্র ৫০ গজের মধ্যে এমন চিত্র দেখা মিলে বগুড়ার আদমদীঘির সান্তাহার পৌর শহরের কলসা রথবাড়ী মহল্লায়।

একটি কলসা হক্কানী জামে মসজিদ এবং অপরটি সার্বজনীন রাধা মধাব মন্দির। প্রায় ৭০ বছর ধরে সহাবস্থানে রয়েছে এই মন্দির ও মসজিদ। শারদীয় দুর্গোৎসবের দশমির দিন বুধবার দুপরে উপজেলার কলসা রথবাড়ি এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, জোহরের আজানের সময় থেকে নামাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত মন্দিরের মাইক, ঢাক-ঢোলসহ যাবতীয় শব্দ বন্ধ রেখেছেন মন্দির কর্তৃপক্ষ। 

নামাজের জামাত শেষ হলে মন্দিরের পূজার্চনার কার্যক্রম শুরু হয়। এভাবে শৃঙ্খলা বজায় রেখে মাত্র ৫০ গজের মধ্যেই যুগের পর যুগ ধরে ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করে আসছে উভয় ধর্মের লোকজন। 

কলসা হক্কানী জামে মসজিদ এবং শ্রী শ্রী রাধা মাধব জিউ সার্বজনীন মন্দির পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। দুটি স্থাপনার মাঝখানে রয়েছে শুধু চলাচলের একটি মাত্র রাস্তা। এ যেন ধর্মীয় সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯১১ সালে সার্বজনীন রাধা মধাব মন্দির প্রতিষ্ঠার আগে এখানে শ্রী শ্রী জগন্নাথ জিউ ঠাকুরের মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়। একারনে এই এলাকার নামকরন করা হয়েছিল ‘রথবাড়ী’। 

পরবর্তীতে পিতলের রথটি রক্ষনাবেক্ষনের অভাবে নওগাঁ কালীমন্দিরে হস্তান্তর করা হয়। তবে বর্তমানে রথবাড়ীর এই সার্বজনীন রাধা মাধব মন্দিরে দূর্গাপূজা ছাড়াও লক্ষিপূজা, সরস্বতী পূজা ও নিত্যপূজাসহ প্রায় সব ধরনের পূজার্”না অনুষ্ঠিত হয়। তাছড়া মন্দিরের মূল ফটকের পাশে একটি শিব মন্দিরও রয়েছে। 
প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায় স্বাভাবিক নিয়মে চলছে এসব দেবদেবীর পূজার্চনা। প্রতি বছর জাঁকজমক পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয় শারদীয় দুর্গোৎসব।

পরবর্তীতে ১৯৫৩ সালে কলসা মহল্লাবাসীর নামাজের জন্য মন্দিরের পাশেই নির্মিত হয় ‘কলসা হক্কানী জামে মসজিদ’। পরে মসজিদটি দু’দফায় ভেঙে পুন নির্মাণ কাজ করা হয়। সর্বশেষ ২০১৭ সালে দ্বিতল ভবন নির্মাণের মধ্যদিয়ে দৃষ্টিনন্দন করে গড়ে তোলা হয়েছে। মন্দিরের মাত্র ৫০ গজ দূরত্ব হলেও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতে এই মসজিদে প্রায় সব সময়ই মুসলিমদের ভিড় থাকে।

রথবাড়ীর শ্রী শ্রী রাধা মাধব জিউ সার্বজনীন মন্দির কমিটির সাধারন সম্পাদক প্রদীপ প্রমানিক জয় বলেন, মন্দিরে নিয়মিত পূজার্চনা হয়। মসজিদ কমিটির দেয়া তথ্যমতে আজান ও নামাজের সময় বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার বন্ধ রাখা হয়। ধর্মীয় সম্প্রীতির বিঘ্ন ঘটে এমন অবস্থার মধ্যে আমাদের কোনো দিনই পড়তে হয়নি বরং স্থানীয় মুসল্লিদের সহযোগিতা পেয়ে আসছি। একারনে উভয় ধর্মের বাসিন্দারা এটা নিয়ে গর্ব করেন।

কলসা হক্কানী জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন মো. নজরুল ইসলাম জানান, ‘মন্দিরটি মসজিদের আগে প্রতিষ্ঠিত হলেও এখানে জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সব শ্রেণির মানুষ স্বাধীনভাবে যে যার ধর্ম পালন করে আসছে। আমরা নামাজের সময়সূচী তাদের দিয়েছি, সেনুযায়ী তারা ঢাকঢোল বাজায়। ফলে আমাদের উভয় সম্প্রদায়ের মাঝে ধর্মীয় আচার-বিধি পালন করা নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব নেই।’

সান্তাহার পুলিশ ফাঁড়ির পরির্দশক আব্দুল কাদের জিলানী জানান, কানো বিশৃঙ্খলা ছাড়াই যুগ যুগ ধরে চলছে এ সম্প্রীতির বন্ধন। আমরা প্রশাসনের তরফ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করে আসছি, যাতে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি না হয়।

দূর্গোৎসব উপলক্ষে মন্দির পরিদর্শনে এসে বগুড়া পুলিশ সুপার (এসপি) সুদীপ কুমার চক্রবর্তী বলেন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রতির অনন্য নিদর্শন সান্তাহার। যেখানে পাশাপাশি মন্দির ও মসজিদ। অথচ কখনো কোনো ধরনের গোলোযোগের সৃষ্টি হয়নি। তাতে বোঝা যায় এখানকার সকল মানুষই নিজ নিজ ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। 

দৈনিক বগুড়া