
সংগৃহীত
দেশে বছর বছর বাড়ছে ভুট্টার উৎপাদন। মূলত ধানের চেয়ে দাম বেশি পাওয়ায় ভুট্টা চাষে আগ্রহ বাড়ছে কৃষকের। তা ছাড়া ভুট্টা আবাদে পানি ও কীটনাশক লাগে কম। স্বল্প পরিচর্যায় উচ্চ ফলনের কারণে দেশের উত্তরাঞ্চলে ভুট্টার জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে। এতে পশুখাদ্য তৈরির অপরিহার্য এ উপাদানের আমদানিও কমছে। দেশের উৎপাদিত ভুট্টার ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে ৮০ হাজার কোটি টাকার প্রাণিখাদ্য বা ফিডশিল্প।
খাত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বেশি লাভ ও নিশ্চিত বাজার তৈরি হওয়ায় দেশে ধান ও গমের বদলে ভুট্টার আবাদ বাড়ছে। মূলত উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় ধান ও গম চাষের বদলে কৃষকেরা এখন ভুট্টা চাষে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। আর দেশে উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় আমদানিও কমছে। ভুট্টাকে কেন্দ্র করে এরই মধ্যে দেশের উত্তরাঞ্চলে নতুন একটি উদ্যোক্তা শ্রেণিও তৈরি হয়েছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, গত এক দশকে দেশে ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। ২০১৫–১৬ অর্থবছরে ভুট্টার উৎপাদন ছিল ২৭ লাখ ৫৯ হাজার টন। এক দশকের ব্যবধানে গত ২০২৩–২৪ অর্থবছরে এই উৎপাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৮ লাখ ৮৪ হাজার টনে। পাঁচ বছর আগে অর্থাৎ ২০২০–২১ অর্থবছরে ভুট্টার উৎপাদন ছিল ৫৬ লাখ ২৭ হাজার টন। যদিও চলতি ২০২৪–২৫ অর্থবছরে বিরূপ আবহাওয়ার কারণে এখন পর্যন্ত উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৬৬ লাখ টন।
উৎপাদনের পাশাপাশি ভুট্টা চাষে আবাদি জমির পরিমাণও বেড়েছে। চলতি ২০২৪–২৫ অর্থবছরে ভুট্টার আবাদ হয়েছে ৫ দশমিক ৭৮ লাখ হেক্টর জমিতে। অথচ ২০১১–১২ অর্থবছরে ভুট্টার আবাদি জমির পরিমাণ ছিল মাত্র ২ দশমিক ৮৩ লাখ হেক্টর। এক দশক আগে ২০১৪–১৫ অর্থবছরে ভুট্টার আবাদ হয়েছিল ৩ দশমিক ৫৫ লাখ হেক্টর জমিতে।
কৃষি অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, কৃষক লাভ যেখানে বেশি দেখবেন, সেখানেই আগ্রহ বেশি দেখাবেন, এটাই স্বাভাবিক। এ বিষয়ে কৃষি অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএলআরআই) সাবেক মহাপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম খান প্রথম আলোকে বলেন, ভুট্টা উৎপাদন করে ধান কিংবা গমের চেয়ে কৃষক বেশি নগদ অর্থ পাচ্ছেন। আবার ভুট্টার একটা নিশ্চিত বাজারও রয়েছে দেশে। তা ছাড়া ভুট্টার উৎপাদনশীলতাও বেশি। কৃষকের জন্য লাভজনক হওয়ায় ধানের জমিতেও তাঁরা ভুট্টা চাষে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছেন। উৎপাদনের এই ধারা অব্যাহত থাকলে কয়েক বছরের মধ্যে দেশের চাহিদার পুরোটাই জোগান দিতে পারবে দেশে উৎপাদিত ভুট্টা। তখন আর আমদানির দরকার হবে না।
খাত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, দেশে ভুট্টার বার্ষিক চাহিদা ৭০–৭৫ লাখ টন, যার বেশির ভাগই স্থানীয় উৎপাদনে পূরণ হচ্ছে। আর আমদানিও দিন দিন কমছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২০–২১ অর্থবছরে দেশে ভুট্টার আমদানি হয়েছিল ২১ লাখ ১৪ হাজার টন। ২০২৩–২৪ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে ৪ লাখ টনে। তবে প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে চলতি অর্থবছর দেশে উৎপাদন কিছুটা কম হওয়ায় এখন পর্যন্ত আমদানি বেড়ে ১৪ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে।
খাত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশে ভুট্টার বাজার তৈরি হয়েছে মূলত প্রাণিখাদ্য বা ফিডশিল্পকে কেন্দ্র করে। গত দেড় দশকে দেশে পশুপালন ও পোলট্রিশিল্প খাতের ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটেছে। ফিডমালিকেরা বলছেন, ক্ষুদ্র খামারিদের বাকিতে প্রাণিখাদ্য সরবরাহ করে এ খাত সম্প্রসারণে ভূমিকা রাখছে ফিডশিল্প। দেশের ফিড খাত এখন ৮০ হাজার কোটি টাকার শিল্পে পরিণত হয়েছে।
কৃষকেরা এখন ভুট্টা উৎপাদনকে ব্যবসা হিসেবে দেখছেন। তাই উত্তরাঞ্চলে গমের জমিতে ভুট্টা চাষ বাড়ছে। দেশে আমদানি করা উচ্চফলনশীল ভুট্টার জাতগুলো বেশি জনপ্রিয়। আমাদের নিজস্ব দুটি জাত থাকলেও সীমাবদ্ধতার কারণে আমরা যথেষ্ট বীজ সরবরাহ করতে পারছি না।
মো. আবদুল্লাহ আল মামুন, প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, গবেষণা বিভাগ, বিডব্লিউএমআরআই।
এ খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, নগদ অর্থে বাজার থেকে শতভাগ ভুট্টা কিনে নিচ্ছে ফিড কারখানাগুলো। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাবে, দেশে এখন নিবন্ধিত ফিড মিল বা প্রাণিখাদ্য প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ৩০০। এ খাতের সংগঠন ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাবেক সভাপতি ও কোয়ালিটি ফিডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এহতেশাম বি শাহজাহান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এখন শতভাগ ভুট্টা নগদ টাকায় কিনে নিচ্ছি। আমাদের মোট চাহিদার ৭০ ভাগ স্থানীয় বাজার থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে। বাকি ৩০ শতাংশ ভুট্টা আমদানি করতে হচ্ছে। তবে উৎপাদন যত বাড়ছে, আমদানির পরিমাণও তত কমছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রারও সাশ্রয় হচ্ছে। আর ভুট্টার ভালো দাম পেয়ে কৃষকও খুশি।’ তবে এখন ডিম–মুরগির যথাযথ দাম না পেয়ে খামারিরা নিরুৎসাহিত হচ্ছেন বলে জানান তিনি।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশের উত্তরাঞ্চলেই সবচেয়ে বেশি ভুট্টার চাষ হয়। দেশে ভুট্টা উৎপাদনে শীর্ষ ১০ জেলা হচ্ছে দিনাজপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট, রংপুর, পঞ্চগড়, নীলফামারী, ঝিনাইদহ, জামালপুর ও গাইবান্ধা।
কৃষকেরা বলছেন, ভুট্টা চাষে পরিচর্যা কম করতে হয়। যেকোনো উঁচু জায়গায় চাষ করা যায়। ফলনও বেশি। আবার মাড়াইপ্রক্রিয়াও বেশ সহজ। বালাইনাশকের প্রয়োজনীয়তাও কম।
দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার কৃষক রশিদুল ইসলাম এবার তিন বিঘা জমিতে ভুট্টা চাষ করেছেন। প্রথম আলোকে তিনি জানান, বীজ, সার, বালাইনাশক, শ্রমিকসহ বিঘাপ্রতি ভুট্টা চাষে তাঁর খরচ হয়েছে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। উৎপাদন হয়েছে প্রতি বিঘায় ৬৫ থেকে ৭৫ মণ। প্রতি মণ ভুট্টা বিক্রি করেছেন ৮৭০ টাকায়। তাতে প্রতি বিঘায় তিনি পেয়েছেন ৬০ থেকে ৬৫ হাজার টাকা।
রশিদুল ইসলাম জানান, ভুট্টার বদলে তিনি যদি ধান চাষ করতেন, তাহলে বিঘাপ্রতি বড়জোর ৪০ মণ ধান পেতেন। তাতে বিঘাপ্রতি আয় হতো ৪০ হাজার টাকা। যেখানে ভুট্টা চাষ করে তিনি ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা বেশি পেয়েছেন। তাই এলাকার অনেকেই এখন ধানের বদলে ভুট্টা চাষ করছেন।
চাষের পাশাপাশি ভুট্টা ব্যবসায় যুক্ত দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার আসেফ রহমান। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘ধানে বিঘাপ্রতি ৩০ হাজার টাকা ব্যয় করে ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা পাওয়া যায়। কিন্তু ভুট্টায় বিঘাপ্রতি ২০–২৫ হাজার টাকা খরচের বিপরীতে পাওয়া যায় ৬৫ হাজার টাকার মতো। আবার ধান চাষের চেয়ে ভুট্টা চাষে পরিশ্রমও কম। ফলে ধানের চেয়ে কৃষকদের কাছে ভুট্টা চাষ অনেক বেশি লাভজনক। উৎপাদন বাড়তে থাকায় আমার মতো অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী গড়ে উঠেছেন ভুট্টাকে কেন্দ্র করে। যাঁরা কৃষকের কাছ থেকে ভুট্টা কিনে ফিড কোম্পানির কাছে বিক্রি করেন।’
উচ্চফলনশীল ভুট্টার জাত ও প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিডব্লিউএমআরআই)। প্রতিষ্ঠানটির গবেষণা বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আবদুল্লাহ আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘কৃষকেরা এখন ভুট্টা উৎপাদনকে ব্যবসা হিসেবে দেখছেন। তাই উত্তরাঞ্চলে গমের জমিতে ভুট্টা চাষ বাড়ছে। দেশে আমদানি করা উচ্চফলনশীল ভুট্টার জাতগুলো বেশি জনপ্রিয়। আমাদের নিজস্ব দুটি জাত থাকলেও সীমাবদ্ধতার কারণে আমরা যথেষ্ট বীজ সরবরাহ করতে পারছি না।’
ভুট্টার উৎপাদনপ্রক্রিয়ার বিষয়ে আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, অন্য ফসলের তুলনায় ভুট্টা চাষে পানি কম লাগে। উত্তরাঞ্চলের যেসব এলাকায় পানির সমস্যা বেশি, সেখানে ভুট্টার চাষ বাড়ছে। তা ছাড়া ধানের তুলনায় বালাইনাশকও কম লাগে। তবে এবার মাড়াইয়ের সময় টানা বৃষ্টির কারণে ফলন কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সূত্র: প্রথম আলো