শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

হাদিস পাঠের মূলনীতি

হাদিস পাঠের মূলনীতি

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাদিস অধ্যয়ন ও গবেষণার ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম যে বিষয়ের প্রতি গুরুত্বারোপ করা দরকার, তা হচ্ছে নিয়তের পরিশুদ্ধকরণ। হাদিসের গ্রন্থগুলো আরম্ভ করতে হবে একনিষ্ঠতা ও আল্লাহর কাছে সওয়াবের প্রত্যাশায়। অনেক সময় মানুষ অন্যের সমালোচনা থেকে বাঁচার জন্যও ইবাদত করে থাকে। আবার লোক-দেখানোই ইবাদতের মুখ্য উদ্দেশ্য হয়ে যায় অনেক সময়। তাই দ্বিনি অত্যাবশ্যকীয় বিষয়গুলো অথবা শারীরিক ইবাদতগুলোর সঙ্গে একমাত্র সওয়াবের নিয়ত এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য অর্জনের ভাবনাকে তাজা করার শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে।

আমরা দেখি, রাসুলুল্লাহ (সা.) এ প্রসঙ্গে এমন একটি উক্তি করেছেন, যা একজন আল্লাহর প্রত্যাদিষ্ট নবীর পক্ষেই সম্ভব; যিনি মানুষের স্বভাবজাত দুর্বলতার দিক সম্পর্কে অবগত এবং জানেন মানুষের মনে নানা ধরনের কুপ্রবৃত্তি ও শয়তানের প্ররোচনা সৃষ্টির সমূহ পথ রয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে সওয়াবের প্রত্যাশায় রমজানের রোজা রাখবে, তার আগের যাবতীয় পাপ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।’ (সহিহ বুখারি)

অতএব, যেখানে রমজানের রোজা রাখার ক্ষেত্রে মানুষের ব্যাপারে আশঙ্কা করা হয়েছে—অথচ এসব ইবাদতের মধ্যে কষ্ট আছে, সাধনা আছে এবং এসব শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য অর্জনের জন্যই প্রবর্তিত। লোক-দেখানোর সুযোগ কমই থাকে, সেখানে অন্যান্য কাজ ও কর্মব্যস্ততার কথা বলাই বাহুল্য। তাই হাদিস অধ্যয়ন ও গবেষণার ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ত পরিশুদ্ধ করতে হবে।

পাশাপাশি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নত দ্বারা ব্যক্তিগত ও সামাজিকভাবে উপকৃত হয়ে তার প্রচার-প্রসার এবং তার আলোকে সমাজ পরিচালনার দৃঢ় সংকল্প করতে হবে। মহানবী (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ সে ব্যক্তির চেহারা তরতাজা করুক, যে আমার কাছ থেকে কোনো বাণী শুনেছে, অতঃপর তা যেমন শুনেছে হুবহু অন্যের কাছে পৌঁছিয়েছে। বহু ব্যক্তি, যাদের কাছে হাদিস পৌঁছানো হয়েছে, তারা মূল শ্রোতা থেকে বেশি সংরক্ষণকারী ও অনুধাবনকারী হয়ে থাকে। (সুনানে তিরমিজি)

ইমাম বুখারি (রহ.) অত্যন্ত প্রাজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন। তিনি তাঁর বিশুদ্ধ হাদিসগ্রন্থ সহিহ বুখারির সূচনা করেছেন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নিম্নোক্ত হাদিস দিয়ে। তিনি বলেন, ‘সমস্ত কাজ নিয়তের ওপর নির্ভরশীল।’ প্রজ্ঞাপূর্ণ এই শুভ সূচনার মাধ্যমে ইমাম বুখারি (রহ.) দুটি উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করেছেন। এক. তিনি যে বিশুদ্ধ হাদিসগুলো একত্র করেছেন, তা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি ও সওয়াবের আশায় করেছেন। দুই. হাদিসের পাঠকদের নিয়তকে আল্লাহর সন্তুষ্টির নিমিত্ত বিশুদ্ধ করাও উদ্দেশ্য।

হাদিস পাঠের সময় পাঠকের উচিত হাদিসের প্রতি যথাযথ সম্মান ও শিষ্টাচার প্রদর্শন করা। আল্লাহ যে হাদিস পড়ার তাওফিক দিয়েছেন, এই সৌভাগ্যের জন্য তাঁর বিনীত শুকরিয়াও আদায় করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিখ্যাত হাদিসবিশারদদের, যাঁরা হাদিসের পাঠগ্রহণ ও পাঠদানকে সৌভাগ্যের মনে করতেন, তাঁদের বহু ঘটনা দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। তাঁরা দরসে যাওয়ার আগে ভালোভাবে অজু করতেন, যথাযথ শিষ্টাচার বজায় রাখতেন এবং দরস চলাকালে শ্রদ্ধাবনত হয়ে নীরব থাকতেন। অন্যদিকে এমন বহু ঘটনাও আছে যে হাদিসের সঙ্গে বেয়াদবিমূলক আচরণ করায় ব্যক্তি আল্লাহর শাস্তির মুখোমুখি হয়েছে, ঈমানহারা হয়ে গেছে। আল্লাহ তাআলা সব মুসলমানকে, বিশেষত দ্বিনি শিক্ষার্থীদের এমন অশুভ পরিণাম থেকে রক্ষা করুন। আমিন।

রাসুলুল্লাহ (সা.) ছিলেন উন্নত চরিত্রাবলির সর্বোত্তম নমুনা ও আদর্শ। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আপনি উত্তম চরিত্রের ওপর অধিষ্ঠিত আছেন।’ (সুরা আল-কলম, আয়াত : ৪)

অতএব, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নত ও হাদিসের গ্রন্থাবলি থেকে এ বিষয়ে পূর্ণমাত্রায় উপকৃত হওয়ার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। হাদিস পড়ে আত্মশুদ্ধি, চরিত্র সংশোধন ও সুন্নতে নববীর অনুকরণের চেষ্টা করতে হবে।

দীর্ঘকাল থেকে প্রচলিত ফিকহি মাজহাবের ওপর আক্রমণ করা থেকে যথাসম্ভব বেঁচে থাকতে হবে। বিশেষ করে যেসব ইমাম একান্ত ইখলাস ও নিষ্ঠার সঙ্গে পবিত্র কোরআন ও হাদিসের আলোকে বিভিন্ন ফিকহি মাসআলা বের করে উম্মাহর আমলের সুবিধার্থে পেশ করেছেন। ফিকহি গবেষণা করার সময় সর্বাগ্রে কোরআন-হাদিসকেই মূল উৎস হিসেবে গ্রহণ করেছেন। যাঁদের আল্লাহ গ্রহণযোগ্যতা দান করেছেন, তাঁদের প্রতি কটাক্ষ আচরণ ও নির্দয়তা পরিহার করতে হবে। মাজহাব নিয়ে অযথা ঘাঁটাঘাঁটি এবং এ নিয়ে সময় ব্যয় ও মেহনত করা উভয়ই অপচয়ের শামিল। এ ধরনের পরিশ্রমকে অপাত্রে জিহাদ এবং প্রকৃত দুশমন নয় এমন লোকের বিরুদ্ধে সংগ্রাম হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

ভাষান্তর : মুহাম্মদ সাদিক হুসাইন

দৈনিক বগুড়া