বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

হাফেজে কোরআনের সুপারিশ ও হাফেজ হওয়ার বিস্ময়কর ঘটনা

হাফেজে কোরআনের সুপারিশ ও হাফেজ হওয়ার বিস্ময়কর ঘটনা

কেয়ামতের দিন একজন কোরআনের হাফেজকে এমন দশজন ব্যক্তির জন্য সুপারিশ করার অধিকার এবং নির্দেশ দেয়া হবে, যাদের ওপর জাহান্নাম অবধারিত হয়ে গেছে। 

এখানে একটি প্রশ্ন দেখা দেয়, যে পবিত্র কোরআন কোন শ্রেণির লোক তথা কাদের জন্য সুপারিশ করবে? ওলামায়ে কেরাম লিখেছেন যখনই কোনো শিশু পবিত্র কোরআন শরিফ হিফজ করার ইচ্ছা করে বা তাদের অভিভাবকরা তাদের হিফজখানায় পাঠাতে চায়, তখন আশপাশের লোকেরা সোজা দুভাগে বিভক্ত হয়ে যায়।

বড় তথা প্রথম ভাগের লোক তারা, যারা নানাভাবে তাকে পবিত্র কোরআন হিফজ করার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত এবং নিষেধ করতে থাকে। তারা তাকে এই বলে বোঝাতে চেষ্টা করে যে, তুমি হাফেজ হয়ে কী করবে? মেয়েদেরকেও বলে তোমরা হাফেজা হয়ে কী করবে? হাফেজ হওয়া খুব বড় কঠিন কাজ। তার চেয়ে বড় কঠিন কাজ তা মুখস্ত করা। অনেক কষ্টে যদি হাফেজ হয়েও যাও তারপরও সেটা আর মুখস্ত রাখতে পারবে না। এমনি করে তারা তাকে হাফেজ হওয়া থেকে নানাভাবে বারণ এবং নিরুৎসাহী করে। বরং আরো বলে এর চেয়ে তোমরা স্কুল কলেজে পড়লে অনেক ভালো করবে, সার্টিফিকেট পাবে, দামী ক্যারিয়ার গঠন করতে পারবে। এই শ্রেণীর লোক যেমন নিকটাত্মীয়-পাড়া প্রতিবেশিও হতে পারে, আবার বন্ধু বান্ধবও হতে পারে।

কিছু লোক এমনও থাকে যারা সেই শিশুকে সাহস যুগিয়ে উৎসাহিত করে। তাকে সাপোর্ট করে বলে, বাবা! চালিয়ে যাও, চেষ্টা করলে তুমি অবশ্যই পারবে এবং সফল হবে। একজন বিখ্যাত হাফেজ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারবে। ইহকাল-পরকালের সফলতার পাশাপাশি তুমি আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য লাভ করতে পারবে, অনেক সওয়াব পাবে।

মুহাদ্দিসরা লিখেছেন- পবিত্র কোরআন শরিফের হাফেজদের যখন কেয়ামতের দিন দশজন করে লোকের সুপারিশ করার সৌভাগ্য জুটবে তখন যেসব লোক তার কোরআন হিফজ করার সময় বিরোধিতা, অসহযোগিতা এবং নিরুৎসাহিত করেছিল তারা তার এই সুপারিশ থেকে মাহরুম তথা বিরত হয়ে যাবে। তাদের সুপারিশ করার অধিকার সেসব ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে, যারা তাদেরকে হিফজ করার সময় নানাভাবে সহযোগিতা ও উৎসাহ প্রদান করেছে। নিজেরাও তাতে খুশি হয়েছে এবং তাদের উৎসাহে পিতা-মাতা, ভাই-বোনেরাও খুশি হয়ে তাদেরকে মাদরাসায় পাঠিয়েছে। এদের ভেতর থেকে এমন দশজন মানুষের জন্য হাফেজ সাহেব সুপারিশ করবে, যাদের জন্য জাহান্নাম অবধারিত হয়ে গিয়েছিল। এরপর তাদের সুপারিশের কারণে ওইসব ব্যক্তিকে জাহান্নাম থেকে বের করে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।

বাহুবলে এই সৌভাগ্য অর্জন হয় না:

পবিত্র কোরআন শরিফ হিফজ করা খুবই আনন্দের বিষয়। এই সৌভাগ্য সবার নসিব জুটে না। আল্লাহ তায়ালা যাকে চান তাকে দান করেন। সেইসব ভাগ্যবান শিশু যারা পবিত্র কোরআন হিফজ করতে পারছে, তাদের পিতা-মাতারাও আরও সৌভাগ্যবান। তারা আন্তরিক ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। তাদের এ কাজও ধন্যবাদযোগ্য। আর হাফেজ শিশুরা তো আরো বেশি মুবারকবাদ এবং ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। সেই সঙ্গে তাদের পাড়া-প্রতিবেশি, আত্মীয় স্বজনক, যারা নানাভাবে উৎসাহ যুগিয়েছে, তারাও ধন্যবাদ এবং মুবারকবাদ পাওয়ার উপযুক্ত। এটি একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের বিশেষ দয়া, অনুগ্রহ আর মেহেরবাণী ছাড়া কিছুই নয়। কবি বলেন, এই সৌভাগ্য নিজ বাহুবলে অর্জন করা সম্ভব হয়নি। যতক্ষণ না তা মহাদাতা আল্লাহ তায়ালা দান করেছেন। অনেক লোক এমনও আছেন যারা ভীষণ মেধাবী, অত্যন্ত বুদ্ধিমান। কিন্তু তা সত্তেও তারা পবিত্র কোরআনের হাফেজ হতে পারেননি। আবার এমনও অনেক আছেন, যারা তুলনামূলক অতটা মেধাবী নয়, কিন্তু তারপরও তারা পবিত্র কোরআনের হাফেজ হয়ে যান। এটি অনেক সৌভাগ্যের ব্যাপার যে, তাদের সময় আল্লাহ তায়ালার পবিত্র কালাম তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে কেটে যায় এবং প্রতিটি মুহূর্তে নেকি অর্জিত হয়। 

নারীদের মাঝে হিফজুল কোরআনের আগ্রহ:

এই উম্মতে মুহাম্মাদীর নারীর জাতির মধ্যে পবিত্র কোরআনের সর্বপ্রথম হাফেজা ছিলেন সাইয়েদা আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)। এরপর দ্বিতীয় হাফেজা ছিলেন সাইয়েদা হাফসা বিনতে খাত্তাব অর্থাৎ হজরত ওমর (রা.) এর বোন। এই ভাবেই মেয়েদের মধ্যে পবিত্র কোরআন হিফজ করার ধারাবাহিকতা চলে এসেছে। এমনকি নারী সাহাবিদের মধ্যেও অনেক নারী সাহাবি হাফেজে কোরআন ছিলেন। এরপর এই ধারা তাবেঈনদের মধ্যে চালু থাকে এবং এখনও তা দুর্বার গতিতে অব্যাহত রয়েছে এবং কেয়ামত পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকবে ইনশাআল্লাহ! আল্লাহ তায়ালা প্রতি যুগেই কিছু কিছু মানুষের অন্তরে পবিত্র কোরআনের এমন ভালবাসা গেঁথে দেন যার ফলে তারা উদ্বুদ্ধ হয়ে ভীষণ আগ্রহ নিয়ে পবিত্র কোরআন হিফজ করার জন্য অক্লান্ত মেহনত করতে থাকেন এবং কোরআনের হাফেজ হয়ে যান।

পাঁচ বছর বয়সে কোরআন হিফজ:

খলিফা হারূনুর রশিদের দরবারে একটি শিশু উপস্থিত করা হয়। তাকে তার পিতা বলে, বাবা! খলিফাকে একটু পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করে শোনাও। শিশুটি এতই ছোট ছিল যে, খলিফার দরবারেও পিতার কাছে জিদ করে বলে, বাবা! তুমি যদি আমাকে খাওয়ার জন্য পুতুল এনে দাও তাহলেই কেবল আমি কোরআন তেলাওয়াত করে শোনাব। প্রকাশ থাকে যে, সে যুগের চকলেট এবং ক্যান্ডিগুলো পুতুলের আদলে তৈরি করা হত। তাই সেই ছেলে পুতুল খেতে চেয়েছিল। পিতা তার আবদারে রাজি হয়ে বলে, ঠিক আছে বেটা! আগে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করে শোনাও। আমি অবশ্যই তোমাকে পুতুল (পুতুল আকৃতির ক্যান্ডি) এনে দেব। একথা শুনে সে শিশু পবিত্র কোরআন শরিফ তেলাওয়াত শুরু করে দেয়। খলিফা হারূনুর রশীদ তাকে বিভিন্ন স্থান থেকে তেলাওয়াত করতে বললে সে শিশু সেভাবেই তেলাওয়াত করে শোনায়। তার মানে সে একজন পাক্কা হাফেজ। তার বয়স জিজ্ঞাসা করলে জানা যায়, সে এখন মাত্র পাঁচ বছরের শিশু। আল্লাহু আকবার! দেখুন, আল্লাহ তায়ালার এটা কত বড় কৃপা এবং অনুগ্রহ যে মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই সে গোটা কোরআনের হাফেজ হয়ে গেছে!

মাত্র সাত মাসে কোরআন হিফজ:

এই সামান্য কিছুদিন আগের কথা। আমাদের জামেয়ার (মাদরাসার) একটি কচি মেয়ে বিস্ময়করভাবে মাত্র সাতমাস সময়ে গোটা কোরআন মজিদ হিফস সম্পন্ন করেছে। প্রিয় সুধী! এই সাত মাসেরও কমে পবিত্র কোরআন হিফজকারী অনেক বিস্ময় বালক-বালিকাও রয়েছে।

এক মাসে কোরআন হিফজ:

হজরত মাওলানা কাসেম নানুতুবী (রহ.) দারুল উলুম দেওবন্দ মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তিনি একবার হজে যাচ্ছিলেন। সে যুগে সামুদ্রিক জাহাজের করে হজব্রত পালন করতে হত এবং সে জন্য মাসের পর মাস পথেই কেটে যেত। যার কারণে মানুষ রমজান মাসের আগেই হজের সফরে বেরিয়ে পড়ত। যেন ঠিক সময়মত পবিত্র মক্কা মুকাররমায় পৌঁছতে পারে। হজরত কাসেম নানুতবী (রহ.)ও এমনটিই করলেন।

সফরকালে যখন পবিত্র রমজান মাস এসে উপস্থিত, তখন তিনি জানতে পারেন যে, তাদের কাফেলায় একজনও পবিত্র কোরআনের হাফেজ নেই, যে তারাবিহতে পুরো কোরআন তেলাওয়াত করে শোনাতে পারে। অবশ্য জাদরেল আলেম ছিলেন অনেক জন। হজরত নানুতুবী (রহ.) বললেন, আমার কাছে এটা ভাল লাগছে না যে, এত বড় বিশাল একটি ওলামা জামাতে খতম তারাবিহ না হয়ে শুধু (কোরআনের শেষের দিকের কয়েকটি) সূরা তারাবিহ হবে। এরপর তিনি গোটা দিন কঠোর পরিশ্রমে এক পারা করে মুখস্ত করে তা রাতের তারাবিহ নামাজে শুনিয়ে দিতে থাকেন। এভাবে ত্রিশ দিনে গোটা ত্রিশ পারা কোরআন শরিফ তিনি হিফজ করে নেন। আল্লাহু আকবার! এটিই হলো মাত্র একমাসে পুরো কোরআন শরিফ হিফজ করার দৃষ্টান্ত। তাও আবার প্রচলিত পদ্ধতিতে কোনো উস্তাদের তত্তাবধানে এবং শাসনে থেকে নয়।

মাত্র তিনদিনেকোরআন হিফজ!

এই এক মাসের চেয়ে কম সময়েও পুরো কোরআন শরিফ হিফজ করার রেকর্ডও পৃথিবীতে রয়েছে। হিশাম বিন কালবী নামে একজন বিখ্যাত আলেম ছিলেন। একবার তিনি বেশ কিছু আলেমের সঙ্গে বসে ছিলেন। সেখানে একে অপরকে এভাবে পরিচয় করিয়ে দেয়া হচ্ছিল যে, ইনি অমুক। ইনি একজন আলেম। আর উনিও একন বিখ্যাত আলেম এবং নামকরা হাফেজ। এভাবে এক পর্যায়ে তার পালা এলে বলা হয়, ইনিও একজন বড় আলেম। তবে তিনি হাফেজ নন। তিনি বলেন, ব্যাস। সে সময় আমার মনে সংকল্প চেপে বসে যে, আমাকে হাফেজ হতেই হবে। ব্যাস তখনই একটি কোরআন শরিফ চেয়ে নিয়ে তা মুখস্ত করা শুরু করে দিই এবং তিনদিনের মধ্যেই আমি গোটা কোরআন শরিফই মুখস্ত করে ফেলি। এরপর বিভিন্নজন বিভিন্ন সময়ে আমার পরীক্ষা নিয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ! আল্লাহর রহমতে আমি প্রতিটি পরীক্ষাই সফলতার সঙ্গে উৎরে গেছি।

প্রিয় সুধী! এমন অনেক লোকই আছেন যাদেরকে আল্লাহ তায়ালা এমনভাবে কোরআন শরিফ মুখস্ত করিয়ে দেন, যেন তার স্ক্রীনের সামনে বসে দেখে দেখে তেলাওয়াত করছেন। এমনি তাদের অবস্থা ...।

দৈনিক বগুড়া