বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বগুড়ার বেস্ত রপ্তানি করে বছরে আয় ২৪ কোটি টাকা

বগুড়ার বেস্ত রপ্তানি করে বছরে আয় ২৪ কোটি টাকা

কাতার বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর বিশেষ সম্মান দেখিয়ে লিওনেল মেসির গায়ে একটি কালো আলখাল্লা পরিয়ে দেন দেশটির আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি। এরপরই আলোচনায় আসে বিশেষ এই পোশাকটি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, কাতার, দুবাইসহ বিভিন্ন দেশের রাজা, বাদশাহ ও শেখদের পরিহিত রাজকীয় এই পোশাকটির নাম ‘বেস্ত’। এটি আভিজাত্য ও সম্মানের প্রতীক। তবে এই পোশাকটি অনেক আগে তৈরি হচ্ছে বগুড়া সদরের এরুলিয়া ইউনিয়নের হাপুনিয়া গ্রামে। ‘বেস্ত আল-নুর এন্টারপ্রাইজ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান পোশাকটি তৈরি করছে। মান অনুযায়ী একেকটি বেস্তের দাম ৮০ হাজার দুই লাখ টাকা পর্যন্ত। তবে চাহিদা অনুসারে এর চেয়ে কম দামেও পাওয়া যায়।

প্রায় ১৩ বছর আগে বগুড়া সদরের এরুলিয়া হাপুনিয়া এলাকায় নিজ বাড়িতে ‘বেস্ত আল-নুর এন্টারপ্রাইজ’ নামের কারখানাটি গড়ে তোলেন নুর আলম নামের এক প্রবাসী। কাতারসহ বিভিন্ন আবর দেশের চাহিদা অনুযায়ী কারখানায় তিনি বেস্ত তৈরি করেন। তার কারখানায় দিনরাত কাজ করে কর্মীরা। বিদেশি কাপড়ে হাতের কাজের নকশায় তৈরি করা বেস্ত। বর্তমানে কারখানাটিতে নারী-পুরুষ মিলে ৩০ জন শ্রমিক কাজ করেন।

যেভাবে তৈরি হয় ‘বেস্ত’

একটি বেস্ত তৈরি করতে সাতটি ধাপ পার করতে হয়। প্রথমে বাতানার কাজ করতে হয়। এরপরে জরির কাজ। যাকে বলা হয় ‘হেলা’। পরের ধাপগুলো হলো তুক্ত স্রিপ, ব্রুজ, মাসকার, বরদাক ও সিলালা। এরপরই তৈরি হয় একটি ‘বেস্ত’।

একটি বেস্ত তৈরি করতে সাত কারিগরের সাতদিন সময় লাগে। আরবের বাদশাহ ও আমিরদের জন্য স্বর্ণখচিত জরির বেস্ত, অভিজাত ও মধ্যবিত্তের জন্য সাধারণ বেস্ত এবং নারীদের জন্য বোরকার আদলে তৈরি করা হয় ‘আভায়া’। এসব পোশাক তৈরিতে আরব দেশের আবহাওয়ার উপযোগী যে বিশেষ ধরনের কাপড় ব্যবহৃত হয়, তা উৎপাদিত হয় জাপানে। প্রয়োজন হয় স্বর্ণখচিত জরি। এটি উৎপাদন করে সৌদি আরব। ভারতীয় জরিও ব্যবহৃত হয় তুলনামূলক কম দামের পোশাকে।

রাজকীয় এই পোশাকের কাঁচামাল পুরোটায় আমদানিনির্ভর। এর মধ্যে সৌদি আরব থেকে জাপানি থ্রেট কটন কাপড় ও স্বর্ণখচিত জরি, দুবাই থেকে দুবাই আল মানি জরি ও ভারত থেকে জরি আমদানি করতে হয়।

