বাড়িতে নতুন বউ এলে শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত? এ বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী পরিচালক ডা. মুনতাসীর আল মারুফ। লিখেছেন আতিফ আতাউর।
নতুন স্বপ্ন ও অজানা আশঙ্কা নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে পা ফেলে নববধূরা। স্বপ্ন নতুন জীবনের, আশঙ্কা অজানা চ্যালেঞ্জের। কারণ বিয়ে শুধু দুজন নারী-পুরুষের দাম্পত্যজীবন নয়, দুটি ভিন্ন পরিবার, তাদের সংস্কৃতিরও মেলবন্ধন। পাশাপাশি নতুন পরিবেশ ও মানুষের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ব্যাপার তো রয়েছেই। আমাদের সমাজে নানা কারণেই মেয়েদের জন্য বিয়ের বিষয়টি খুব চ্যালেঞ্জিং। শ্বশুরবাড়ি নববধূর জন্য একেবারেই নতুন এক অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য শুধু তার প্রচেষ্টাই যথেষ্ট নয়, দরকার শ্বশুরবাড়ির মানুষজনের সহযোগিতাও। নতুন বউকে নতুন পরিবেশে অভ্যস্ত হওয়ার ক্ষেত্রে শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের ভূমিকাই বেশি। এ জন্য প্রথমেই তার দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া জরুরি।
পরিবেশ সম্পর্কে ধারণা
নতুন বউকে শ্বশুরবাড়ির পরিবেশ সম্পর্কে শুরুতেই ধারণা দিন। বিশেষ করে কার কী অভ্যাস, কে কী পছন্দ করে—এ বিষয়ে বুঝিয়ে বলুন। এ সময় তার পছন্দ-অপছন্দ সম্পর্কেও শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের জেনে নেওয়া জরুরি। এতে পরবর্তী সময়ে আর অহেতুক কোনো জটিলতা তৈরি হবে না। একই সঙ্গে পরিবারের ছোট সদস্যদের সঙ্গেও তাকে পরিচয় করিয়ে দিন। নিজের বাড়ির চেনা পরিবেশ ছেড়ে আসার কষ্ট সামলে উঠে শ্বশুরবাড়ির অচেনা পরিবেশ ও জীবনযাপনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে এমন আচরণ খুব সহায়ক হবে নববধূর।
অভ্যাসে ছাড় দিন
মানুষ একেক পরিবেশে একেক রকম অভ্যাসে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। বিয়ের পর হঠাত্ করেই বদলে যায় একটি মেয়ের বহুদিনের অভ্যস্ত জীবনযাপন। যে মানুষটি দীর্ঘদিন নিজের বাড়িতে বেড়ে উঠেছে, সেই মানুষটি হঠাত্ করে নতুন আরেকটি বাড়িতে অভ্যস্ত হতে একটু সময় লাগবে। বিশেষ করে মেয়েদের বিয়ের আগের জীবন আর পরের জীবনের মধ্যে অনেক পার্থক্য থাকে। পার্থক্যগুলোর সঙ্গে মানিয়ে নিতেও নববধূর একটু সময় প্রয়োজন। বিশেষ করে ঘুম থেকে ওঠা, ঘুমানো, রান্নাবান্নার মতো কাজগুলোতে তাকে সময় দিন। সময় যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন বউ নতুন বাড়ির সঙ্গে মানিয়ে নেবে। মনে রাখবেন, বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের সাহায্য আর নববধূর নতুন পরিবেশে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতার ওপরই কিন্তু নির্ভর করে একটি সুখী দাম্পত্যজীবন।
তাকে পরিবারের একজন ভাবুন
নতুন বউকে শুধু বউ হিসেবে নয়, বরং পরিবারের একজন আপন মানুষ হিসেবে দেখুন। যে মানুষটি নিজের বাড়ি, মা-বাবা, ভাই-বোন সব কিছু ছেড়ে এসেছে, তাকে ভুলেও পর ভাবতে যাবেন না। বিয়ের পর থেকে সে এখন আপনাদেরই স্বজন, সুখ-দুঃখের সঙ্গী। তার প্রতি তেমন মনোভাবই প্রকাশ করুন।
