শুক্রবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৫, ১৭ আশ্বিন ১৪৩২

ইসলামী জীবন

গণিতের উজ্জ্বল পথিকৃৎ মুহাম্মদ আল-খাওয়ারিজমি

গণিতের উজ্জ্বল পথিকৃৎ মুহাম্মদ আল-খাওয়ারিজমি

সংগৃহীত

প্রকৃতিবিজ্ঞান বা পদার্থবিজ্ঞানের সব উৎস কোনো না কোনোভাবে গণিতের সঙ্গে সম্পর্কিত। গণিতকে তাই সাধারণভাবে এসব বিদ্যার জননী বলে মনে করা হয়।

প্রাথমিক যুগে গণিত প্রধানত তিনটি ভিন্নরূপে প্রকাশিত হয়েছিল—পাটিগণিত (সংখ্যার সাহায্যে গণনা), জ্যামিতি (ক্ষেত্রফলের পরিমাপ) এবং বীজগণিত (প্রতীক ও সেগুলোর সম্পর্কের মাধ্যমে হিসাব-নিকাশ)। এসব গাণিতিক কৌশল প্রাচীনকালের মানুষকে চিন্তা করতে, যুক্তি প্রদান করতে এবং তাদের দৈনন্দিন জীবনের কার্যাবলির ক্ষেত্রে তাদের মনোভাবকে তুলনামূলকভাবে যথাযথ ও নির্ভুলভাবে প্রকাশ করতে সক্ষম করে তুলেছিল।

যদিও পাটিগণিতকে গণিতের প্রথম এবং সম্ভবত সবচেয়ে প্রাচীন রূপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তবুও এর উৎপত্তি সম্পর্কে খুবই কম জানা যায়। ইতিহাসবিদদের মতে, নীল নদ উপত্যকা এবং মেসোপটেমিয়ায় পরিচালিত প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজ থেকে প্রমাণ পাওয়া গেছে যে প্রাচীন মিসরীয় ও ব্যাবিলনীয় উভয় জাতিগোষ্ঠীই গণনা সম্পর্কে অবহিত ছিল।

চীনা ও ভারতীয়রাও গণনার নিজস্ব স্বতন্ত্রপদ্ধতি উদ্ভাবন করেছিলেন। আরবরা আঙুলের গিঁট ব্যবহার করে গণনা করতেন। গ্রিক ও রোমানদের মতো আরবরাও সংখ্যা গণনার উদ্দেশ্যে তাঁদের বর্ণমালা ব্যবহার করতেন।

যদিও শূন্যভিত্তিক সংখ্যাপদ্ধতি প্রাচীন ভারতীয়দের কাছে পরিচিত ছিল, ‘শূন্য’ শব্দটির উদ্ভাবন করেছিলেন মুসলমানরাই। শব্দটি আরবি ‘সিফ্‌র’ থেকে উদ্ভূত। যার অর্থ ‘কিছুই নয়’ বা ‘শূন্য’; এরই ওপর ভিত্তি করে মুসলিম গণিতবিদেরা একটি কঠোর দশমিক পদ্ধতি তৈরি করেছিলেন; যা পরবর্তীকালে আরবি সংখ্যা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

বীজগণিত ও আরবি সংখ্যার বিকাশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা যিনি পালন করেছিলেন, তিনি হলেন গণিতবিদ আল-খাওয়ারিজমি। সে কারণেই তাঁকে আজও সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গণিত–প্রতিভা হিসেবে গণ্য করা হয়।

যখন মুসলিম গণিতবিদেরা বাগদাদ, দামেস্ক, কায়রো ও মারভের গবেষণাগারে জটিল ও সূক্ষ্ম গাণিতিক সমীকরণ নিয়ে কাজ করছিলেন, তখন ইউরোপীয়রা রোমান সংখ্যা ব্যবহার করে সাধারণ গাণিতিক হিসাব করতেও হিমশিম খাচ্ছিল। রোমান সংখ্যা দিয়ে একটি সাধারণ গাণিতিক সমীকরণ সমাধান করাও ছিল দুরূহ কাজ; স্পষ্ট করে বলতে গেলে, এটা ছিল একেবারেই আশাহীন প্রচেষ্টা।

