শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১১ শ্রাবণ ১৪৩১

কাহালুতে তালপাতার পাখার গ্রামে হাতপাখা তৈরীর কাজে ব্যস্ত সবাই

কাহালুতে তালপাতার পাখার গ্রামে হাতপাখা তৈরীর কাজে ব্যস্ত সবাই

আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্যের একটি অংশ তালপাতা দিয়ে তৈরী হাতপাখা। বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতিতে এ পাখার বিশেষ ভুমিকা রয়েছে যুগ যুগ ধরে। গ্রীষ্মের প্রচন্ড গরম ও কাঠফাটা তাপদাহে স্বামী যখন মাঠ থেকে কাজ শেষ করে ওষ্ঠাগত হয়ে বাড়ি ফিরতেন, তখন বাঙালি বধু হাতপাখা দিয়ে বাতাস করে তাকে স্বস্তি দান করতেন। সংসার জীবনে গ্রামের মানুষের সীমাহীন কষ্ট আর অপ্রাপ্তিকে পিছনে ফেলে স্বজনদের মাঝে ভালোবাসার এই ক্ষুদ্র বিনিময় সংসারগুলোকে করে তুলতো অনেক বেশী প্রাণবন্ত আর শান্তিময়।

তালপাতা দিয়ে তৈরী হাতপাখার বাতাসে মাঠের তপ্ত শরীরই কেবল জুড়াত না, পারস্পারিক অনেক ভাব বিনিময়ও হতো। ভালোভাসার সুদৃঢ় এই বন্ধন বছর থেকে যুগ যুগ ধরে বহুযুগের যুগলবন্দীত্বে প্রবর্তনা যোগাত। আবহমান কাল থেকে স্বামীর প্রতি অগাধ ভালোবাসা হিসেবে গণ্য করা হতো এই হাতপাখার বাতাস।

বর্তমানে যান্ত্রিক সভ্যতার যুগে শহর থেকে গ্রামের প্রায় সবখানেই প্রযুক্তির ব্যবহার। মাথার উপর বনবন করে ঘুরছে বৈদ্যুতিক পাখা। আর একটু সময় এগালেই ঘরের জানালা-দরজা বন্ধ করে এসির সুইচ টিপে স্বস্তির খোঁজ মিলছে ঘরে ঘরে। প্রযুক্তির ব্যবহারে প্রাচীন ঐতিহ্যের অনেক কিছুই বিলুপ্তির পথে। প্রাচীন অনেক কিছু বিলুপ্তি হলেও প্রাচীন ঐতিহ্যের একটি অংশ হিসেবে এখনো তালপাতার পাখার ব্যবহার দেশের অনেক অঞ্চলে বহমান। প্রযুক্তির ক্রুটি অথবা বিদ্যুতের লোডসেডিং হলেই হাতপাখাই মানুষের স্বস্তির জন্য একমাত্র ভরসা।

কালের আবর্তনে অনেকাংশেই তালপাতার পাখার ব্যবহার কমলেও বগুড়ার কাহালু উপজেলার তালপাতার গ্রামগুলো গরম পড়ার সাথে সাথে সরগরম হয়ে উঠে। তালপাতার গ্রাম নামে পরিচিত উপজেলার পাইকড় ইউনিয়নের আড়োলা, আতালপাড়া ও যোগীর ভবনে আশ্বিন-কার্তিক মাস বাদে বছরের ১০ মাসই চলে পাখা তৈরী ও উপকরণ সংগ্রহের কাজ। গরম পড়ার সাথে সাথে পাখা কেনার জন্য এখানে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ছুঁটে আসেন পাইকাররা। পাইকারদের চাহিদা মেটাতে এখানে প্রতিটি বাড়িতে সমানতালে চলে তালপাতা দিয়ে হাতপাখা তৈরীর কাজ ।

জানা গেছে এখানে পাখা তৈরীর কাজ শুরু হয় প্রাচীনকাল থেকে। যোগীর ভবনে রয়েছে প্রাচীন আশ্রম ও মন্দির। বগুড়ার ইতিহাসে উল্লেখ রয়েছে এই প্রাচীন আশ্রম ও মন্দির যোগীদের দেবপুরী ছিল। ভারত বিভক্তির আগ পর্যন্ত এই আশ্রমে আসা-যাওয়া ছিলো বিভিন্ন দেশের কানফোট সাধু-সন্যাসী ও যোগীদের। এই যোগীরা ব্যবহার করতেন মরছল নামের ময়ূরের পালক দিয়ে তৈরী নকশি পাখা। পরবর্তীতে ময়ূরের পালকের আদলে এখানে তৈরী করা হতো তালপাতা দিয়ে তৈরী ডাটি পাখা।

এভাবেই প্রাচীনকাল থেকে বংশ পরম্পরায় তালপাতার পাখা তৈরী করে আসছেন যোগীর ভবন, আতালপাড়া ও আড়োলার মানুষ। এই তিনটি গ্রামে প্রতিটি ঘরে ঘরে বাণিজ্যিকভাবে চলে পাখা তৈরীর কাজ। এখানে গরম পড়ার সাথে সাথে পাখা কেনার জন্য ছুঁটে আসেন দেশের বিভিন্ন জেলার পাইকার। পাইকারদের চাহিদা মেটাতে আশ্বিন-কার্তিক মাস বাদে সারা বছরই তালপাতা, বাঁশ, সুতা, রং সহ পাখা তৈরীর বিভিন্ন উপকরণ সংগ্রহের পাশাপাশি পাখা তৈরীর কাছে বাস্ত থাকেন সবাই।

