বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বগুড়ায় ফুল চাষে কৃষকের ভাগ্য বদলের আশা

বগুড়ায় ফুল চাষে কৃষকের ভাগ্য বদলের আশা

বগুড়ায় ফুল চাষ করে ভাগ্য বদলের স্বপ্ন দেখছেন কৃষকরা। এ জেলার চার উপজেলায় ২৭ হেক্টর জমিতে এবার ফুল চাষ হয়েছে। জেলার কৃষি বিভাগ বলছে, প্রতি বছর প্রায় ১৪ কোটি টাকার ফুল বগুড়ার বাজারে কেনাবেচা হয়। ফুলের চাহিদায় বাইরের জেলার ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে উৎপাদন বাড়াতে পারলে একদিকে যেমন কৃষকদের বাড়তি উপার্জনের পথ খুলে যাবে অন্যদিকে জেলার অর্থনীতি শক্তিশালী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলায় ২৭ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন ধরণের ফুলের চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে চায়না, থাইল্যান্ড, দেশী জাতের গোলাপ, দেশি ও হাইব্রিড জাতের রজনীগন্ধা, গ্লাডিওলাস, জারবেরা ডেইজি, বাগান বিলাস, চন্দ্র মল্লিকা, ডালিয়া, কসমস, দোলনচাঁপা, নয়নতারা, মোরগঝুঁটি, কলাবতী এবং গাঁদা। সব মিলে ২০২১-২২ অর্থ বছরে প্রায় ৮৭ লাখ ফুল গাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।

বগুড়ার ফুলচাষীরা জানান, এক বিঘা জমিতে গোলাপ চাষ করলে চারা লাগানো থেকে প্রথমবার ফুল সংগ্রহ পর্যন্ত খরচ পড়বে প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। চারা লাগানোর ৩-৪ মাসের মধ্যেই গাছ ফুল দেওয়া শুরু করে। এরপর টানা ৫-৭ বছর পর্যন্ত ওই জমিতে লাগানো গাছ থেকে ফুল সংগ্রহ করা যায়।

এক বিঘা জমিতে ৪ থেকে ৫ হাজার গোলাপের গাছ লাগানো যায়। প্রতি মাসে বিঘা প্রতি কৃষকের খরচ পড়ে ১০-১৫ হাজার টাকা। গ্রীষ্মকালে গাছ থেকে ফুল বেশি সংগ্রহ করা যায়। ওই সময় এক বিঘা থেকে প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই হাজার ফুল সংগ্রহ যাবে। আর শীতকালে গোলাপ সংগ্রহ কিছুটা কমে যায়। সে সময় প্রতিদিন ৭০০ থেকে ৮০০টি ফুল এক বিঘা বাগান থেকে সংগ্রহ করা যায়।

ফুলচাষীরা জানান, এক বিঘা জমিতে কেউ জারবেরা চাষ করতে চাইলে তাকে শেড এবং চারাসহ খরচ করতে হবে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা। জারবেরা চাষে খরচ বেশি হলেও এর লাভও বেশি। খরচ বেশি হওয়ার প্রধান কারণ জারবেরা বাগানের উপরে পলিশেড দিতে হয়। একটি শেডেই খরচ পড়ে প্রায় ৬ লাখ টাকার মতো। তবে একবার শেড দিলে সেটি ৫ থেকে বছর পর্যন্ত টেকে। জারবেরার চারা লাগানোর ৯০ দিনের মধ্যেই ফুল দেয়। এক বিঘাতে ৪ হাজার গাছ লাগানো যায় এবং ফুল দেওয়া শুরু করলে সেখান থেকে প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৪০০ ফুল উঠানো যায়। ফুলের দাম সব সময় চাষী পর্যায়ে ৫ থেকে ৮ টাকার মধ্যে থাকে। তবে যে কোনো সিজনে তাদের থেকে ফুল ব্যবসায়ীরা ১০-১২ টাকাতেও কেনেন জারবেরা। গোলাপের মধ্যে জারবেরার জমিতেও ফুল আসার পর থেকে মাসে খরচ হয় ১০-১৫ হাজার টাকা। তবে জারবেরা গাছের পরিচর্যা বেশি করতে হয়। গাছে পচন রোগ বেশি মাত্রায় হয়।

বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার মাদলা ইউনিয়নের ফুলচাষী ‘চাষী ফ্লাওয়ার ফার্ম’ এর স্বত্ত্বাধিকারী জান্নাতুল ফেরদৌস জনি বলেন, তিনি গত ১৪ বছর যাবৎ ফুল চাষ করছেন। শখ করে ফুলচাষে এসে এখন সেটাই তার জীবিকা নির্বাহের প্রধান পথ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর আগে তিনি মাছ চাষ করতেন। সাড়ে ৫ বিঘা জমিতে ফুল চাষ করেছেন। এর মধ্যে সাড়ে তিন বিঘা জমিতে গোলাপ এবং দুই বিঘা জমিতে জারবেরা লাগিয়েছেন।

