নফসের বিরুদ্ধে জিহাদের কতিপয় পন্থা নিম্নে আলোচনা করা হলো-
(১) ইলমে দ্বীন হাসিল করা: ইলমে দ্বীন হাসিলের মাধ্যমে আমরা কু-প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদ করতে পারি। কেননা ধর্মীয় জ্ঞানই হলো মূল হাতিয়ার। যা খারাপ নির্দেশকে নাফসের বিরুদ্ধে জিহাদে অগ্রনী ভূমিকা রাখে। আর এই জ্ঞানের মৌলিক উৎস হলো কোরআন ও সহিহ হাদিস। যেমন আল্লাহর পক্ষ থেকে তার রাসূলের (সা.) নিকট অবতীর্ণ ওহির সূচনা হয়েছিল।
আল্লাহ তায়ালার বলেন,
اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ
‘পড় তোমার রবের নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। (সূরা: আল-আলাক, আয়া:-১)।
আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন,
إِنَّ هَـذَا الْقُرْآنَ يِهْدِي لِلَّتِي هِيَ أَقْوَمُ
‘এই কোরআন এমন পথ প্রদর্শন করে যা সর্বাধিক সরল সঠিক।’ (সূরা: বনী ইসরাঈল, আয়াত: ৯)।
অন্যত্র বলেন,
فَلَوْلاَ نَفَرَ مِن كُلِّ فِرْقَةٍ مِّنْهُمْ طَآئِفَةٌ لِّيَتَفَقَّهُواْ فِي الدِّينِ وَلِيُنذِرُواْ قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُواْ إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ
‘প্রত্যেক সম্প্রদায় থেকে কিছু লোক গভীর ভাবে দ্বীন জ্ঞান অর্জনের নিমিত্তে বের হয়ে পরে না কেন? আর তারা তাদের সম্প্রদায়ের লোকদের কাছে ফিরে এসে তাদেরকে সর্তক করবে। যাতে তারা মুক্তি লাভ করতে পারে। (সূরা: আত তাওবাহ, আয়াত:১২২)।
(২) আল্লাহর দিকে ডাকা: অন্যকে আল্লাহর দিকে আহ্বান করার পূর্বে সর্বাগ্রে নিজে আত্নসমর্পন করা। যেমন আল্লাহ তায়ালা নবী (সা.)-কে উদ্দেশ্য করে ব্যক্ত করেছেন-
আমি আদিষ্ট হয়েছি যেন আত্নসমর্পনকারী মুসলিমদের অগ্রনী হই। সুতরাং উক্ত আয়াতে নবী (সা.) -কে দাওয়াত দেয়ার পূর্বে নিজেকে তা বাস্তবায়ন করতে আদেশ করা হয়েছে। তাই রাসূল (সা.) সব ক্ষেত্রে অন্যকে আহ্বানের পূর্বে নিজে আমল করতেন।
(৩) আল্লাহর আদেশের প্রতি আত্নসমর্পন না করে শুধু অন্যকে আহ্বান করা নিন্দনীয় কাজ। এই মর্মে আল্লাহ তায়ালার বাণী- আল্লাহ বনী ইসরাইলদেরকে সম্বোধন করে বলেন,
أَتَأْمُرُونَ النَّاسَ بِالْبِرِّ وَتَنسَوْنَ أَنفُسَكُمْ وَأَنتُمْ تَتْلُونَ الْكِتَابَ أَفَلاَ تَعْقِلُونَ
‘তোমরা কি মানুষকে সৎকর্মের নির্দেশ দাও এবং নিজেরা নিজেদেরকে ভুলে যাও, অথচ তোমরা কিতাব পাঠ কর? তবুও কি তোমরা চিন্তা কর না?’ (সূরা: আল বাকারাহ, আয়াত: ৪৪)।
(৪) আমলে সালেহ: আল্লাহ মানুষকে তার প্রতিনিধি হিসেবে সৃষ্টি করেছেন এবং পৃথিবীতে তাদের চলাফেরা ও আমল করার ক্ষমতা দিয়েছেন। এবং মানুষকে সিরাতে মুস্তকিমের পথে আহ্বান করেছেন এবং আমলে সালেহ এর মাধ্যমে কেয়ামতের দিন তার সাক্ষাৎ লাভের ঘোষণা দিয়েছে। যেমন: রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তায়ালা বলেন,
يَا أَيُّهَا الْإِنسَانُ إِنَّكَ كَادِحٌ إِلَى رَبِّكَ كَدْحًا فَمُلَاقِيهِ
‘হে মানুষ, তোমাকে তোমরা পালনকর্তা পর্যন্ত পৌছতে কষ্ট স্বীকার করতে হবে, অতঃপর তার সাক্ষাৎ ঘটবে।’ (সূরা: ইনশিকাক, আয়াত: ৬)।
ইবনে কাসীর (আ.) বলেন, তোমাকে তোমার রবের সাক্ষাৎ পেতে অত্যন্ত সাধনার মাধ্যমে আমলে সালেহ সম্পাদন করতে হবে। অতঃপর নেক কাজ করলে নেককার হিসেবে, আর বদ কাজ করলে বদকার হিসেবে তার সঙ্গে তোমার সাক্ষাৎ হবে। (তাফসিরুল কোরআনুল কারিম ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৪৮৮)।
(৫) পাপ কাজ থেকে দূরে থাকা: মানুষ যখনই আত্নিক জিহাদে প্রবৃত হয় তখন তার মানবীয় বৃদ্ধি কৌশেলের পরিপক্কতা হাসিল হয়। কেননা, কু-প্রবৃত্তির অনুসরণ মানুষের সুস্থ চিন্তাধারা হ্রাস করে ফেলে। যেমন: রাসূল (সা.) বলেছেন,
‘প্রকৃত মুজাহিদ হলো সেই ব্যক্তি যে আল্লাহর আনুগত্যের জন্য স্বীয় প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদ করে। আর প্রকৃত মুজাহির হলো সেই ব্যক্তি যে যাবতীয় পাপ কাজ থেকে বিরত থাকে। (আহমাদ, সিলসিলা সহিহ হা: ৫৪৯)।
(৬) ধৈর্য ধারণ করা: ধৈর্য একটি মহৎ গুণ, ধৈর্যের মাধ্যমে আল্লাহর পক্ষ থেকে বিজয় আসে। তাই নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে হলে বিপদাপদে ও সব ক্ষেত্রে ধৈর্যশীল হতে হবে। যেমন তায়েফের জনগনকে রাসূল (সা.) তাদেরই কল্যাণের জন্য আহ্বান করেছিলেন। অথচ তিনি মার খেয়ে রক্তাক্ত হয়ে ফিরে আসলেন। কিন্তু তিনি ধৈর্য হারা হলেন না, বাতিল পন্থীরা অন্যায়ের ওপর ধৈর্য ধারণ করতে পারলে হক্ব পন্থীদের আরো বেশি ধৈর্য ধারণ করা উচিত। অন্যথায় প্রকাশ্য ভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের কাতারে সামিল হতে হবে। অতএব, নফসের বিরুদ্ধে জিহাদের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে যেকোনো পাপ কর্ম হতে বিরত থেকে হক্বের ওপর নিজেকে দৃঢ় রাখার মাধ্যমে ধৈর্য ধারণ করা।
নফসে আম্মার ওপর বিজয়ের মূল হাতিয়ার: ইলমে দ্বীন হাসিলের মাধ্যমে অন্তনিহিত অজ্ঞতাকে ভূলুন্ঠিত করে আমরা নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে পারি। কেননা অজ্ঞতাই অন্যায় কর্ম প্রশ্যয় দেয়ার ও তা সম্পাদন করার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। আর উপকারী ইলমই হলো মূল হাতিয়ার যা খারাপ নির্দেশকে নফসের বিরুদ্ধে জিহাদে অগ্রনী ভূমিকা রাখে।
কৃপানিধান রবের কৃপা অর্জন: ত্যাগের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করার ফলে নফসে লাওওয়ামাহ থেকে কারো নাফস যখন নফসে মুতমাইন্নাহ উন্নীত হবে। তখন তার আত্না আল্লাহর উদ্দেশ্যে সম্পাদিত যাবতীয় ইবাদতের ক্ষেত্রে আত্নিক প্রশান্তি অনুভব করে। ফলে কৃপানিধান রবের কৃপা অর্জনের সে সক্ষম হবে ।
জিহাদুন নফসের ফলাফল: নফসের বিরুদ্ধে জিহাদের চুরান্ত ফলাফল হলো- আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে জান্নাত লাভ। যেমন: আল্লাহ তায়ালা বলেন,
وَأَمَّا مَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ وَنَهَى النَّفْسَ عَنِ الْهَوَى
فَإِنَّ الْجَنَّةَ هِيَ الْمَأْوَى
‘পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি তার পালানকর্তার সামনে দণ্ডায়মান হওয়াকে ভয় করে এবং প্রবৃত্তির অনুসরণ থেকে নফসকে নিবৃত্ত রাখে তার ঠিকানা হবে জান্নাত।’ (সূরা: নাযিআত, আয়াত: ৪০-৪১)।
উপসংহার: নফসের কু-প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদ করা বড় ধরনের একটা সংগ্রাম। প্রতিটি মুসলমানকে সর্বদা এই জিহাদ চালিয়ে যেতে হবে। যাতে করে পরকালে সফলতা অর্জন করা যায়। আল্লাহ আমাদের সবাইকে পরিপূর্ণ ভাবে নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
দৈনিক বগুড়া