পক্ষান্তরে, আরবি সংখ্যার প্রবর্তন গণিত-অধ্যয়ন ও গবেষণায় এক বিরাট বিপ্লবের সূচনা করেছিল। এরই সাহায্যে প্রাথমিক যুগের মুসলিম গণিতবিদেরা পুরো গণিতশাস্ত্রকে পরিশীলিত ও বিকশিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

বীজগণিত ও আরবি সংখ্যার বিকাশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা যিনি পালন করেছিলেন, তিনি হলেন গণিতবিদ আল-খাওয়ারিজমি। সে কারণেই তাঁকে আজও সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গণিত–প্রতিভা হিসেবে গণ্য করা হয়।

আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে মুসা আল-খাওয়ারিজমি মধ্য এশিয়ার খোরাসান প্রদেশের খাওয়ারিজমে জন্মগ্রহণ করেন। সে সময় খোরাসান ছিল বাণিজ্যিক ও সাহিত্যিক কর্মকাণ্ডের এক সমৃদ্ধ কেন্দ্র। শাসকশ্রেণি ও অভিজাতদের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রদেশজুড়ে গড়ে উঠেছিল বহু বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়।

এসব প্রতিষ্ঠানে সে-সময়ের বিশিষ্ট মুসলিম পণ্ডিত ও চিন্তাবিদেরা ধর্মীয় ও বৈজ্ঞানিক উভয় বিষয়েই পঠনপাঠন ও গবেষণা করতেন।

আল–খাওয়ারিজমির স্মরণে ১৮৮৩ সালে মুদ্রিত সোভিয়েত পোস্ট স্ট্যাম্প

আল–খাওয়ারিজমির স্মরণে ১৮৮৩ সালে মুদ্রিত সোভিয়েত পোস্ট স্ট্যাম্প

ছবি: মুসলিম হেরিটেজ

আল-খাওয়ারিজমি যে-পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তা জ্ঞান-অর্জনকে সর্বাধিক মূল্যবান বলে বিবেচনা করত। আল-খাওয়ারিজমির পরিবার তাঁর শৈশবে বাগদাদের উপকণ্ঠে অবস্থিত কুতরুবুল্লি জেলায় চলে আসে। তাঁর শৈশব সম্পর্কে খুব সামান্যই জানা যায়।

তবে সে সময়ের রীতি অনুযায়ী শিশুদের স্থানীয় বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করতে হতো। এর মধ্যে ছিল আরবি ভাষা ও প্রথামিক ইসলাম শিক্ষা। এরপর তারা আরবি ব্যাকরণ, সাহিত্য, কবিতা এবং ইসলামি ধর্মতত্ত্ব ও দর্শনের গভীরতর শিক্ষা লাভ করত।

অসাধারণ মেধাবী ছাত্র হিসেবে আল-খাওয়ারিজমি প্রচলিত পাঠ্যক্রম অনুসরণ করেন এবং দ্রুতই তাঁর যুগের ধর্মীয়, দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের ওপর দক্ষতা অর্জন করে সবার প্রশংসা অর্জন করেন।

একজন বিশিষ্ট ধর্মীয় পণ্ডিত, বিজ্ঞানী ও গণিতবিদ হিসেবে আল-খাওয়ারিজমির খ্যাতি বাগদাদের শাসনকেন্দ্রে পৌঁছায়। ৮২০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে আব্বাসীয় খলিফা আবদুল্লাহ আল-মামুন তাঁকে বাগদাদের খ্যাতনামা জ্ঞানকেন্দ্র বাইতুল হিকমায় যোগদানের আমন্ত্রণ জানান।

তখন আল-খাওয়ারিজমির বয়স ছিল প্রায় ৪০ বছর। তাঁর খ্যাতিমান বাবার মতোই আল-মামুন দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক গবেষণার একজন উদার পৃষ্ঠপোষক এবং হিতৈষী হয়ে ওঠেন; প্রকৃতপক্ষে তিনি জ্ঞান ও শিক্ষার সব শাখায় পঠনপাঠন, জ্ঞানচর্চা, গবেষণা ও অনুসন্ধানকে উৎসাহিত করেছিলেন।

প্রত্যাশিতভাবেই আল-খাওয়ারিজমি বাইতুল হিকমাহতে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেন। সেখানে তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞান, ভূগোল, ইতিহাস, সংগীত এবং বিশেষত তাঁর প্রিয়তম বিষয় গণিতসহ বহু বিদ্যায় অধ্যয়ন ও গবেষণা চালিয়ে যান।

খলিফা হারুনুর রশিদ তাঁর শাসনামলে ‘বাইতুল হিকমাহ’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তবে আল-মামুনের পৃষ্ঠপোষকতায় এটি মুসলিম বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত ও প্রভাবশালী গ্রন্থাগার ও গবেষণাকেন্দ্রে পরিণত হয়। তিনি নিজ উদ্যোগে তাঁর সময়ের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক, বিজ্ঞানী, ভূগোলবিদ ও গণিতবিদদের এই প্রতিষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানান, যাতে তাঁরা বিজ্ঞান, গণিত ও দর্শনে উচ্চতর গবেষণা ও শিক্ষা কার্যক্রম চালাতে পারেন।

প্রত্যাশিতভাবেই আল-খাওয়ারিজমি বাইতুল হিকমাহতে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেন। সেখানে তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞান, ভূগোল, ইতিহাস, সংগীত এবং বিশেষত তাঁর প্রিয়তম বিষয় গণিতসহ বহু বিদ্যায় অধ্যয়ন ও গবেষণা চালিয়ে যান। তাঁর গণিতপ্রতিভায় গভীরভাবে মুগ্ধ হয়ে খলিফা নিজ হাতে তাঁকে বাইতুল হিকমাহর জ্যোতির্বিজ্ঞানবিষয়ক গবেষণা-বিভাগের প্রধান নিযুক্ত করেন।

আল-খাওয়ারিজমি যে শুধু জ্যোতির্বিজ্ঞানে পারদর্শী ছিলেন তা নয়; বরং আরও বহু বৈজ্ঞানিক শাস্ত্রে মৌলিক অবদান রাখেন এবং কিতাব আল-তারীখ (ইতিহাসের বই) নামে একটি প্রভাবশালী গ্রন্থ রচনা করেন। পরবর্তীকালে এই গ্রন্থ খ্যাতনামা মুসলিম ইতিহাসবিদ আবুল হাসান আল-মাসউদী ও ইবনে জারীর আত-তাবারীকে তাদের নিজস্ব ঐতিহাসিক রচনাগুলো প্রণয়নে অনুপ্রাণিত করে।

খলিফা হারুনুর রশীদের পৃষ্ঠপোষকতায়ই হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ ইবনে মাতার আল-হাসিব এবং ইয়াহইয়া (ইউহান্না) ইবনে আল-বিতরিকের মতো অগ্রণী পণ্ডিত ও অনুবাদকেরা প্রথমবারের মতো প্রাচীন গ্রিকদের দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক অবদানগুলোকে আরবিতে অনুবাদ করতে শুরু করেন।

মুসলিম বিজ্ঞানী ও গণিতবিদেরা যে কেবল প্রাচীন গ্রিক বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্য (যেমন ইউক্লিডের ইলেমেন্টস, টলেমির আলমাগেস্ট এবং উত্তরসূরিদের সুবিধার জন্য অ্যারিস্টটলীয় যুক্তিতত্ত্বের বিশাল ভান্ডার) অনুবাদ ও সংরক্ষণ করেছেন তা নয়, তাঁরা পারস্য, ভারত এবং চীনসহ অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতার বৌদ্ধিক ও সাংস্কৃতিক অবদানও অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ করেছেন।

জ্ঞান ও প্রজ্ঞার প্রতি তাদের দুর্মর তৃষ্ণা তাঁদেরকে যেমন অনুপ্রাণিত করেছিল প্রাচীন মনীষীদের কর্মাবলি শিখতে, আত্তীকরণ করতে, পরিমার্জন করতে, তেমনি উদ্দীপিত করেছিল জ্ঞানের সব শাখায় তাদের নিজস্ব মৌলিক অবদান রাখতে।

