
মহানবী (সা.) যখন মারা যান তখন তাঁকে কোথায় কবরস্থ করা হবে এ নিয়ে লোকেরা মতভেদ করে। তাঁর সাহাবীগণও বুঝতে পারছিলেন না যে, মহানবী (সা.)-কে কোথায় কবরস্থ করবেন। আবূ বকর (রা) বলেন, আমি মহানবী (সা.)-কে বলতে শুনেছি-
‘নবী যখন মারা যান সেখানে ব্যতীত অন্য কোথাও কবরস্থ করা যায় না।’ (মুসনাদ আহমদ-হা: ১/৭,মা: শা:,হা:২৮)।
এরপর সাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর বিছানা সরিয়ে বিছানার নিচে কবর খনন করেন। এ জন্য রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে ‘আয়িশাহ (রা.) এর পবিত্র হুজরায় দাফন করা হয়।
মহানবী (সা.) পবিত্র হুজরায় দক্ষিণ দিকে কবরস্থ হোন। আর ‘আয়িশাহ (রা.) হুজরার উত্তরাংশে অবস্থান করতে থাকেন। কবর ও তাঁর মাঝে কোনো পর্দা ছিলো না। অতঃপর যখন আবূ বকর (রা.) মারা যান তখন তিনি (আয়িশাহ (রা.)) তাকে মহানবী (সা.) এর কবরের এক হাত পেছনে দাফন করার জন্য অনুমতি দেন। তার জন্য মহানবী (সা.) এর কবরের এক হাত পেছনে কবর খনন করা হয় তার মাথাটা রাসূলুল্লাহ (সা.) এর দু’কাঁধ বরাবর হয়ে যায়। এরপরও ‘আয়িশাহ (রা.) কবরের ও নিজের মাঝে কোনো পর্দা বা আড়াল করেননি; বরং তিনি বলেন, তাদের একজন আমার স্বামী দ্বিতীয়জন আমার পিতা, তবে ওমর (রা.) যখন মারা যান তখন তিনি তার দু’সাথীর সঙ্গে দাফন করার অনুমতি দেন। অতঃপর আবূ বকর সিদ্দীক (রা) এর এক হাত পেছনে তার কবর খনন করা হয়, তার মাথা আবু বকর (রা) এর দু’কাঁধ বরাবর হয়ে যায়। ওমর (রা.) এর কাঠামো লম্বা হওয়ার কারণে তার দু’পা হুজরার পূর্ব দিকের দেয়ালে ঠেকে যায়। এরপর‘আয়িশাহ (রা.) তার ও কবরসমূহের মাঝে পর্দা রাখেন। কারণ ওমর (রা.) মুহরিম ছিলেন না। সে জন্য তিনি মৃত্যুর পরও তার সম্মান বজায় রেখেছেন।
মহানবী (সা.) এর কবর জিয়ারত: হজের সময় মহানবী (সা.) এর কবর জিয়ারত ওয়াজিবও নয় শর্ত ও নয়। যেমন-কতিপয় সাধারণ মানুষ ধারণা করে থাকে; বরং তার জন্য উত্তম যে, সে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর মসজিদ জিয়ারত করতে আসে অথবা যে ব্যক্তি মসজিদে নববীর নিকটে থাকে তার জন্য ও মসজিদে নববী জিয়ারত করা। আর যারা মদিনা থেকে অনেক দূর থেকে কেবল কবর জিয়ারত করার উদ্দেশ্যে আসে তাদের জন্য এ সফর বৈধ নয়। তবে মসজিদে নববীর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর করা সুন্নত। যখন মসজিদে পৌঁছে যাবে তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর দু’সাথীর কবর জিয়ারত করে নিবে। এভাবে উক্ত কবরসমূহের জিয়ারত মসজিদ জিয়ারতের আওতাভুক্ত হয়ে যাবে।
এটি এজন্য যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: ‘তিনটি মসজিদ ব্যতীত বরকতের আশায় অন্য কোনো স্থানের উদ্দেশ্যে লম্বা সফর করা যাবে না, তিনটি মসজিদ হলো-(১) মসজিদে হারাম, (২) মসজিদে রাসূল অর্থাৎ-মসজিদে নববী এবং (৩) বায়তুল মুকাদ্দাস।’(সহিহ বুখারী-হা: ১১৮৯,সহিহ মুসলিম-হা: ১৩৯৭)।
