
এই কালেমায়ে তাওহিদের বৈপ্লবিক প্রভাব সম্পর্কেও সকল মুসলমানরা জানে। এই একটিমাত্র কালেমা পড়ার পর মানুষের জীবনে এক বিরাট পরিবর্তন দেখা দেয়। যে ব্যক্তি এই কালেমা পড়ার পূর্বে কাফের ছিল, সে এই কালেমা পড়ার পর মুসলমান হয়ে যায়। একটু পূর্বে যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে অপ্রিয় ছিল, কালেমা পড়ার পর আল্লাহ তায়ালার প্রিয় পাত্র হয়ে যায়। যে ব্যক্তি জাহান্নামের উপযুক্ত ছিল, এই কালেমা পড়ার পর জান্নাত ও আল্লাহর রহমত লাভের উপযুক্ত বনে যায়। এই কথা বললে অতিরঞ্জন হবে না যে, এ এমন এক কালেমা, যা মানুষকে মুহূর্তের মধ্যে জাহান্নামের সপ্তম স্তর থেকে বের করে জান্নাতুল ফেরদাউসের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছে দেয়। এ কোনো কাব্যিক অতিরঞ্জন নয় বরং এক অনস্বীকার্য বাস্তবতা। এর অসংখ্য উদাহরণ ইসলামের ইতিহাসে পাওয়া যায়।
খায়বার যুদ্ধের ঘটনা। এই যুদ্ধে দু’জাহানের সরদার নবী করিম (সা.) সাহাবিগণকে সঙ্গে নিয়ে ইহুদিদের সবচেয়ে বড় দুর্গ খায়বারের ওপর হামলা করেন। দীর্ঘ দিন দুর্গ অবরোধ করে রাখেন। খায়বারের ইহুদিদের পক্ষ থেকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে নানারকম ষড়যন্ত্র করা হত। নবী করিম (সা.) যখন দুর্গ অবরোধ করেন, অবরোধ কয়েকদিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।
অবরোধ চলাকালে খায়বার শহরের একজন রাখাল, ইতিহাসে যিনি আসওয়াদ রাখাল নামে অভিহিত হয়েছেন, তিনি মনে মনে ভাবলেন, এত বড় বাহিনী নিয়ে, এত দূরত্ব অতিক্রম করে, এত কষ্ট সয়ে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খায়বার আক্রমন করেছে, গিয়ে একটু জেনে আসি তাঁর বুনিয়াদি দাওয়াত ও পয়গাম কী? সে কীসের দিকে মানুষকে আহ্বান করছে? তাঁর ইচ্ছা-ইবা কী? রাখাল ঘর থেকে বের হয়ে মুসলিম বাহিনীর তাঁবুর দিকে অগ্রসর হলো। তাঁবুর কাছাকাছি একজন মুসলমানের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাত হলো। তিনি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমি জানতে চাই তোমরা কেন খায়বারের ওপর চড়াও হয়েছে? কোন কারণে আমাদের শহরের বাসিন্দারা তোমাদের দুশমন হলো? তোমাদের মূল দাওয়াত ও পয়গাম কী? মুসলমান লোকটি ছিলেন একজন সাহাবি। তিনি ইসলামের আকিদা ব্যাখ্যা করার পরিবর্তে আসওয়াদ রাখালকে বললেন, তুমি বরং আমাদের সরদার আল্লাহর রাসূলের (সা.) সঙ্গে সাক্ষাত করে তাঁকেই এ প্রশ্নগুলো কর। তিনিই তোমাকে ইসলামের বুনিয়াদি দাওয়াত ও নেয়ামতের মূল পয়গাম সম্পর্কে বলে দেবেন।
আসওয়াদ রাখালের কাছে এই কথা একদম নতুন ছিল। তাঁর কল্পনায়ও ছিল না যে, কোনো বাহিনীর সিপাহসালার, কোনো ফৌজের বড় অফিসার কিংবা কোনো রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা তার মত রাখালকে সশরীরে দরবারে প্রবেশের অনুমতি দিতে পারে। সাক্ষাতকার দিয়ে তাকে ধন্য করতে। তিনি সারাজীবন এটাই দেখে এসেছেন যে, ধনাঢ্য, পদস্থ ও কর্তা ব্যক্তিরা তার মত রাখালদের সঙ্গে কথা বলতেও অসম্মান ও অপমানবোধ করে।
তাই তিনি বললেন, আমি তোমাদের সরদারের কাছে কীভাবে যাব? তিনি তো তোমাদের রাষ্ট্রের প্রধান। তোমাদের ফৌজের সিপাহসালার। আর আমি সামান্য রাখালমাত্র। উত্তরে সেই সাহাবি বললেন, আমাদের সরদার নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালাম গরিবদের প্রতি অত্যন্ত সহমর্মী ও আন্তরিক। তাঁর মজলিসে ধনী ও গরিবের মাঝে, শাসক ও প্রজার মাঝে, নেতা ও কর্মীদের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। রাখাল লোকটি খুবই অবাক হলো। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে সামনে অগ্রসর হলো। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে উপস্থিত হয়ে ভয়ে ভয়ে দুরুদুরু মনে জিজ্ঞাসা করল, আমি আপনার কাছে জানতে চাই আপনার মূল দাওয়াত কী? আপনি কেন এই অঞ্চলে এসেছেন?
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে তাকে খুব সংক্ষেপে তাওহিদ সম্পর্কে বোঝালেন। আসওয়াদ রাখাল যখন তাওহিদ সম্পর্কে অবগত হলো, সে জিজ্ঞাসা করল, যদি কেউ এই বিশ্বাস গ্রহণ করে আপনার সঙ্গে শামিল হয়ে যায়, তা হলে তার কী লাভ হবে? তিনি বললেন, যদি তুমি এই বিশ্বাস গ্রহণ করে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নাও তা হলে তুমি আমাদের ভাই হয়ে যাবে। তোমাকে আমরা আমাদের বুকে জড়িয়ে নিব। সকল মুসলমান যেসব অধিকার পায় তুমিও তা পাবে।
আসওয়াদ রাখাল অত্যন্ত আশ্চর্যান্বিত হয়ে জিজ্ঞাসা করল, আমি কীভাবে সেসব অধিকার পাব অথচ আমি এক সামান্য রাখাল? আমার রঙ কালো। আমি কুৎসিত চেহারার অধিকারী। আমার দেহ থেকে দুর্গন্ধ বের হয়। আমার শরীরে ময়লা জমে থাকে। এই অবস্থায় আপনারা আমাকে কীভাবে বুকে জড়িয়ে নেবেন? কীভাবে আমাকে আপনাদের সমান মর্যাদা ও অধিকার প্রদান করবেন? নবী করিম (সা.) তাকে আশ্বস্ত করলেন। আসওয়াদ রাখাল বলল, যদি বিষয়টি এমনই হবে তা হলে আমি তাওহিদ ও একত্ববাদের ওপর ইমান আনব। আচ্ছা, আমাকে বলুন তো দেখি, আমার কৃষ্ণবর্ণ, কুৎসিত চেহারা, আমার দেহের ময়লা ও দুর্গন্ধের কী প্রতিকার হবে?
নবী করিম (সা.) বললেন, আমি এ কথার সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, যদি তুমি তাওহিদের ওপর ঈমান আন তা হলে দুনিয়ায় তোমার কুৎসিত চেহারা ও কৃষ্ণবর্ণের প্রতিকার না হলেও, যখন তুমি পরকালে আল্লাহর সামনে উপস্থিত হবে, তখন তোমার চেহারা শুভ্রোজ্জ্বল ও আলোকিত হবে। আল্লাহ তোমার চেহারার কালো রঙ নুর দ্বারা বদলে দেবেন। তোমার দেহের দুর্গন্ধ সুগন্ধির মাধ্যমে পরিবর্তন করে দেবেন। আসওয়াদ রাখাল বলল, যদি বিষয়টি তা-ই হবে তা হলে আমি ইসলাম কবুল করলাম, আশহাদু আল লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহু।
এরপর রাখাল লোকটি জিজ্ঞাসা করল, বলুন, এবার আমার দায়িত্ব কী? নবী করিম সালালাহু আলাইহি ওয়াসালাম বললেন, ইসলামে বহু ফরজ বিধান রয়েছে। তবে এখন নামাজের সময় না। রোজার মাসও না। তোমার পর জাকাতও ফরজ হয়নি। এখন হজের মওসুমও না। তাই তোমাকে নামাজ-রোজা, হজ-জাকাত কোনোটিই পালনের নির্দেশ দিতে পারি না। এখন তুমি একটি ইবাদতই করতে পার, তা হলো খায়বারের রণাঙ্গনে হক ও বাতিলের লড়াই চলছে, আল্লাহ তায়ালার রাস্তায় ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা তাদের প্রাণকে উৎসর্গ করছেন। এই মুহূর্তে তোমার দায়িত্ব হলো জিহাদে শামিল হয়ে যাওয়া।
আসওয়াদ রাখাল বলল, আমি যদি এই যুদ্ধে শহিদ হয়ে যাই তা হলে আমার প্রতিদান কী হবে? নবী করিম সালালাহু আলাইহি ওয়াসালাম বললেন, আমি তোমাকে এ বিষয়ের জামানত দিচ্ছি যে, যদি তুমি এ জিহাদে শহিদ হয়ে যাও, তা হলে আল্লাহ তায়ালা তোমাকে সোজা জান্নাতুল ফেরদাউসে পৌঁছে দেবেন। তোমার চেহারা উজ্জ্বল করে দেবেন। তোমার দেহের দুর্গন্ধ সুগন্ধি দিয়ে বদলে দেবেন। তিনি যেই বকরিপাল সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন, রাসূল (সা.) সেগুলোর ব্যাপারে বললেন, যেসব বকরি তুমি সঙ্গে নিয়ে এসেছ, এগুলো অন্যের। আগে এগুলো ফেরত দিয়ে এসো।
চিন্তা করে দেখুন, যুদ্ধের ময়দান, শত্রুবাহিনীর বকরির পাল। তিনি বকরিগুলো শত্রু‘-এলাকার বাইরে নিয়ে এসেছেন। ইচ্ছা করলেই তিনি বকরির পালকে গনিমতের মালের অন্তর্ভুক্ত করে নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি যেহেতু এগুলোকে আমানত হিসেবে নিয়ে এসেছিলেন আর আমানত প্রর্ত্যাপণ করা নবী করিম সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসালামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা তাই নবী করিম (সা.) তাকে বলেন, বকরিগুলোকে তাড়িয়ে দাও, যাতে এগুলো শহরের অভ্যন্তরে চলে যেতে পারে। মালিকের হাতে গিয়ে পৌঁছতে পারে। সেমতে তিনি বকরিগুলো শহরের দিকে তাড়িয়ে দিলেন। এরপর তিনি জিহাদে শামিল হয়ে গেলেন।
দীর্ঘক্ষণ লড়াই চলল। যুদ্ধ শেষে খায়বার বিজয় হলো। নবী করিম সালালাহু আলাইহি ওয়াসালাম শহিদদের লাশ দেখার জন্য বের হলেন। শহিদদের লাশের মাঝে আসওয়াদ রাখালের লাশটিও পড়ে ছিল। যখন লাশটি রাসূল সালালাহু আলাইহি ওয়াসালামের সামনে আনা হলো, তাঁর মোবারক চোখ অশ্রতে ভরে উঠল। তিনি বললেন, ইনি এক আশ্চর্য ব্যক্তি। এমন একব্যক্তি, যিনি আল্লাহর জন্য একটি সেজদাও করেননি। আল্লাহর রাস্তায় একটি পয়সাও খরচ করেননি। আল্লাহর জন্য অন্য কোনো ইবাদত করার সুযোগও পাননি। কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি, ইনি সোজা জান্নাতুল ফেরদাউসে পৌঁছে গিয়েছেন। আমি দেখছি, আল্লাহ তায়ালা তাঁর চেহারার কৃষ্ণবর্ণকে নুর দ্বারা বদলে দিয়েছেন। তাঁর দেহের দুর্গন্ধ ও ময়লা-আবর্জা সুগন্ধি দ্বারা সুরভিত করে দিয়েছেন।
ইতঃপূর্বে আমি যে কথা বলেছি, কালেমা লা ইলাহা ইলালাহ মুহূর্তের মধ্যে মানুষকে জাহান্নামের সপ্তম স্তরের তলদেশ থেকে বের করে জান্নাতুল ফেরদাউসের সুউচ্চ আসনে পৌঁছে দেয়। এতে কোনো অতিরঞ্জন নেই। বরং এই ঘটনা থেকে আমরা তার বাস্তব উদাহরণ দেখতে পাই যে, রাখাল সাহাবি একবার মাত্র লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ বলেছেন। তারপর এই কালেমা তার জীবনে কত বিস্ময়কর পরিবর্তন এনে দিয়ে দিয়েছে!
এখন চিন্তার বিষয় হলো, একটিমাত্র বাক্য একজন মানুষের জীবনে এত বিশাল পরিবর্তন বিপ্লব কীভাবে ঘটিয়ে থাকে? এই কালেমা কী কোনো মন্ত্রতন্ত্র না কোনো তেলেছমাতি? এই কালেমা পড়ার পর মানুষ জাহান্নাম থেকে, আল্লাহর আজাব ও গজব থেকে নিরাপদ হয়ে যায়। বাস্তব কথা হলো, এই কালেমা কোনো মন্ত্র না। তেলেছমাতিও ন। বরং লা ইলাহা ইল্লালাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুলাহ একটি প্রতিজ্ঞা। একটি অঙ্গীকার। মানুষ তার পালনকর্তার সঙ্গে এই অঙ্গীকার করে থাকে। যখন কোনো ব্যক্তি বলে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, তখন এর মর্ম হলো, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। আমি আল্লাহ ব্যতীত সকল উপাস্য থেকে নিরাপদ। আমি আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত সকল উপাস্যের উপাস্য হওয়াকে অস্বীকার করছি। এবং মুহাম্মাদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহর প্রেরিত সত্য নবিরূপে গ্রহণ করছি। এই অঙ্গীকার ও প্রতিজ্ঞার অর্থ হলো, আমি যে জীবন অতিবাহিত করব তা সর্বাংশে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি ও তাঁর আহকাম ও বিধি-বিধান মেনে করব। এই প্রতিজ্ঞার বদৌলতে তার জীবনে এই বিপ্লব সাধিত হয় যে, পূর্বে সে আল্লাহ তায়ালার অপ্রিয় ছিল। এখন প্রিয়পাত্র হয়ে গেল। পূর্বে কাফের ছিল। আর এখন মুসলমান হয়ে গেল। পূর্বে জাহান্নামি ছিল। এখন জান্নাতি হয়ে গেল। এই বিস্ময়কর বিপ্লব সেই প্রতিজ্ঞার বদৌলতেই সম্ভব হচ্ছে। শরিয়তে এই প্রতিজ্ঞার নামই হলো তাওহিদ। চলবে...
দৈনিক বগুড়া