প্রাচীন ভারতীয় বিজ্ঞান ও গণিতবিষয়ক পাণ্ডুলিপিও সংস্কৃত থেকে আরবিতে অনূদিত হয়। বাগদাদে তৎকালীন অনুবাদিত পাণ্ডুলিপির মাধ্যমে আল-খাওয়ারিজমি ভারতীয় গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যার সঙ্গেও পরিচিত হন। তিনি প্রাচীন ভারতীয় বিজ্ঞান ও গণিত আয়ত্ত করেন এবং শূন্যভিত্তিক দশমিক পদ্ধতির সঙ্গে পরিচিত হন।

আল–খাওয়ারিজমি রচিত ‘কিতাব আস–সুরাত আল–আর্‌দ’ গ্রন্থে নীল নদের একটি মানচিত্র

আল–খাওয়ারিজমি রচিত ‘কিতাব আস–সুরাত আল–আর্‌দ’ গ্রন্থে নীল নদের একটি মানচিত্র

ছবি: উইকিপিডিয়া

এ সময়ে আল-খাওয়ারিজমি আবিষ্কার করেন যে প্রাচীন ভারতীয়রা ‘কিছুই নেই’ বা ‘শূন্য’ বোঝাতে একটি ফাঁকা স্থান ব্যবহার করতেন। এই ধারণা থেকেই তিনি ‘সিফ্‌র’ নামের আরবি শব্দটি প্রবর্তন করেন, যার অর্থ ‘শূন্য’ বা ‘কিছুই নেই’।

পরবর্তীকালে এর লাতিন সমতুল্য ‘সাইফার’ থেকে ‘জিরো’ শব্দটির উৎপত্তি ঘটে। আরবি সংখ্যাপদ্ধতির ওপর ভারতীয় সভ্যতার প্রভাব স্বীকার করে নেওয়া সত্ত্বেও এ কথা সত্য যে, ‘শূন্য’-এর ধারণা আবিষ্কারের মাধ্যমে আল-খাওয়ারিজমি একটি নতুন দশমিক পদ্ধতির ভিত্তি স্থাপন করেন, যা আজ ‘আরবি অঙ্ক’ নামে পরিচিত এবং এর মাধ্যমে তিনি গণিত অধ্যয়নে এক যুগান্তকারী বিপ্লব ঘটান।

সব দিক বিবেচনা করলে দেখা যায় যে গণিতশাস্ত্রে আল-খাওয়ারিজমির অবদান ছিল একই সঙ্গে অনন্য এবং অভূতপূর্ব। তিনি গ্রিকদের জ্যামিতিক বীজগণিত এবং ভারতীয়দের অঙ্কনির্ভর বীজগণিতকে সুশৃঙ্খলভাবে বিশ্লেষণ করার পাশাপাশি ব্যাবিলনীয় বীজগণিত নিয়েও গবেষণা করেছিলেন।

গ্রিক, ভারতীয় ও ব্যাবিলনীয় গণিতের উপর পূর্ণাঙ্গ দক্ষতার ফলে তিনি প্রাচীন গণিতবিদদের অবদানের সমালোচনামূলক মূল্যায়ন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এরপর তিনি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নিজের মৌলিক ধারণা ও চিন্তা-ভাবনাকে বাস্তবিক রূপ দেন।

আল-খাওয়ারিজমিকে সর্বাধিক স্মরণ করা হয় তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ কিতাব আল-মুখতাসার ফি হিসাব আল-জাব্‌র ওয়াল-মুকাবালার জন্য; এই গ্রন্থ গণিতের এক নতুন শাখা বীজগণিতের ভিত্তি স্থাপন করেছিল। তাঁর গাণিতিক অবদানের মৌলিকতা সবচেয়ে স্পষ্ট হয় এই সত্য থেকে যে, অ্যালজেবরা শব্দটি এসেছে আল-খাওয়ারিজমির এই গ্রন্থের নাম থেকেই।

তাঁর মৃত্যুর কয়েক শতাব্দী পরে গ্রন্থটি লাতিন ভাষায় অনূদিত হয় এবং ইউরোপে হিন্দু সংখ্যার প্রচলনে গভীর প্রভাব ফেলে। সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপজুড়ে ভারতীয় সংখ্যাপদ্ধতি প্রচারে এই গ্রন্থের অবদান অপরিসীম।