তবে যে সকল হাদিস দ্বারা রাসূলুল্লাহ (সা.) এর কবর জিয়ারত করার উদ্দেশ্যে লম্বা সফর বৈধ হওয়ার দলীল পেশ করা হয়, সে সকল হাদিসের বর্ণনাসূত্র দুর্বল ও মাওযূ বা বানোয়াট। হাফিজ দারাকুতনী, বায়হাক্বী, ইবনু হাজর প্রমুখ ওই হাদিসসমূহের পরস্পর দুর্বল হওয়ার ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছেন। সুতরাং উক্ত দুর্বল হাদিসগুলোকে সহিহ হাদিসের মোকাবিলায় পেশ করা বৈধ হবে না, যে সহিহ হাদিস দ্বারা তিনটি মসজিদ ব্যতীত, অন্য স্থানে বরকতের আশায় লম্বা সফর অবৈধ প্রমাণিত।
হে পাঠকগণ! এ বিষয়ে কতিপয় মাওযূ হাদিস আপনাদের সমীপে উল্লেখ করছি যাতে আপনারা সেগুলো জানতে পারেন ও ধোঁকা থেকে সতর্ক থাকেন।
প্রথম বর্ণনা: ‘যে ব্যক্তি হজ করল অথচ আমার জিয়ারত করল না সে আমার সঙ্গে খারাপ আচরণ করল।’
দ্বিতীয় বর্ণনা: ‘যে ব্যক্তি আমার মৃত্যুর পর আমার জিয়ারত করল সে যেন আমার জীবিতাবস্থায় আমাকে জিয়ারত করল।’
তৃতীয় বর্ণনা: ‘যে ব্যক্তি একই বছরে আমার ও আমার পূর্ব পিতা ইব্রাহিম (আ.) এর জিয়ারত করবে আমি মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তার জান্নাত লাভের দায়িত্ব নেব।’
চতুর্থ বর্ণনা: ‘যে ব্যক্তি আমার কবর জিয়ারত করল তার জন্য আমার সুপারিশ ওয়াজিব হয়ে গেল।’
এ হাদিসসমূহ এবং এ ধরনের যতো হাদিস বর্ণনা করা হয়েছে তার একটিও রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে সাব্যস্ত নয়। (আল হাজ্জ ওয়াল ‘উমরাহ্ ওয়ায যিয়ারাহ্- ৬৮-৬৯পৃ: শাইখ বিন বায (রা.)।
যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা.) এর কবর জিয়ারত করতে চায় সে কবরের পাশে নীরবে আদবের সঙ্গে দাঁড়িয়ে সালাম করবে।
অর্থাৎ- বলবে,
‘হে মহান আল্লাহর রাসূল (সা.)! আপনার ওপর শান্তি, মহান আল্লাহর রহমত ও বরকত বর্ষিত হোক।’
জিয়ারতকারী যদি রাসূলুল্লাহ (সা.) এর প্রতি সালাম পেশ করার সময় নিম্নলিখিত শব্দ ব্যবহার করে তাহলে তাতে কোনো অসুবিধা নেই। কারণ এগুলো নবীজির (সা.) প্রকৃত গুণাবলী।
হে মহান আল্লাহর নবী! আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। হে মহান আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে উত্তম ব্যক্তিত্ব আপনার ওপর শান্তি হোক। হে নবীগণের সরদার! মুত্তাক্বীগণের ইমাম আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আপনি রিসালা বা বার্তা পৌঁছিয়ে দিয়েছেন, আমানত আদায় করে দিয়েছেন। নিজ উম্মতকে উপদেশ দিয়েছেন এবং মহান আল্লাহর পথে যথাযথ জিহাদ করেছেন। অতঃপর জিয়ারতকারী রাসূলে করিম (সা.) এর ওপর দরুদ পাঠ ও দোয়া করতে পারে। কেননা শরীয়াতে রাসূলের প্রতি দরুদ ও সালাম
উভয়ের বিধান আছে। যেমন- মহান আল্লাহর বাণী:
إِنَّ اللَّهَ وَمَلَائِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى النَّبِيِّ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا صَلُّوا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوا تَسْلِيمًا
