বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বগুড়ায় যমুনার চরে হাজার কোটি টাকার কৃষি বাণিজ্য

বগুড়ায় যমুনার চরে হাজার কোটি টাকার কৃষি বাণিজ্য

বগুড়ায় যমুনা নদীকে ঘিরে বসবাস করা চরবাসীকে নতুন করে স্বপ্ন দেখাচ্ছে জেগে ওঠা চর। বারবার নদীভাঙনের শিকার এ বাসিন্দারা বন্যার পর হাজার হাজার বিঘা পলিময় ধু-ধু বালুচরে আবাদ করেন বিভিন্ন ফসল। এক বন্যা থেকে পরের বন্যা আসা পর্যন্ত তারা প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার ফসল কেনাবেচা করেন বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।

স্থানীয়রা জানান, বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলায় প্রতি বছরই জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বন্যার ভয়াবহতা দেখা যায়। উজান থেকে নেমে আসা সামান্য ঢলের পানিতেই নাব্য হারানো নদী পরিপূর্ণ হয়ে প্লাবিত হয় আশপাশের এলাকা। শুকনো মৌসুমে যমুনা নদীতে পানি কমে জেগে ওঠে অসংখ্য ডুবোচর। প্রমত্তা এ নদীতে বিভিন্ন রুটের নৌযান চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে যায় এ সময়। মাইলের পর মাইল হেঁটে চরে বসবাসরত নিরুপায় মানুষকে বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করতে হয়। চলতি শুষ্ক মৌসুমেও যমুনার বুকে জেগেছে ধু-ধু বালুচর। পলিমাটি ও চরের এ বালির মাঝেই চাষাবাদ এবং গরু-ছাগল পালন চরবাসীর প্রধান পেশা। মরিচ, আলু, বাদাম, মিষ্টি কুমড়া, শশা, ধান, পাট, গম, ভুট্টাসহ প্রায় সব রকম ফসলের চাষ হয় সেখানে। আবাদের পর ফলন তুলে বিক্রি করা হয় স্থানীয় হাটবাজারে। 

সারিয়াকান্দি উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্যমতে, উপজেলার শংকরপুর, ধারাবর্ষা, কেষ্টিয়ারচর, আওলাকান্দি, বেণীপুর, কাজলা, বাওইটোনা, কুড়িপাড়া, পাকেরদহ, টেংরাকুড়া, পাকুড়িয়া, চর ঘাগুয়া, জামথল, বেড়াপাঁচবাড়ীয়া, ফাজিলপুর, চালুয়াবাড়ী, শিমুলতাইড়, ধারাবরিষা, বিরামেরপাঁচগাছি, হাটবাড়ী, দলিকা, মানিকদাইড়, কর্ণিবাড়ী, শনপচা, নান্দিনাচর, ডাকাতমারা, শালুখা, চর বাটিয়া, ক্ষেপির পাড়াসহ ৬৯টি চরে ফসল ভালো উৎপন্ন হয়। এর মধ্যে চলতি বছর উপজেলায় মরচি চাষ হয়েছে ৩ হাজার ৫১৪ হেক্টর জমিতে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৯ হাজার ২১৪ টন মরিচ, যার বর্তমান বাজার মূল্য ৩৮৫ কোটি টাকারও বেশি। যমুনার প্রায় ৬ হাজার ৪১০ হেক্টর পতিত জমিতে ভুট্টা চাষ হয়েছে। ৬৪ হাজার ১০০ টন ফলনের আশা করা হচ্ছে, যার বাজার মূল্য ১৬০ কোটি টাকার বেশি। 

বন্যার পর পরই ৭ হাজার ১০ হেক্টর জমিতে ১৬ হাজার ৩৩০ টন পাট উৎপন্ন হয়, যার মূল্য ১২৩ কোটি টাকা। এছাড়া ১ হাজার ৬৫০ হেক্টর জমিতে ১ হাজার ৬৫০ টন কাউন, ৭৫ হেক্টরে ৯৫ টন চিনা, ৮৮০ হেক্টরে ৭৬৫ টন চিনা বাদাম, ১২ হাজার ৪৫০ হেক্টরে ৩০ হাজার ৮৫০ টন ধান, ১ হাজার ৫৮০ হেক্টরে ২ হাজার ১২০ টন পেঁয়াজ, ৮৬০ হেক্টরে ২ হাজার ১৫০ টন গম, ৫৪০ হেক্টরে ৮১০ টন মাসকলাই, ৯১০ হেক্টর জমিতে ৯১০ টন মসুর ডাল, ৫০৫ হেক্টরে ৬ হাজার ৫৬৫ টন মিষ্টি কুমড়া উৎপন্ন হয়েছে। চরে মিষ্টি আলু, খেসারি, তিল, তিসি, কালিজিরা, স্থানীয় জাতের গাইঞ্জা ধান ও বোরো ধানও চাষ হয়ে থাকে। এসব মিলিয়ে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার লেনদেন হয় প্রতি বছর। পাশাপাশি চরাঞ্চলের প্রতিটি পরিবারে রয়েছে গরু-ছাগলসহ নানা ধরনের গৃহপালিত পশুপাখি। এসব বিক্রি করেও আর্থিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছেন চরের বাসিন্দারা।

জানতে চাইলে সারিয়াকান্দির কর্ণিবাড়ী ইউনিয়নের ইন্দুরমারা চরের রিপন মিয়া বলেন, ‘‌বন্যার মধ্যে খুব কষ্টে থাকলেও পরবর্তী সময়ে নানা ধরনের ফসলে আমাদের বাড়ি ভরে যায়। চরের জমিতে তেমন খাটতে হয় না। নদীর পানি থেকে সেচ দিয়ে অল্প সার-নিড়ানির মাধ্যমেই ফসল ঘরে তোলা যায়। এসব ফসল বিক্রি করে স্থানীয়রা বেশ লাভবান হচ্ছেন।’  

হাটশেরপুর ইউনিয়নের শিমুলতাইড় চরবাসী আনারুল ইসলাম বলেন, ‘চরে বসত করে চরের ফসল এবং গরু-ছাগল ও গরুর দুধ বিক্রি করে আর্থিকভাবে সচ্ছলতা ফিরেছে আমাদের। প্রথম দিকে চরের জমি চাষ করে  কেবল ভাতের ব্যবস্থা করেছি। পরে ফসলের আয় দিয়ে তিনটি গরু কিনে ছোট খামার গড়েছি। যেখান থেকে প্রতিদিনই দুধ বিক্রি করা হয়। গবাদি পশুর খাবারের জন্যও বাড়তি খরচের প্রয়োজন হয় না, চরে প্রচুর ঘাস পাওয়া যায়।’ 

কাজলা ইউনিয়নের বাওইটোনা চরের চাষী আজিজার রহমান জানান, প্রতি বছর শুকনা মরিচ থেকে ভালো আয় হয় তার। পুরো উপজেলায় হাজার কোটি টাকার মরিচ কেনাবেচা হয়ে থাকে। মানে ভালো হওয়ায় এ মরিচের চাহিদা সারা দেশেই রয়েছে।

সারিয়াকান্দি উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল হালিম জানান, যমুনাপাড়ের চরাঞ্চলের মানুষ বন্যার কয়েক মাস কষ্টে থাকলেও পানি নেমে যাওয়ার পর জমিতে নানা ধরনের ফসল চাষ করে এবং গৃহপালিত পশুপাখি লালন-পালন করে লাভবান হচ্ছে। তারা এক মৌসুমেই প্রায় হাজার কোটি টাকার ফসল কেনাবেচা করে থাকে। চরে বিভিন্ন ফসলের মধ্যে মরিচ, ভুট্টা, পাট, ধান ও বাদাম থেকে বেশি আয় হয়। এ চাষীরা প্রতি বছর নদী ভাঙনেরও শিকার হন। মূলত তারাই চরের পতিত জমিতে চাষ করে ফসল উৎপাদন করে যাচ্ছেন।

দৈনিক বগুড়া