বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আজানের সময় করণীয় ও বর্জনীয়

আজানের সময় করণীয় ও বর্জনীয়

পৃথিবীর সবচেয়ে সুমধুর ধ্বনির নাম হলো আজান। এটি মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে কোটি মানুষের উপলব্ধি। ইন্টারনেটে অজস্র ভিডিও রয়েছে যেখানে দেখা যায়, একজন অমুসলিম আজানের বাণী শুনে সম্মোহিত হয়ে পড়েন। তা হবে না কেন? এ আজান যে সৃষ্টির প্রতি মহান সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তার আহ্বান।

একজন মানুষকে যখন তার মহান মালিকের প্রতি আহ্বান করা হয়, তার উপলব্ধি তখন কেমন হতে পারে? তাই আজানের আওয়াজ শুধু মুসলমানের অন্তরেই নাড়া দেয় না, বরং তা অমুসলিমের অন্তরকেও আকর্ষণ করে। যুগে যুগে যার অজস্র উদাহরণ রয়েছে। হ্যাঁ! হিংসুক ও নিন্দুকের কথা ভিন্ন। আল্লাহর ভাষায়, যার অন্তরে আল্লাহ মোহর মেরে দেন, সে ইসলামের আলো থেকে বঞ্চিত হবেই।

তাই ইসলামে আজানের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। আজান শুনে আজানের জবাব দেয়ারও রয়েছে বিশেষ গুরুত্ব। আজান শ্রবণকারীরও মৌখিকভাবে আজানের উত্তর দেয়া সুন্নত। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যখন তোমরা আজান শুনবে, এর জবাবে মুয়াজ্জিনের অনুরূপ তোমরাও বলবে।’ (বুখারী হাদিস : ৬১১)।

আজানের সময় যে কাজগুলো অবশ্যই করবেন আর যে কাজগুলো একেবারেই করবেন না-

আজানের জবাব দেয়ার পদ্ধতি :

আজানের জবাব দেয়ার পদ্ধতি হলা, মুয়াজ্জিন প্রত্যেকটি বাক্য বলে থামার পর শ্রোতা ওই বাক্যটি নিজেও অনুরূপভাবে বলবে। তবে মুয়াজ্জিন ‘হাইয়্যা আলাস সালাহ’ ও ‘হাইয়্যা আলাল ফালাহ’ বলার সময় শ্রোতা ‘লা হাওলা ওয়া লা কুউওয়াতা ইল্লাবিল্লাহ’ বলবে। এটাই বিশুদ্ধ অভিমত। (সহিহ মুসলিম হাদিস : ৩৮৫)।

তবে কোনা কোনা বর্ণনায় ‘হাইয়্যা আলাস সালাহ’ ও ‘হাইয়্যা আলাল ফালাহ’ বলার সময়ও মুয়াজ্জিনের অনুরূপ বলার অনুমতি দেয়া হয়েছে। (কিতাবুদ দোয়া, তাবারানি হাদিস : ৪৫৮)।

আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউমের জবাব :

ইসলামি ফিকাহের বিভিন্ন কিতাবের বর্ণনামতে, ফজরের আজানে ‘আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম’ এর জবাবে ‘সাদাকতা ও বারারতা পড়বে। আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম শব্দের অর্থ হলো ‘ঘুম থেকে নামাজ উত্তম।’ তবে হাদিস ও সুন্নাহে এর কোনা প্রমাণ পাওয়া যায় না। তাই বিশুদ্ধ মতানুসারে এর জবাবেও মুয়াজ্জিনের অনুরূপ ‘আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম’ বলাই উত্তম। কেননা হাদিস শরিফে এসেছে, আজানের জবাবে তোমরাও মুয়াজ্জিনের অনুরূপ বলবে। (তাকরিরাতে রাফেয়ি : ১/ ৪৭ আহসানুল ফাতাওয়া : ১০/২০৬)।

প্রচলিত কিছু ভুল :

কেউ কেউ আজানে ‘আল্লাহু আকবার’ এর জবাবে ‘জাল্লা জালালুহু’ পড়ে থাকে। এটি সুন্নাহপরিপন্থী। (ইমদাদুল আহকাম : ১ / ৪১৬)।

অনেকেই আজানের সময় জবাব দিতে গিয়ে ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ’ এর জবাবে ‘সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ বলে থাকে। এটিও বলা উচিত নয়। কেননা এ সময় দরুদ পড়ার নির্দেশ নেই। বরং তখনও মুয়াজ্জিনের অনুরূপ ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ’ বলাই সুন্নত। আলবাহরুর রায়েক : ১/২৭৩, আহসানুল ফাতাওয়া : ২/২৭৮ )। এই দরুদ পাঠ করবে আজান শেষ হওয়ার পর।

আমাদের দেশে আজানে ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ’ বলার সময় অনেকেই বৃদ্ধাঙ্গুলে চুমু খেয়ে চোখে মুছে থাকে। কেউ কেউ আবার সঙ্গে ‘কুররাত আইনি’ এ দোয়াও পড়ে থাকে। অথচ ইসলামি শরীয়তে এর কোনা প্রমাণ নেই। সুতরাং এটি বর্জনীয়। (আল মাকাসিদুল হাসানা, পৃষ্ঠা : ৬০৬, ইমদাদুল ফাতাওয়া : ৫/ ২৫৯)। 

প্রসিদ্ধ আছে, আজানের জবাব না দিলে বা আজানের সময় কথা বললে বেঈমান হয়ে যায় কিংবা বেঈমান অবস্থায় মারা যাওয়ার ভয় আছে এরপ কোনা বর্ণনা হাদিসের কিতাবে নেই। সুতরাং এটি ভ্রান্ত বিশ্বাস। তবে আজানের সময় চুপ থাকতে হবে।(ফাতাওয়া মাহমুদিয়া : ৫/ ৪৩০)।