‘আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর প্রতি রহমত প্রেরণ করেন। হে মুমিনগণ! তোমরা নবীর জন্যে রহমতের তরে দোয়া কর এবং তাঁর প্রতি সালাম প্রেরণ কর।’ (সূরা: আহযাব- ৩৩, আয়াত: নম্বর: ৫৬)।
অতঃপর জিয়ারতকারী আবূ বকর ও ওমর (রা) এর ওপর সালাম পেশ করবে, দোয়া করবে এবং তাদের জন্য মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করবে।
ইবনু ওমর (রা.); রাসূলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর সাথীদ্বয় আবূ বকর ও ওমর (রা.) এর ওপর সালাম পেশ করার সময় এ শব্দ ব্যবহার করতেন:
‘হে মহান আল্লাহর রাসূল (সা.) আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক, হে আবূ বকর! আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক, হে আমার আব্বাজান! আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক।’ তারপর তিনি ফিরে আসতেন। এ জিয়ারতের বিধান কেবল পুরুষদের জন্য রাখা হয়েছে।
জিয়ারতের সময় একথা যেন স্বরণ থাকে যে, কবরে হাত দ্বারা স্পর্শ, শরীর স্পর্শ, চুমু এবং তার পাশে তাওয়াফ করা বৈধ নয়। কেননা এসব কর্ম সাহাবি ও তাবিঈগণ থেকে প্রমাণিত নয়; এ কর্মগুলো বিদাত।
অনুরুপভাবে কারো জন্য রাসূলে করিম (সা.) এর কাছে চাহিদা পূরণ, বিপদ-আপদ দূরীকরণ অসুখ থেকে আরোগ্য লাভ ইত্যাদির জন্য দোয়া করা বৈধ নয়। কারণ এগুলো একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা ব্যতীত অন্য কারো কাছে চাওয়া যায় না। উক্ত চাহিদা মৃত ব্যক্তির নিকটে প্রার্থনা করা শির্ক এবং আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্যের ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। কতিপয় জিয়ারতকারী রাসূলে করিম (সা.) এর কবরের কাছে স্বর উঁচু করে ও সেখানে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। তাদের এ কর্ম শরীয়াত বিরোধী।
কারণ, রাসূলে করিম (সা.) এর কবরের নিকট অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা, বার বার সালাম করতে যাওয়াতে ভিড়, চিৎকার ও গোলমালের সৃষ্টি হবে। এ সব আচরণ আদব ও শরীয়াতের বিপরীত। আবার কিছু জিয়ারতকারী সালাম পেশ করার সময় ডান হাত বাম হাতের ওপর রেখে বুক অথবা তার নিচে রাখে। যেমন-মুসল্লীরা করে থাকে। নবীর ওপর সালাম পেশ করার সময় এবং অন্য কোন নেতা বা বাদশাহর ওপর সালাম পেশ করার সময় এরুপ কর বৈদ নয়। কারণ এটি ইবাদত, বিনয়ী ও তাচ্ছিল্যের রুপ। এটি আল্লাহ তায়ালা ছাড়া কারো জন্য ঠিক নয়।
মসজিদে নববী (সা.) জিয়ারত করা মুস্তাহাব। সারা বছর ধরে জিয়ারত করা যায়, জিয়ারতের কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই। এ জিয়ারত হজের অংশ নয়। তা ব্যতীত হজ সম্পূর্ণ হয়ে যাবে। তবে যারা হজের উদ্দেশ্যে আসে তাদের জন্য উত্তম হচ্ছে যে, তারা নিজেদেরকে বৃহৎ কল্যাণ থেকে বঞ্চিত না করে; বরং এখানে এসে সালাতের ফজিলত হাসিল করে। যার ফজিলতের কথা হাদিসে ইতোপূর্বে উল্লিখিত হয়েছে।
সূত্র: সাপ্তাহিক আরাফাত
দৈনিক বগুড়া