সৌদি আরব থেকে জাপানি থ্রেট কাপড় আমদানি করতে প্রতি গজে খরচ ২০০ থেকে ৪০০ টাকয়া। এছাড়া আল মানি গোল্ড ৫ দশমিক ৫ জরি প্রতি কেজি আমদানিতে লাগে প্রায় দুই লাখ টাকা। এক কেজি দুবাই আল মানি জরি ৮৮ হাজার ৮০০ টাকা এবং ভারতীয় জরি আমদানিতে ২০ হাজার টাকা গুনতে হয়। বৈশ্বিক মন্দায় এই দাম কিছুটা বেড়েছে।

দেশে চাহিদা কেমন

বগুড়ার এই কারখানা থেকে সিজনে প্রতি মাসে গড়ে প্রায় দুই কোটি টাকার পোশাক বিক্রি করা হয়। এ হিসেবে প্রতি বছর গড়ে ২৪ কোটি টাকার পোশাক বিক্রি করা হয়। তবে বিশেষ এই পোশাকের বাংলাদেশে কোনো চাহিদা নেই। সবগুলো পোশাকই যায় সৌদি আরবে কিংবা কাতারে।

যেভাবে বগুড়ায় বেস্ত তৈরি শুরু

২৭ বছর আগে জীবিকার তাগিদে সৌদি আরবে পাড়ি জমান নুর আলম। সেখানে বেস্ত তৈরির এক কারখানায় কাজ শুরু করেন। সৌদি আরবে বছর পাঁচেক ছিলেন। এর মধ্যেই বেস্ত তৈরিতে দক্ষ হয়ে ওঠেন নুর আলম। পরে সৌদি আরব থেকে কাতারে যান তিনি। সেখানে বেস্ত আল সালেহ নামের প্রতিষ্ঠানে চাকরি শুরু করেন। একপর্যায়ে ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে নিজ জেলায় ফিরে এসে বেস্ত তৈরি করা শুরু করেন নুর আলম। নিজের কারখানায় তৈরি করা বেস্ত ও আভায়া কাতারের বেস্ত আল সালেহ প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করেন। বর্তমানে নুর আলমের বড় ভাই রায়হান আলী ও তোতা মিয়া প্রবাস থেকে ফিরে আলাদাভাবে বগুড়াতেই বেস্ত ও আভায়া তৈরির কারখানা চালু করেছেন।

কারিগররা যা বলছেন

বেস্ত আল-নুর এন্টারপাইজের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই কারিগর হিসেবে কাজ করছেন শাকিল হোসেন। তিনি বলেন, সাধারণত মাসে ৪০-৪৫ পিস বেশত তৈরি করা হয়। এছাড়া প্রয়োজন অনুযায়ী মাসে বেস্ত তৈরির সংখ্যা বাড়ানো হয়। বছর পাঁচেক আগে কারখানায় নারী কারিগর নেওয়া হয়। তারা প্রতি মাসে ১২-১৪ হাজার টাকা আয় করেন। আর পুরুষ কারিগররা আয় করেন ২২-২৪ হাজার টাকা।

তিনি আরও জানান, প্রথমদিকে ১০-১২ জনকে নিয়ে বেস্ত তৈরির প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। তাদের প্রশিক্ষিত করার পর থেকেই এটি তৈরি করে বিভিন্ন দেশে রফতানি শুরু করা হয়।

বেস্ত তৈরি করে সংসারে সচ্ছলতা এসেছে বগুড়া শহরের শিকারপুর পূর্বপাড়ার অনেক নারী-পুরুষের। বগুড়া সদরের এরুলিয়া ইউনিয়নের শিকারপুর পূর্বপাড়ায় মনির হোসেন বলেন, আমাদের এলাকায় এখন অভাব নেই বললেই চলে। যারা হাতের কাজ জানেন বা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন, তারাই এ পোশাক তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।

বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রির সহ-সভাপতি মাফুজুল ইসলাম বলেন, রপ্তানি আয়ের পাশাপাশি ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ লেখা এই পোশাক মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে বাংলাদেশের সুনাম বাড়াচ্ছে। এটা আমাদের জন্য গর্বের ব্যাপার। বগুড়া চেম্বারের পক্ষ থেকে এই ব্যবসায়ীদের সবরকমের সহযোগিতা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

দৈনিক বগুড়া