গরম পড়ার সাথে সাথে তাঁদের বাস্ততা আরও বেড়ে যায়। বিভিন্ন জেলার পাইকার আগাম অর্ডার দেন পাখা তৈরীর জন্য। তাঁদের চাহিদা পুরুণে প্রাণপন চেষ্টা কারিগরদের। কেউ ঘরে কেউ বারান্দায়, আবার কেউ উঠানে বসে করছেন পাখা তৈরীর কাজ। ছেলেরা বাঁশ কেটে ডাটি বানাচ্ছেন আর মেয়েরা সুঁই সুতো দিয়ে চাকে তালপাতা বাঁধছেন। কেউ কেউ আবার নিখুঁতভাবে পাখায় তুলি আর রংয়ের আঁচড়ে নকশা করছেন। তাঁদের নিখুঁত হাতের ছোঁয়ায় তালপাতার পাখায় ফুটে উঠছে বাঙালির লোকগাঁথা জ্যামিতিক নকশা ও শিল্পকর্ম।
প্রাচীন ঐতিহ্যের এই অংশটি এখানকার কারিগরদের বাপ-দাদার আদিপেশা।

তালপাতার পাখা তৈরীর কাজ করেই তাঁরা জীবন-জীবিকা নির্বাহ করেন। কৃষিকর্মের পাশাপাশি পাখা তৈরীর কাজই তাঁদের মুল পেশা। ছেলেরা মাঠে কাজ করার পর, ফাঁক পেলেই পাখা তৈরীর কাজে মনোযোগী হয়ে পড়েন। আর মেয়েরা বাড়িতে বসে রান্না-বান্নার কাজের পাপাপাশি সমানতালে পাখা তৈরীর কাজ করেন।

বসন্ত উৎসব , চৈত্র সংক্রান্তি, পহেলা বৈশাখ, ঐতিহ্যবাহী মেলা আর বাঙালির উৎসব সবখানে তালপাতার পাখা একটি উল্লেখ্যযোগ্য সৌন্দর্য বহন করে। ঘরে ঘরে লেগেছে প্রযুক্তির হাওয়া, পরিবেশ বান্ধবে কি আছে ভরসা, হাতপাখার বাতাসের প্রশান্তিই আলাদা। তাইতো চৈত্র মাস পড়তে না পড়তেই সরগরম এখানকার তালপাতার পাখার গ্রাম। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাখা কিনতে আসা পাইকারদের আনাগোনায় অনেকটা জমজমাট এই পাখার গ্রামগুলো।

গত শুক্রবার আতালপাড়ার পাখা তৈরীকারক আঃ গফুরের বাড়িতে দেখা মিললো ঢাকার মিরপুর মাজার রোডের পাইকার ইব্রাহিমের সাথে। তিনি জানান, আজকে ৩০ টাকা পিচ দরে আমি ৩ হাজার পাখা কিনেছি। তারমতে গত বছরের চেয়ে এবার পাখার মুল্য প্রায় দ্বিগুন হয়েছে। তারপরেও পাখা কিনে নিয়ে যাচ্ছি এই ব্যবসা ধরে রাখার জন্য। তিনি প্রতি বছরই এখানে আসেন পাখা কিনতে। সিজিন সময়ে ১৫ দিন পর পর এখানে এসে পাখা কিনে নিয়ে গিয়ে ঢাকাতে বিক্রি করেন।

পাখা তৈরীকারক আঃ গফুর জানান, তিনি ফাল্গুন মাসের মাঝামাঝি থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত প্রায় ৩০ হাজার পাখা বিক্রি করেন। ৩০ হাজার পাখা বিক্রি করে খরচ বাদ দিয়ে তাঁর লাভ থাকে প্রায় দেড় লাখ টাকা। সেখানকার পাখা তৈরীকারক রফিকুল ইসলাম জানান, তিনি কৃষি কাজের ফাঁকে পাখা তৈরীর কাজ করেন। সিজিনে তিনি প্রায় ১০ হাজার পাখা বিক্রি করেন।

আড়োলা দক্ষিণপাড়ার আঃ রাজ্জাক ও তাঁর স্ত্রী মোফেলা দুজনেই তৈরী করেন পাখা। সিজিনে তাঁরা প্রায় সাড়ে ৩ লাখ টাকার পাখা বিক্রি করেন। সাড়ে ৩ লাখ টাকার পাখা বিক্রি করে তাঁদের প্রায় ২ লাখ টাকা লাভ হয়। পাখা তৈরীকারক সাইফুল ও তাঁর স্ত্রী মমতা বেগম জানান, তাঁদের অন্য কোন পেশা নেই। পাখা তৈরী করেই সারা বছর তাঁদের সংসার চলে। আড়োলার পাখা তৈরীকারক বাদশা মিয়া হাফিজা, মমতাজ উদ্দিন জানান, আশ্বিন-কার্তিক মাস বাদে সারা বছরই তাঁরা পাখা তৈরীর উপকরণ সংগ্রহ ও পাখা তৈরীর কাজ করেন।

দৈনিক বগুড়া

সর্বশেষ: