
সংগৃহীত
একসময় রাজবাড়ীর কালুখালী উপজেলার মৃগী ও বোয়ালিয়া ইউনিয়নে সকাল শুরু হতো তাঁতের শব্দে। টুক টুক করে বাজত কাঠের সাঁড়াশির মতো তাঁত মেশিন। শত শত পরিবার জীবিকা নির্বাহ করত এ শিল্পকে ঘিরে। তাঁত ছিল শুধু জীবিকা নয়, ছিল সংস্কৃতি, ছিল পরিচয়। কিন্তু সময় বদলে গেছে, আর বদলে গেছে জীবনের গতি। আজ এই ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্প দাঁড়িয়ে আছে বিলুপ্তির মুখে।
ব্যয়বহুল হাতে তৈরি তাঁতের শাড়ি আজ প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। তাঁতিরা পাচ্ছেন না ন্যায্য মূল্য, নেই সঠিক বিপণন ব্যবস্থা। যন্ত্রের দাপটে হারিয়ে যাচ্ছে হাতের শিল্প। যেখানে একসময় শতশত তাঁত কাজ করত, এখন হাতে গোনা কয়েকটি মাত্র। বর্তমান সময়ে লুঙ্গি-গামছা তৈরির সুতা এবং কাঁচামালের দাম বৃদ্ধিসহ যথাযথ কর্তৃপক্ষের পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে বন্ধ হতে চলেছে ঐতিহ্যবাহী হস্তচালিত তাঁতশিল্প। এর ফলে তাঁতিরা এখন তাদের পেশা ছেড়ে দিয়ে প্রবাসে চলে যাচ্ছেন, নয়তো অন্য কোনো পেশায় সম্পৃক্ত হয়েছেন। আর নতুন প্রজন্ম মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, কারণ এ পেশায় ভবিষ্যৎ ও নিশ্চয়তা নেই।
কালুখালী উপজেলার বোয়ালিয়া ইউনিয়নের চরচিলোকা গ্রামের তাঁত শ্রমিক রফিকুল বিশ্বাস (৫৫) কালবেলাকে বলেন, আমার জন্মের পর থেকেই এ কাজ দেখে আসছি। আমার দাদা ও বাবা করত, এখন আমিও করি। এ পেশাটা ৩০-৩৫ বছর আগে খুব ভালো চলত, এখন আর সে রকম চলে না। আগে চারটা গামছা বানালে ১৫০ টাকা ইনকাম হতো, এখন ১০০ টাকা হয়। এখন এ কাজ প্রায় সবাই বাদ দিয়ে দিচ্ছে। গ্রামে আগে প্রায় ২০০ লোক এই কাজ করত, এখন ৮-১০ জন এর সাথে সম্পৃক্ত আছে। এখন কেউ কৃষি কাজ করে, ভ্যান চালায় কিংবা বিদেশ চলে গেছে। অনেকেই বৈদ্যুতিক মেশিন দিয়ে এ কাজ করলেও আমাদের তো সেই সামর্থ্য নেই। একটা মেশিনের দাম দুই লাখ টাকা।
আরেক তাঁত শ্রমিক নুরুজ্জামান মিয়া (৪৫) জানান, বাপ-দাদার আমল থেকে এ কাজ করে আসতেছি। এটা আমাদের জাতি ব্যবসা, তবে এ পেশায় আমরা ভালো নেই। একজন দিনমজুরও দিনে ৫০০-৭০০ টাকা আয় করে আর আমরা ৩০০ টাকা। তারপর সুতা ও রংয়ের দাম অনেক বেশি। সরকার যদি এদিকে একটু নজর দিত তাহলে আমরা স্ত্রী-সন্তান নিয়ে চলতে পারতাম।
এ বিষয়ে কালুখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মহুয়া আফরোজ কালবেলাকে বলেন, ‘তাঁতশিল্প বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ইতিহাসের অংশ। এটি এদেশের মানুষের জীবন ও জীবিকার সঙ্গে জড়িত। একটা সময় দেশের অনেক মানুষ এ শিল্প নিয়ে কাজ করত। কালুখালীতেও একটা বড় জনগোষ্ঠী তাঁত নিয়ে কর্মব্যস্ত সময় কাটাত। তবে এখন সেই সংখ্যা খুবই সীমিত। আমরা এরইমধ্যে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি, কালুখালী উপজেলার মৃগী ও বোয়ালিয়া ইউনিয়নে কিছু লোক এখনও এ পেশার সঙ্গে জড়িত। তাদেরকে স্বল্পসুদে ঋণের ব্যবস্থা করতে কাজ করছি।
তিনি বলেন, এখন সবাই বৈদ্যুতিক মেশিন দিয়ে কাজ করছে। যাদের এমন সুবিধা নেই, তারা হাত দিয়ে চালিত মেশিন দিয়ে কাজ করছে। যাদের বৈদ্যুতিক মেশিনের ব্যবস্থা নেই তাদের জন্য একটা পরিকল্পনা করছি। ঐতিহ্যবাহী এ পেশাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য কালুখালী উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে যা কিছু করা সম্ভব আমরা তা করার জন্য সবরকম চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি।
সূত্র: কালবেলা