শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

হালদায় পোনা উৎপাদনে এবার রেকর্ড সাফল্য

হালদায় পোনা উৎপাদনে এবার রেকর্ড সাফল্য

প্র্রায় ৯৮ কিলোমিটার দীর্ঘ বাংলাদেশের কার্প জাতীয় মাছের (রুই, কাতল, মৃগেল, কালিবাউশ) প্রধান প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদী। হালদা থেকে এক যুগের ইতিহাসে ২০২০ সালেই ২৫ হাজার ৫৩৬ কেজি মাছের ডিম সংগ্রহ হয়েছে, যা গতবছরের চেয়ে প্রায় চারগুণ বেশি। ২৮০টি নৌকায় ৬১৫ জন মিলে এই ডিম সংগ্রহ করেছেন। গত ১২ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ডিম এবার পাওয়া গেছে।

মাঠ প্রশাসন, গবেষক এবং স্থানীয় সচেতন নাগরিক মহলের সমন্বিত কার্যক্রমেই হালদা নদী থেকে ডিম আহরণে এ বছরের রেকর্ড সাফল্য অর্জিত হয়েছে। হাটহাজারীর উপজেলা নির্বাহী অফিসারের তত্ত্বাবধানেই তা সম্ভব হয়েছে বলে পোণাজীবীরা স্বীকার করেছেন। হালদার প্রকৃতিক প্রজনন ও সমসাময়িক বিষয়গুলো নিয়ে ব্যাপক আলোচনায় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তৌহিদুল ইসলাম প্রতিবেদকের কাছে তার অভিজ্ঞতা ও বিশ্লেষণ জানিয়েছেন।

তিনি তার বিশ্লেষণে বলেছেন- হালদা নদী এবং নদীর পানির কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্যের জন্য এখানে মাছ ডিম ছাড়তে আসে বর্ষা মৌসুমের আগেই। টানা দুই- তিনদিনের বৃষ্টিতেই মা মাছেরা মুখ থেকে ডিম ছেড়ে দেয়। নদীর এমন ইতিহাস শুধু এ দেশেই নয় দক্ষিণ এশিয়া এমনকি বিশ্বেও নেই। এ বৈশিষ্ট্যগুলো ভৌতিক, রাসায়নিক এবং জৈবিক কারণেই হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মতামত দিয়েছেন। হালদার দুই পাড়ের মানুষ মিঠা পানির মাছের প্রাকৃতিক এই প্রজনন ক্ষেত্র থেকে প্রতিবছর বর্ষার শুরুতেই উৎসবমুখর পরিবেশে মা মাছের মুখ থেকে নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করে। ডিম আহরণের এই রেওয়াজ যুগ যুগ ধরে বংশ পরম্পরায় চলে আসছে হালদা পাড়ের মানুষের।

হালদা নদীর জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় হাটহাজারী উপজেলা প্রশাসন সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে। হাটহাজারীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ রুহুল আমীন প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জিং কার্যক্রম সফলভাবে মোকাবেলা করছেন। এর মধ্যে ২০১৯ সালের ২৯ এপ্রিল চট্টগ্রাম-নাজিরহাট রেল সড়কে ফার্নেস তেলবাহী একটি ট্রেন দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। হালদার যোগসূত্র মরাছরা খালের রেল সেতুটি ভেঙ্গে একটি ওয়াগন সম্পূর্ণভাবে পানিতে পতিত হয়। পতিত ওয়াগনে ছিল ২৫ হাজার লিটার ফার্নেস তেল যার সিংহভাগই ছড়ায় পড়ে।