ফুলচাষী জনি বলেন, ফুল চাষ অনেক লাভজনক। গাছ ফুল দেওয়া শুরু করলে সারা বছরই ফুল সংগ্রহ করা যায়। আর বিক্রি তো সব সময়ই হয়। তবে গোলাপ ফুল গ্রীষ্মকালে সংগ্রহ বেশি করা যায় সে সময় দাম ১ টাকা পিস বিক্রি করা যায়। আর শীতকালে ৪-৫ টাকা প্রতি পিছ গোলাপ বিক্রি যায়। সব মিলিয়ে মাসে ১ বিঘা জমি থেকে ৪০ হাজার টাকার বেশি উপার্জন হয়।

অন্যদিকে জারবেরা এক বিঘা জমিতে ৪ হাজার গাছ লাগানো যায়। সেখান প্রতিদিন ৩-৪শ ফুল উঠানো হয়। ফুলের দাম সব সময় ৫-৮ টাকা পিস থাকে। তবে মাঝে মধ্যে ১০-১২ টাকা পিসও বিক্রি হয়। সে অনুযায়ী জমির খরচ বাদ দিয়ে এক বিঘা জমি থেকে মাসে ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা চাষীর পকেটে থাকবে।

সফল এই ফুলচাষী আরো জানান, তিনি ‘চাষী ফ্লাওয়ার ফার্ম’ থেকে ফুলচাষ নিয়ে ট্রেনিং সেন্টার খুলতে চান। যেখান থেকে শিক্ষিত বেকার যুবক যারা ফুলচাষে আগ্রহী তারা প্রশিক্ষণ নিয়ে সফলভাবে ফুলের উৎপাদন বাড়াবেন। তারা যদি ফুল বাজারে বিক্রি করতে না পারে সেক্ষেত্রে তিনি সেগুলোর বিক্রির সুযোগ করবেন।

ফুলচাষী গোলাম রব্বানী জানান, যদি কেউ ফুল চাষ করে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে চায় তবে সর্বপ্রথম তাকে পরিশ্রম করার মানসিকতা থাকতে হবে। এরপর যেটা দরকার সেটা হলো তাকে এ বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করতে হবে। জানতে হবে। মাঠে গিয়ে মাটির সঙ্গে মিশতে হবে। তাকে ধৈর্যশীল হতে হবে।

তিনি বলেন, আমি ২০১৮ সাল থেকে ফুলচাষে সম্পৃক্ত। ফুলচাষ আসলেই অনেক লাভজনক। আমি পরিশ্রম এবং ধৈর্য ধরেই ফুলচাষ এবং ব্যবসা করে যাচ্ছি। করোনাকালীন সময়ে গত ২ বছর আমার তেমন ব্যবসা হয়নি। সে সময় প্রতিদিন গড়ে এক থেকে দেড় হাজার ফুল নষ্ট হয়েছে। এরপরও হাল ছাড়িনি। ধৈর্য্য ধরে এখনও করে যাচ্ছি।

বগুড়ার ফুল ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক লক্ষণ দাস অমিত বলেন, বগুড়ার ফুল মার্কেটে ১৭টি দোকান রয়েছে। সাধারণত বিভিন্ন জাতের গোলাপ, রজনীগন্ধা, জারবেরা, গ্লাডিওলাস, গাদা ফুল তারা বগুড়া এবং বাইরের জেলা থেকে নিয়ে আসেন। বগুড়ায় যে পরিমাণ ফুল উৎপাদন হয় তা প্রয়োজনের তুলনায় কম। যে কারণে যশোর, ঝিনাইদহের ফুলই বেশি বাজারে। ফুল মার্কেটের ১৭টি দোকানে মাসে ৮৫ লাখ টাকার ফুল কেনাবেচা হয়। এই ফুলগুলো সাধারণত বিয়ে বাড়ি, বিভিন্ন অফিয়াল অনুষ্ঠানের স্টেজ সাজানো, ফুলের তোড়া হিসেবে বিক্রি হয়। তবে আর্টিফিসিয়াল ফুলের কারণে বর্তমানে তাদের ব্যবসা পরিচালনা করা অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে।

বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিপরিচালক (শস্য) এনামুল হক বলেন, বগুড়া জেলা ফুল চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী আবহাওয়া এবং মাটি বিদ্যমান রয়েছে। এই জেলা ফুলচাষে যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে এবং জেলায় ফুলচাষের জমিও বাড়ছে। বগুড়ায় ফুলের প্রচুর চাহিদা রয়েছে।

তিনি বলেন, বগুড়া সবজি প্রাধান্য এলাকা এরপরও আমরা ফুলচাষে কৃষকদের উৎসাহিত করছি। কারণ ফুলচাষ করলে কৃষকদের অনেক বেশি লাভবান হওয়ার সুযোগ আছে। বগুড়ার সদর শিবগঞ্জ, শাজাহানপুর এবং শেরপুর উপজেলায় বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষ করছেন কৃষকরা। আমাদের রাজশাহী বিভাগের একটি প্রকল্প চলমান আছে। এর মাধ্যমে গত বছর ফুলচাষের জন্য প্রায় ১০টি প্রদর্শনী করা হয়েছে।

দৈনিক বগুড়া