সোমবার, ০৭ জুলাই ২০২৫, ২২ আষাঢ় ১৪৩২

প্রতিবন্ধকতা জয় করে তুলির আঁচড়ে জীবন চলে তমজিদের

প্রতিবন্ধকতা জয় করে তুলির আঁচড়ে জীবন চলে তমজিদের

সংগৃহীত

তমজিদ উদ্দিন কথা বলতে পারেন না, শোনেন না কানেও। চল্লিশ ছুঁই ছুঁই এই প্রতিবন্ধী ব্যক্তির কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। তবু চমৎকার ছবি আঁকেন, নিখুঁত বিন্যাসে ব্যানার-পোস্টার ও দেয়ালিকা লেখেন। এভাবে যা আয় হয়, তা দিয়ে সংসার চালান। দরিদ্র পরিবারে জন্ম হলেও তমজিদ উদ্দিন কারও বোঝা হতে চাননি। তাঁর দাবি, নিজের চেষ্টায় এই দক্ষতা অর্জন করে দুই যুগ ধরে কাজটি করে যাচ্ছেন।

তমজিদ উদ্দিনের বাড়ি নেত্রকোনার মদন উপজেলার বাঁশরী গ্রামে। একই গ্রামের মৃত শামছুল ইসলাম ও শাহেরা আক্তার দম্পতির পঞ্চম সন্তান তিনি। বর্তমানে মদন পৌর শহরের শ্যামলী এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় সপরিবারে থাকেন তমজিদ। স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে তমজিদ উদ্দিনের সংসার। তাঁর স্ত্রীও বাক্‌ ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী। ছয় বছরের বড় মেয়ে তমা আক্তার স্থানীয় একটি স্কুলে পড়াশোনা শুরু করছে। মেজ মেয়ের বয়স চার আর ছেলের বয়স দুই বছর।

স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা ও তমজিদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তমজিদ উদ্দিনের বয়স যখন আড়াই বছর, তখন তাঁর একবার টাইফয়েড জ্বর হয়। সেই থেকে তিনি বাক্‌ ও শ্রবণশক্তি হারিয়ে ফেলেন। পরিবারের আর্থিক সামর্থ্য না থাকায় ওই সময় চিকিৎসা করানো সম্ভব হয়নি। ফলে এসব শারীরিক সমস্যা সঙ্গে করেই বেড়ে ওঠেন তিনি। সমবয়সীদের স্কুলে যেতে দেখে তাঁর ইচ্ছা জাগলেও শারীরিক প্রতিবন্ধকতা ও দারিদ্র্যের কারণে পেরে ওঠেননি। মাত্র আট বছর বয়সে স্থানীয় বাজারের একটি চায়ের দোকানে কাজ শুরু করেন। সেখানে বঞ্চনা সহ্য করতে না পেরে পরে কাঠের আসবাব তৈরির একটি দোকানে কাজে যোগ দেন। কিন্তু সেখানেও প্রতিবন্ধকতার কারণে ক্রেতাদের অবহেলার পাত্র হতে হয়। বছর পাঁচেক পর মনঃকষ্টে সেখান থেকে বাড়ি ফিরে আসেন।

এর মধ্যে অবাক করার মতো একটি ঘটনা ঘটে বলে দাবি করেন তমজিদের বড় ভাই তৌহিদ মিয়া। তিনি বলেন, তমজিদের বয়স যখন প্রায় ১৫, তখন এক রাতে হঠাৎ ঘুমের মধ্যে চিৎকার দিয়ে ওঠেন। এরপর শুরু করেন কান্না। পরদিন সকালে তাঁর প্রতিবেশী এক বন্ধুর কাছ থেকে কাগজ-কলম এনে বাড়িতে বসে ছবি আঁকা শুরু করেন তমজিদ। এর কিছুদিন পর থেকে নিজে নিজেই বাংলা লেখা শুরু করেন। এমন প্রতিভা দেখে পরিবারের লোকজন তাঁকে রংতুলি কিনে দেন। এর পর থেকে তমজিদ দক্ষতার সঙ্গে রংতুলির কাজ করে যাচ্ছেন।

তৌহিদ মিয়া বলেন, ‘আমার ভাই (তমজিদ) কুনো দিন ইশকুলে গেছে না, কারও কাছে কুনো লেহাপড়াও শিখছেন না। হে নিজে থেইকাই আল্লাহর রহমতে ম্যালা প্রাকৃতিক দৃশ্য, পশুপাখি সবকিছুই আহন (আঁকা) শিখছে এবং লেহাপড়া সবই পারে। এটা আল্লাহর দান। আকার-ইঙ্গিতে বুঝাইয়া দিলে হে সবকিছু সহজে বুইজ্জা নেয়।’

তমজিদ উদ্দিনের শিল্পকর্ম দেখে যে কেউ অভিভূত হবে বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দাদের কয়েকজন। উপজেলার বাগজান এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী ফয়েজ আহম্মদ বলেন, ‘তাঁকে (তমজিদ) দিয়ে আমরা অনেক কাজ করিয়েছি। উপজেলা প্রশাসন থেকে শুরু করে বিভিন্ন অফিস-আদালত, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, বাসাবাড়ির বেশির ভাগ নান্দনিক কাজই তাঁর হাত দিয়ে আঁকা বা লেখা। এই তুলির আঁচড়ে তিনি পাঁচ সদস্যের সংসার চালাচ্ছেন। ডিজিটাল প্রিন্টিংয়ের যুগে রংতুলির কাজ এখন অনেকটাই কমে যাওয়ায় তমজিদের আয়ও কমে যাচ্ছে। তবু তিনি কারও কাছে কোনো সাহায্যের জন্য হাত পাতেন না।’

তমজিদ উদ্দিনের শিল্পকর্ম দেখে মুগ্ধ ও অভিভূত হওয়ার কথা জানান মদন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অলিদুজ্জামান। তিনি বলেন, তমজিদ উদ্দিন প্রতিবন্ধিতাকে জয় করেছেন। তাঁরা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই সরকার থেকে প্রতিবন্ধী ভাতা পাচ্ছেন। তমজিদের কোনো সহযোগিতার প্রয়োজন হলে উপজেলা প্রশাসন পাশে থাকবে।

সূত্র: প্রথম আলো

সর্বশেষ: