বুধবার, ২১ মে ২০২৫, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ইসলামিক জীবন

কুরবানি কবুল হওয়ার শর্ত

কুরবানি কবুল হওয়ার শর্ত

সংগৃহীত

কুরবানি গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত। যুগে যুগে সব নবীর উম্মতের ওপর কুরবানি করার বিধান ছিল। তবে আমাদের ওপর যে কুরবানি ওয়াজিব, তা মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.) এর সুন্নাত। এই কুরবানি আল্লাহ তায়ালার কাছে কবুল হওয়ার জন্য কিছু শর্তের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে।

১. বিশুদ্ধ নিয়ত: কুরবানির অন্যতম প্রধান শর্ত হলো বিশুদ্ধ নিয়ত। মুসলমানদের কুরবানি কেবল আল্লাহর সান্নিধ্য ও সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে করতে হবে। 

নিয়ত হলো- কাজের আন্তরিকতার বহিঃপ্রকাশ, যা কুরবানির পূর্ণতার জন্য অপরিহার্য। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘এগুলোর (কুরবানির পশুর) গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না। কিন্তু পৌঁছে তাঁর নিকট তোমাদের মনের তাকওয়া।’ (সুরা হজ, আয়াত: ৩৭) 

সুতরাং লোক-দেখানো মনোভাব, গোশত খাওয়া, নিজের আভিজাত্যের প্রকাশ প্রভৃতি নিয়তে কুরবানি বৈধ হবে না।

২. হারাম পরিহার: কুরবানি করতে হবে হালাল সম্পদ থেকে। হারাম মিশ্রিত সম্পদের বিনিময়ে ক্রয়কৃত পশুর কুরবানি আল্লাহর নিকট কবুল হবে না। 

হাদিস শরিফে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা পবিত্র, তিনি কেবল পবিত্র জিনিসই কবুল করেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৩৯৩) 

কুরবানিতে শরিক নেওয়ার ক্ষেত্রেও তাই সতর্ক থাকতে হবে। যদি কারো ব্যাপারে নিশ্চিত জানা যায় যে, সে হারাম সম্পদ থেকে কুরবানি করছে, তাহলে এমন ব্যক্তির সঙ্গে এক পশুতে কুরবানি করা যাবে না। শরিয়তের দৃষ্টিতে এমন লোকের কুরবানি এবং তার সঙ্গে অন্যান্য শরিকদের কুরবানিও কবুল হবে না।

৩. পশুর প্রকার: কুরবানির পশু হতে হবে ‘বাহিমাতুল আনআম’ অর্থাৎ গৃহপালিত চতুষ্পদ জন্তু। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কুরবানি নির্ধারণ করেছি, যেন তারা আল্লাহর দেওয়া চতুষ্পদ জন্তু জবাই করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে।’ (সুরা হজ, আয়াত: ৩৪) 

চতুষ্পদ জন্তুর অন্তর্ভুক্ত হলো উট, গরু, মহিষ, বকরি, ভেড়া ও দুম্বা। এগুলো ব্যতীত অন্য কোনো প্রকার পশু দ্বারা কুরবানি বৈধ হবে না। (কাজিখান: ৩/৩৪৮) 

৪. পশুর বয়স: কুরবানি বৈধ হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট বয়সের পশু জবাই করা আবশ্যক। হজরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা মুসিন্না (৫ বছর বয়সী উট, ২ বছর বয়সী গরু এবং ১ বছর বয়সী বকরি) ব্যতীত জবাই করো না। যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে ৬ মাস বয়সী ভেড়া বা দুম্বা।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৯৬৩) 

সুতরাং উটের বয়স কমপক্ষে পাঁচ বছর, গরু ও মহিষের বয়স দুই বছর, বকরি, ভেড়া ও দুম্বা কমপক্ষে এক বছর বয়সী হতে হবে। তবে ছয় মাসের ভেড়া ও দুম্বা যদি এতটা হৃষ্টপুষ্ট হয় যে, দেখতে এক বছর বয়সী মনে হয়, তাহলে এমন ভেড়া ও দুম্বা দ্বারা কুরবানি করা জায়েজ। তবে বকরি যতই হৃষ্টপুষ্ট হোক, তা এক বছর বয়সী হওয়া বাধ্যতামূলক। (বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২০৫)

৫. পশুর স্বাস্থ্য: কুরবানির পশু হৃষ্টপুষ্ট হওয়া উত্তম। (মুসনাদে আহমাদ: ৬/১২৩) কুরবানির পশুতে তাই এমন কোনো ত্রুটি থাকা চলবে না, যা তার স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে বা তার মূল্য ও গুণগতমান কমিয়ে দেয়। 

সুতরাং পশুটি যেন অন্ধ বা একচোখা না হয়, স্পষ্ট কোনো রোগে আক্রান্ত না হয়, এমন পঙ্গু না হয় যে হাঁটতে অক্ষম, কিংবা এতটাই দুর্বল না হয় যে তার শরীরে মজ্জা থাকে না, অর্ধেকের বেশি যেন লেজ ও কান কাটা না হয়, মুখের অধিকাংশ দাঁত যেন অবশিষ্ট থাকে, শিং যেন গোঁড়া থেকে ভেঙে না যায় (তবে জন্মগতভাবে শিং না উঠলে সমস্যা নেই)। এসব শর্ত ঠিকঠাক আছে এমন পশু দ্বারাই কেবল কুরবানি করা বৈধ। (জামে তিরমিজি, হাদিস: ১৪৯৭)

৬. কুরবানির সময়: নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কুরবানি করা আবশ্যক। কুরবানির সময় শুরু হয় ঈদুল আজহার নামাজের পর থেকে এবং তা অবশিষ্ট থাকে ১২ তারিখ সূর্যাস্ত পর্যন্ত। (হিন্দিয়া: ৫/২৯৫) এর আগে বা পরে কুরবানির পশু জবাই করলে তা দ্বারা কুরবানি আদায় হবে না। 

হজরত বারা ইবনে আজেব (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘ইদের দিন আমরা প্রথমে নামাজ আদায় করব, অতঃপর ফিরে এসে কুরবানি করব। যে ব্যক্তি এভাবে আদায় করবে, সে আমাদের নিয়ম মতো করল। আর যে নামাজের আগেই জবাই করল, এটা তার পরিবারের জন্য গোশত হবে। কুরবানি হবে না। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৯৬৫)

৭. কুরবানির পদ্ধতি: কুরবানির পশু অবশ্যই ইসলামি শরিয়ত অনুযায়ী জবাই করতে হবে। জবাইকারীর মুসলমান হওয়া এবং আল্লাহর নামে জবাই করা আবশ্যক। 

এছাড়া ব্যবহৃত ছুরি বা যন্ত্রপাতি ধারালো হতে হবে, যাতে পশুর কষ্ট কম হয়। কুরবানির পশু নিজ হাতে জবাই করা উত্তম। তবে অন্যকে দিয়েও জবাই করাতে পারবে। এক্ষেত্রে কুরবানিদাতা পুরুষ হলে জবাইয়ের সময় সেখানে উপস্থিত থাকা উত্তম। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস: ২২৬৫৭)

শর্তগুলো জানা কেন গুরুত্বপূর্ণ: কুরবানির শর্তগুলো জানা একজন মুসলমানকে সঠিকভাবে কুরবানি করতে সহায়তা করে, যা আল্লাহর দরবারে তা কবুল হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ায়। একজন মুসলমান যখন এসব শর্ত যথাযথভাবে মানে, তখন তা প্রমাণ করে, সে ইসলামের বিধান সম্পর্কে গভীরভাবে সচেতন এবং তা সঠিকভাবে পালনের জন্য আন্তরিক। এসব শর্ত মানা শুধু কুরবানির গ্রহণযোগ্যতার জন্যই নয়, বরং ইসলামি শিক্ষার প্রতি একজন মুসলমানের শ্রদ্ধা ও তা বাস্তবায়নে আন্তরিক চেষ্টারও প্রতিফলন।

দুটি পরামর্শ

১. আগেভাগে জানা-বোঝা: কুরবানির পশু কেনার আগে সকল শর্ত সম্পর্কে জেনে নিন এবং নিশ্চিত হোন যে আপনি যে পশুটি বেছে নিচ্ছেন তা এসব শর্ত পূরণ করে। কারণ জেনেবুঝে সম্পাদিত কোনো আমল এবং না জেনে অন্ধের মতো পালন করা কোনো আমল কখনো সমপর্যায়ের হতে পারে না। 

আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘(হে নবি) আপনি বলুন, যারা জানে এবং যারা জানে না; তারা কি সমান হতে পারে? চিন্তাভাবনা কেবল তারাই করে, যারা বুদ্ধিমান।’ (সুরা জুমার, আয়াত: ০৯)

২. আলেমদের পরামর্শ: যদি কোনো পরিস্থিতিতে কুরবানির শর্ত নিয়ে দ্বিধায় থাকেন, তাহলে নির্ভরযোগ্য আলেম বা ইসলামি প্রতিষ্ঠান থেকে পরামর্শ নিতে দ্বিধা করবেন না। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘অতএব তোমরা জ্ঞানীদের জিজ্ঞেস করো, যদি তোমাদের জানা না থাকে।’ (সুরা নাহল, আয়াত: ৪৩)

সূত্র: যুগান্তর

সর্বশেষ: