বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বগুড়া কাহালুতে চলছে শীতের রসনামা ও খেজুর গুড় তৈরীর কাজ

বগুড়া কাহালুতে চলছে শীতের রসনামা ও খেজুর গুড় তৈরীর কাজ

প্রকৃতিতে ঢেউ খেলছে পৌষ। শীতের আবহ শুরু হয়ে দিন দিন তা বেড়েই চলছে। তীব্র শীত ও ঘন কুয়াশায় মোড়ানো রয়েছে উত্তরাঞ্চল। এমন সময় শতশত গ্রাম বাংলার আরেকটি পরিচয় রয়েছে। খেজুর রস এবং রসের তৈরি গুড়। বাঙালীর শীতকাল মানেই পিঠাপুলি। আর পিঠা তৈরির অন্যতম অনুষঙ্গ খেজুর রস ও গুড়।

মধ্য পৌষে খেজুরের রসের পাটালি গুড় তৈরিতে ধুম পড়েছে বগুড়ার গ্রামাঞ্চলে। সেই সঙ্গে ব্যস্ততা বেড়েছে গাছিদের। জেলায় বেশ কিছুদিন ধরে হাঁড় কাপানো শীত বইছে। তবে তার আগে থেকেই শুরু খেজুর রস সংগ্রহের কাজ।

গাাছিরা জানান, খেজুর গাছ তৈরির প্রস্তুতি সম্পন্ন করার পর থেকেই মূলত রস নামানোর পর্ব শুরু হয়। গাছের মাথার নির্দিষ্ট স্থানে বাঁশের বানানো দু’টি চোখা খুঁটি পোঁতা হয়। সঙ্গে দড়ি বা সুতা বেঁধে মাটির পাত্র ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। পাত্রের ভেতর রস পড়ার জন্য বাঁশের তৈরি নালার মতো ভিন্ন একটি খুঁটি পুঁতে দেওয়া হয় সেই গাছের সঙ্গে। এভাবেই গাছির নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে খেজুর রস।

রস আহোরণে গল্পে তারা জানান, দুপুরের পর থেকে তারা দুইজন নির্দিষ্ট গাছগুলোতে উঠে তাতে হাঁড়ি ঝুলিয়ে আসেন। এরপর দিনগত রাত ৩টার দিকে, তারা ঘুম থেকে ওঠে গাছ থেকে রস নামানোর প্রস্তুতি নেন। ভোর হতেই সব গাছের রস সংগ্রহ করে তা টিনের বড় তাওয়ায় জ্বালিয়ে গুড়-পাটালি ও লালি তৈরির কাজে নেমে পড়েন।

গুড় তৈরির জন্য শুরুতে টিনের তাওয়াতে রস নামিয়ে আগুনে তাপানো হয়। এ সময় তাওয়াতে থাকা রস অনবরত নাড়তে হয়। তারা জ্বালানি হিসেবে খড় ব্যবহার করেন। রস জ্বালের ঘণ্টাখানেক পর রস ঘন হয়। এরপর তা নামিয়ে একটি গোলাকার হাড়িতে ঢেলে বাঁশের একটি সরু লাঠি দিয়ে ঘোরানো হয়। এক পর্যায়ে সেগুলোর ঘনত্ব আরও বেশি হয় এবং তা কাঠের তৈরি চারকোনা বিশিষ্ট খোপের মধ্যে ঢেলে পাটালি আকার দেওয়ার জন্য রেখে দেওয়া হয়।

গাছিদের ভাষ্য, গ্রামের ঘরে ঘরে খেজুর রসের পিঠা, পায়েস, গুড়ের মুড়ি-মুড়কি ও নানা ধরনের মুখরোচক খাবার তৈরি করার ধুম পড়েছে। বাজারে চিনির দাম তুলনামূলক কম হলেও পাটালি গুড়ের চাহিদা কমেনি বলে জানান তারা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলার কাহালু, শিবগঞ্জ, নন্দীগ্রাম, দুপচাঁচিয়া ও আদমদীঘি উপজেলায় খেজুর রসের গুড় বানানোর ছল সবচেয়ে বেশি ছিল। তবে কালের বিবর্তনে সেই জৌলুশ অনেকখানি কমে গেছে। তবে এখনও অনেক কারিগর তাদের পেশাটিকে আকড়ে রয়েছেন। এসব কারিগরদের কাছে জানা যায়, প্রতি বছরের মতো পাটালি গুড় তৈরির কাজে চলে এসেছেন বগুড়ায়।

বৃহস্পতিবার (১৪ জানুয়ারি) বগুড়া কাহালু উপজেলায় দূর্গাপুর ইউনিয়নের পাতঞ্জ গ্রামে চোখে পড়ে পাটালি গুড় তৈরিতে কারিগরদের ব্যস্ততা চোখে পড়ে। এই গ্রামের কারিগর ফজলু জানান তিনি প্রতিবছর গুড় তৈরি করছেন। তবে গেল বছরে তাদের চার জনের একটি দল ছিলো। এ বছর দুইজন না আসায় মিন্টু ও ফজলু দু’জনের দল বেঁধেছে।

ফজলু বলেন, আশ্বিনের মাঝামাঝি থেকে গাছের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ শুরু করা হয়। এ বছর মোট ১৪০টি গাছ রস উপযোগী করেছেন তারা। প্রস্তুত করা প্রতিটি গাছ থেকে সপ্তাহে দুই-তিনদিন রস সংগ্রহ করা হয়। প্রতিটি গাছ থেকে শুরুতে এক থেকে দুই কেজি করে রস সংগ্রহ হয় ও আস্তে আস্তে তা বাড়ে। প্রতিদিন ধাপে ধাপে সম্পূর্ণ গাছের রস সংগ্রহ করেন তারা।

রাজশাহী জেলার বাঘা উপজেলার আরপাড়া গ্রামের গাছি মো. মিন্টু আলী (৪৮) বগুড়ায় এসেছেন রস আহরোণ ও গুড় তৈরি করতে। তিনি প্রায় ছয় বছর ধরে এ জেলায় আসছেন।

গাজী বলেন, শুরুর পর প্রথমদিকে প্রতিদিন আনুমানিক পাঁচ কেজি করে পাটালি গুড় তৈরি হয়। তারপর মাঝামাঝি থেকে পুরো মৌসুমে প্রতিদিন ৫০ কেজি থেকে ১২০ কেজি পাটালি ও লালি তৈরি করা হয়। প্রতি কেজি পাটালি ও লালিগুড় বাজারে পাইকারদের কাছে ৯০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি করা হয়।

রস নিয়ে ব্যস্ততার গল্প হলেও ব্যবসা আর আগের মত নেই বলে জানান গাছি ও কারিগররা। তাদের আগেই পাইকারদের থেকে টাকা ধার নিতে হয়। এ জন্য গুড়গুলো পাইকারদের কাছেই বিক্রি করতে হয়। এ কারনে কারিগরদের আয় হলেও লাভের অংকটা খুব সীমিত।

দৈনিক বগুড়া