এ সময় ফার্নেস তেল মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে মিঠা পানির মাছের প্রাকৃতিক ব্যাংক খ্যাত হালদা নদীতে। ইউএনও রুহুল আমিনের উদ্যোগে আড়াই কিলোমিটার খালের মধ্যে ১২টি বাঁধ নির্মাণ করা হয় তড়িৎ গতিতে। টানা পাঁচদিন কাজ করে হালদা থেকে প্রায় শতভাগ তেল অপসারণ করে নেয় শ্রমিকরা। ফলে হালদা নদী ভয়াবহ দূষণ থেকে রক্ষা পায়। এছাড়াও হালদা নদী থেকেই বর্তমানে চট্টগ্রাম ওয়াসা নগরে বসবাসকারী ৮০ লাখ লোককে পানি সরবরাহ করে। ২০১৮ সালের আগে এলাকার ময়লা আবর্জনায় হালদা নদীর ক্রিয়দাংশ ভাগাড়ে পরিণত হতো। হাটহাজারী পৌর এলাকার প্রধান খাল ‘কামাল পাড়া’ খালের মুখে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে লোহার গ্রিল বসানো হয়। ইউএনও আটকে যাওয়া ময়লা আবর্জনা প্রতি সপ্তাহেই পরিষ্কারের উদ্যোগ নেয়ার ফলে হাটহাজারী পৌর এলাকার বিভিন্ন নালা-নর্দমা থেকে আসা ময়লা-আবর্জনা আর পড়ছে না হালদা নদীতে।

হালদা গবেষক অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়ার মতে, কারখানা বন্ধ করে দূষণ ঠেকানো, বিদ্যুতকেন্দ্র বন্ধ করা, মানিকছড়ি পাহাড়ে তামাক চাষ বন্ধ, বছরব্যাপী চোরাশিকারী ও বালু উত্তোলনকারীদের তৎপরতা বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া এবং সর্বোপরি কোভিড-১৯ এর জন্য লকডাউনের ফলে পরিবেশের ভারসাম্য ঠিক থাকায় এই সুফল এসেছে।

ইউএনও রুহুল আমীন জানান, জেলা প্রশাসক চট্টগ্রাম এর সার্বিক নির্দেশনা ও হস্তক্ষেপে পরিবেশ অধিদফতর কর্তৃক এশিয়ান পেপার মিল ও ১০০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্লান্ট বন্ধ করে দেয়া হয়েছে হালদা নদীতে দূষিত কেমিক্যাল ফেলার কারণে। হালদা অভিযানের তথ্য থেকে তিনি আরও জানান, গত একবছরে ১০৯ বার হালদা নদীতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালিত হয়েছে। এসব অভিযানে ২ লাখ ২১ হাজার মিটার ঘেরাজাল জব্দ করা হয়েছে, যেগুলো দিয়ে মা মাছ শিকার করা হতো। বালু উত্তোলনকারী ৯টি ড্রেজার ও ১৫টি ইঞ্জিনচালিত নৌকা ধ্বংস করা হয়েছে। সাড়ে তিন কিলোমিটারেরও বেশি বালু উত্তোলনে ব্যবহ‍ৃত পাইপ ধ্বংস করা হয়েছে। জব্দ করা হয়েছে ১ লাখ ১৫ হাজার ঘনফুট বালু।

উপজেলা প্রশাসনের তথ্য থেকে প্রকাশ পেয়েছে, চট্টগ্রাম জেলার বর্তমান জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেনের নির্দেশনায় ২০১৯ সালের শুরু থেকেই হাটহাজারী উপজেলা প্রশাসনের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় হ্যাচারিগুলোতে ডিম পরিস্ফুটনের কাজ অত্যন্ত সুন্দর ও শৃঙ্খলার সঙ্গে সম্পন্ন হয়েছে। হাটহাজারী উপজেলার ডিম পরিস্ফুটনের জন্য নির্মিত তিনটি হ্যাচারির প্রায় ৭০ ভাগ কুয়া বা আয়তকার চৌবাচ্চা গত ৫ বছর ধরে পরিত্যক্ত ছিল। ২০১৯ সালে ডিম ছাড়ার প্রায় দুই মাস পূর্বে শতভাগ কুয়া ব্যবহার উপযোগী করে গড়ে তোলে উপজেলা প্রশাসন। শুধু তাই নয়, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত এবং পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা হয় এসব চৌবাচ্চায়। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করে কাজের তত্ত্বাবধান করা হয়। নিয়োগ দেয়া হয় কেয়ারটেকার, সার্বক্ষণিক গ্রাম পুলিশ মোতায়েন করে ডিম সংগ্রহকারীদের দেয়া হয় আস্থার পরিবেশ। ১৪১টি মাটির তৈরি কুয়া এবং সরকারী ৫ হ্যাচারির ১৩১টি কুয়ায় ডিম পরিস্ফুটন করা হয়। ২০১৮ সালের বিবেচনায় ২০১৯ সালে রেণু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ১১৭ কেজি। কিন্তু যথাযথ হ্যাচারি ব্যবস্থাপনা ও সংস্কারের কারণে গত বছর ২০১৯ সালে প্রায় ২০০ কেজি রেণু উৎপাদিত হয়। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও প্রায় ৮০ কেজি বেশি ছিল। প্রতি কেজি রেণুর বাজার মূল্য ৮০ হাজার টাকা হারে এ বছর হাটহাজারীর স্থানীয় ডিম আহরণকারীরা গত বছরের তুলনায় প্রায় ৬৪ লাখ টাকা বেশি মুনাফা করেছেন।

হালদার অতীত ও বর্তমান বিশ্লেষণে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তৌহিদুল ইসলাম জানান, ২০১৯ সালে প্রায় সাত হাজার কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়েছিল। ২০১৮ সালে স্থানীয়রা ডিম সংগ্রহ করেছিলেন ২২ হাজার ৬৮০ কেজি। এর আগে ২০১৭ সালে মাত্র ১ হাজার ৬৮০ কেজি, ২০১৬ সালে ৭৩৫ কেজি, ২০১৫ সালে ২ হাজার ৮০০ কেজি এবং ২০১৪ সালে ১৬ হাজার ৫০০ কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়। হালদা নদী থেকে শুধুমাত্র রুই বা কার্প জাতীয় (রুই, কাতলা, মৃগেল এবং কালিবাউশ) মাছের ডিম সংগ্রহ, রেণু উৎপাদন, পোনা বিক্রি ও মাছ বিক্রি করে বছরে উপজেলা প্রশাসনের আয় হয় প্রায় ৮২১ কোটি টাকা। যা ওই সময়ের দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনের ৬ শতাংশ। নদী হিসেবে এককভাবে আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে মৎস্যক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছে হালদা নদী। আর এই নদীর বালি উত্তোলন, চট্টগ্রাম ওয়াসার খাবার পানি সংগ্রহ, নদীর উভয় পাড়ের মানুষের কৃষিকার্য, জীবন-জীবিকা প্রভৃতি মিলিয়ে বছরে প্রায় ১০ হাজার ৭৩৫ কোটি টাকা আয় হয় এই নদীকে ঘিরে। এছাড়া প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এবং পরিবেশগত মূল্যে হয়ত আরও বাড়তে পারে।

 

দৈনিক বগুড়া

সর্বশেষ:

শিরোনাম:

এবার উত্তরবঙ্গের মহাসড়কে ঈদযাত্রা হবে স্বস্তির!
বগুড়ায় পানি নিষ্কাশনে ড্রেন নির্মাণ কাজের উদ্বোধন
বগুড়ায় দাম কমেছে পেঁয়াজ ও কাঁচা মরিচের
বগুড়ার বিখ্যাত সাদা সেমাই তৈরিতে ব্যস্ত কারিগর
স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর সঙ্গে দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রদূতের বৈঠক
চীনের সঙ্গে রাজনৈতিক-অফিসিয়াল যোগাযোগ বাড়াতে প্রস্তুত বাংলাদেশ
ভারতের কাছে পাঁচটি খাদ্যপণ্যের নিশ্চিত সরবরাহ চায় বাংলাদেশ
এপ্রিলে বাংলাদেশে আসছেন কাতারের আমির
ঈদে ট্রেন যাত্রার পঞ্চম দিনের টিকিট বিক্রি শুরু
গাবতলীতে বিভিন্ন কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস পালিত
সারিয়াকান্দিতে যথাযোগ্য মর্যাদায় মহান স্বাধীনতা পালিত
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি শুরু