যারা আজানের জবাব দেবে না :

নামাজ আদায়কারী, পানাহার অবস্থায়, ইস্তিনজাকারী, নারীদের ঋতুকালীন ইত্যাদি সময়। তবে অনেক আলেমের মতে, আজানের পরক্ষণেই যদি উল্লিখিত কাজ থেকে অবসর হয়, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে আজানের জবাব দিয়ে দেয়া উত্তম। কোরআন তেলাওয়াতকারী তেলাওয়াত সাময়িক বন্ধ রেখে আজানের জবাব দেয়া উত্তম। ( আন্দুররুল মুখতার : ১/৩৯৭)।

জুমার দ্বিতীয় আজানের জবাব :

জুমার দ্বিতীয় আজানের সময় যখন খতিব সাহেব মিম্বরে উপবিষ্ট থাকেন, তখন ফেকাহবিদদের নির্ভরযোগ্য মতানুযায়ী জুমার দ্বিতীয় আজানের জবাব মৌখিক না দেয়াটাই উত্তম। তা সত্ত্বেও কেউ দিতে চাইলে মনে মনে জবাব দিতে পারে। (আদুররুল মুখতার : ১/২৯৯, ফাতাওয়া মাহমুদিয়া : ২/৫৮)৷ 

আজানের সময় দুনিয়াবি কথা ও কাজে লিপ্ত থাকা :

আজানের সময় চুপ থাকা সুন্নত। একান্ত প্রয়োজন না হলে সাধারণ দ্বীনি ও দুনিয়াবি কথা বা কাজে লিপ্ত থাকা অনুচিত। বক্তৃতা বা সেমিনার চলাকালে আজান হলে সাময়িক তা স্থগিত রাখবে। ওয়াজ বা কোনা দ্বীনি মাহফিল চলাকালেও তা সাময়িক বন্ধ রেখে সবাইকে আজানের জবাব দেয়া উত্তম। মনে রাখতে হবে, একজন আজানের জবাব দিলে সবার পক্ষ থেকে তা আদায় হয়ে যায় না। কেননা আজানের জবাব দেয়া শ্রবণকারী সব মুসলমানের জন্য সুন্নত। আর আজানের জবাব দেয়া সুন্নতে কেফায়া নয়। (ফাতহুল কাদির : ১/২৪৮, রদুল মুহতার : ১/৩৯৯, ফাতাওয়া মাহমুদিয়া : ৫/৪২৭)।

রেডিও টেলিভিশনের আজানের জবাব :

মুয়াজ্জিনের আজান রেডিও - টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা হলে তার জবাব দেয়া সুন্নত। রেকর্ড করা হলে তার জবাব দেয়া সুন্নত নয়। (বাদায়েউস সানয়ে : ১/৬৪৬, আপকে মাসায়েল আওর উনকা হাল : ১/১৭০)।

আজানের পর দরুদ শরিফ ও দোয়া :

আজানের পর দরুদ শরিফ ও দোয়া পাঠ করা সুন্নত । হাদিস শরিফে এর ফজিলত বর্ণিত হয়েছে।

আজানের দোয়া -

اللَّهُمَّ رَبَّ هَذِهِ الدَّعْوَةِ التَّامَّةِ وَالصَّلَاةِ الْقَائِمَةِ آتِ سَيّدِنَا مُحَمَّدَاً الْوَسِيلَةَ وَالْفَضِيلَةَ وَابْعَثْهُ مَقَامَاً مَحْمُودَاً الَّذِي وَعَدْتَهُ وَارْزُقْنَا شَفَا عَتَهُ يَوْمَ الْقِيَامَتِه إِنَّكَ لَا تُخْلِفُ الْمِيعَادَ

উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা রাব্বাহাযিহিদ দাওয়াতিত্তাম্মাহ ওয়া সালাতি ক্বায়িমা, আতি সায়্যিদিনা মুহাম্মাদানিল ওয়াসিলাতা ওয়াল ফাদিলা ওয়াদ্দারাজাতার রাফিয়াহ, ওয়াব আসহু মাক্কামাম্মাহমুদানিল্লাযি ওয়া আত্তাহ, ওয়ার যুক্বনা শাফা’আতাহু ইয়াওমাল ক্বিয়া-মাহ ইন্নাকা লা তুখলিফুল মিয়াদ।’ এই দোয়াটি পড়ার জন্য হাত তোলার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করা নেই। (ফয়জুল বারি : ১৬৭, ফাতাওয়া মাহমুদিয়া : ১৬/২০৮)।

একামতের জবাব দেয়াও মুস্তাহাব :

আজানের মতো মুসল্লিদের একামতের জবাব দেয়াও মুস্তাহাব। (ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ১/৫৭) একামতের জবাবও আজানের অনুরূপ। শুধু একামতের মধ্যে ‘ক্বাদ ক্বামাতিস সালাহ’ এর জবাবে ‘আক্বামাহাল্লাহু ওয়া আদামাহা’ বলবে। হজরত আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত, একবার হজরত বেলাল (রা.) একামত দিচ্ছিলেন, তখন নবী করিম (সা.) ও তার সঙ্গে আজানের অনুরূপ উত্তর দিয়েছেন। তবে ‘ক্বাদ ক্বামাতিস সালাহ’ বলার সময় বলেন, ‘আক্বামাহাল্লাহু ওয়া আদামাহা।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৫২৮)।

দৈনিক বগুড়া