ভুল করলে শুধরে দিন
কোনো মানুষই ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। নতুন বাড়িতে অভ্যস্ত হতে গিয়ে, শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের মন জয় করতে গিয়ে নতুন বউয়ের কথা ও কাজে কোনো ভুল হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তার ভুলগুলো সহজভাবে দেখুন। আন্তরিকতার সঙ্গে শুধরে দিন। শ্বশুর-শাশুড়ি নয়, বরং নিজেদের মেয়ে হিসেবেই দেখুন নতুন বউকে। কোনো কাজ না পারলে শিখিয়ে দিন।
ছোট ছোট কাজ দিন
শুরুতেই নববধূর ঘাড়ে কাজের বোঝা চাপিয়ে দেবেন না। শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে আগে তাকে পরিচিত হতে দিন। সময় দিন। কোনো কাজই তার উপর চাপিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। নতুন বউ কাজ করতে চাইলে সকালের চা বানানো, বিকেলের নাশতা, ঘর গোছানো ও বাগান পরিচর্চার মতো ছোট ছোট কাজ তাকে দেওয়া যেতে পারে। এ ছোট কাজগুলো থেকেই একসময় সে নিজে থেকেই বড় কাজের দায়িত্ব নেবে। এসব কাজ করার সময় তাকে সহযোগিতা করুন।
তার ভালো লাগা মন্দ লাগা জানতে চান
শ্বশুরবাড়িতে নতুন বউয়ের একা লাগাই স্বাভাবিক। এ সময় তাকে সঙ্গ দিন। চা পানের সময় তাকে সঙ্গে নিন। পারিবারিক কোনো আলাপ-আলোচনায়ও তাকে অংশ নিতে বলুন। তার মতামত জানতে চান। এতে সে নিজেও যে এই পরিবারের একজন, এটা ভাবতে শিখবে। তার মধ্যে দায়িত্ববোধ ও মমত্ববোধ তৈরি হবে। নতুন বাড়িতে তার কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না জানতে চান। নববধূর ভালো ও মন্দ লাগাকে প্রাধান্য দিন।
নববধূকে উৎসাহ দিন
নতুন বউয়ের কোনো কাজ—সেটা যাই হোক, রান্না বা অন্য কিছু, প্রশংসা করুন। তাকে উৎসাহ দিন। তার মানিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টাকে প্রশংসা করুন। এতে সে আরো ভালো করার চেষ্টা করবে। নতুন বউয়ের বাড়ি থেকে তার মা-বাবা কিংবা আত্মীয় এলে তাদের সামনে বউয়ের সমালোচনা নয়, বরং গুণকীর্তন করুন। এতেও সে উত্সাহ পাবে।
স্বামীর দায়িত্বশীল আচরণ
শ্বশুরবাড়িতে নববধূর সবচেয়ে কাছের মানুষটি কিন্তু আপনি। তার ঘনিষ্ঠ আপনজনও। এ জন্য স্বামীর রয়েছে বাড়তি দায়িত্ব। নতুন বউয়ের সুবিধা-অসুবিধার দিকটি আপনাকেই সবার আগে বেশি খেয়াল রাখতে হবে। সে তার সুবিধা-অসুবিধার কথা আপনাকে যত সহজে বলতে পারবে, অন্যদের তা পারবে না। তার যেকোনো সমস্যায় পাশে দাঁড়ান। স্ত্রীকে নতুন বাড়িতে অভ্যস্ত করতে এবং সবার সঙ্গে একটি সুন্দর সম্পর্ক গড়ে দিতে স্বামীকে বলিষ্ঠ ও কৌশলী ভূমিকা পালন করতে হবে। আর স্ত্রী যদি কর্মজীবী হয়ে থাকেন, সেক্ষেত্রেও সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা আপনাকেই রাখতে হবে। তাঁর কাজের গুরুত্ব ও কাজের জায়গার তাঁর কর্তব্য সম্পর্কে নিজের বাড়ির মানুষকে বুঝিয়ে বলতে হবে। সকালে স্ত্রী অফিসে যাওয়ার আগে দু’একটি কাজে স্ত্রীকে সাহায্য করতে পারেন। সেটিও মানসিকভাবে দারুণ রাখবে স্ত্রীকে।
দৈনিক বগুড়া