অন্যান্য সভ্যতার গণিতবিদেরা বীজগণিতের কিছু প্রাথমিক ধারণা আগে থেকেই উন্নয়ন করেছিলেন, কিন্তু আল-খাওয়ারিজমিই প্রথম গণিতবিদ যিনি বীজগণিতের মৌলিক উপাদানগুলোকে একটি সুশৃঙ্খল আকারে উপস্থাপন করেছিলেন।

এই গ্রন্থেই তিনি প্রথমবারের মতো গণিতের ইতিহাসে বীজগণিতকে সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত ও বিকশিত করেছিলেন। পরে রবার্ট অব চেষ্টার গ্রন্থটি লাতিন ভাষায় অনুবাদ করেন। হিসাব আল-জাব্‌র ওয়াল-মুকাবালা নামে পরিচিত এই গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থটি পাঁচটি অধ্যায়ে বিভক্ত, প্রতিটি অধ্যায়ে লেখক বীজগণিতের বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করেছেন।

আল-খাওয়ারিজমির আরেকটি মহান গাণিতিক কর্ম হলো হিন্দু সংখ্যাপদ্ধতি নিয়ে তাঁর রচনা। তাঁর এই পাটিগণিতবিষয়ক গ্রন্থের নাম হলো কিতাব আল-জাম্‘ ওয়াত-তাফরীক বিল-হিসাব আল-হিন্দি (ভারতীয় গণিত অনুযায়ী যোগ ও বিয়োগের গ্রন্থ)।

এটি তিনি ৮২৫ খ্রিষ্টাব্দে রচিত হয়। তাঁর মৃত্যুর কয়েক শতাব্দী পরে গ্রন্থটি লাতিন ভাষায় অনূদিত হয় এবং ইউরোপে হিন্দু সংখ্যার প্রচলনে গভীর প্রভাব ফেলে। সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপজুড়ে ভারতীয় সংখ্যাপদ্ধতি প্রচারে এই গ্রন্থের অবদান অপরিসীম। এটি অত্যন্ত প্রভাবশালী বই হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করে।

গ্রন্থটির লাতিন অনুবাদের নাম ভারতীয় সংখ্যাপদ্ধতি সম্পর্কে আল-খাওয়ারিজমি। অ্যালগরিদম আসলে ‘আল-খাওয়ারিজম’-এর লাতিন রূপান্তর; কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গ এর বানান ও অর্থ পরিবর্তিত হয়। আল-খাওয়ারিজমির নাম থেকে উদ্ভূত আধুনিক ‘অ্যালগরিদম’ পরিভাষাটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।

বোন কম্পাগনি কর্তৃক ওপরের গ্রন্থটি ১১৫৭ খ্রিষ্টাব্দে লাতিন ভাষায় অনূদিত হয়। তারপর তা মধ্যযুগীয় ইউরোপে একটি জনপ্রিয় অঙ্কবিদ্যার পাঠ্যবই হয়ে ওঠে। এর একটি কপি আজও রোমে সংরক্ষিত আছে।

এই গ্রন্থের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো আরবি সংখ্যাপদ্ধতি ও ‘শূন্য’-এর ধারণা পাশ্চাত্য বিশ্বে প্রবেশ করে। এর ফলে মৌলিক অঙ্কবিদ্যা আধুনিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যবহারযোগ্য হয়ে ওঠে। পাটিগণিত ও বীজগণিত শাস্ত্রে আল-খাওয়ারিজমির কাজ এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে তাঁকে গণিতের এই গুরুত্বপূর্ণ শাখা দুটির পথিকৃৎ বললে অতিরঞ্জন হবে না।

আল-খাওয়ারিজমির বিদ্যাচর্চা পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে এতটাই প্রভাব বিস্তার করেছিল যে তিনি সমগ্র ইউরোপে অ্যালগরিদম নামে পরিচিত হন। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তাঁর লাতিনকৃত নাম পাশ্চাত্যে অ্যারেথমেটিক শব্দের সমার্থক হয়ে ওঠে। আজ অ্যালগরিদম বলতে বোঝানো হয় এমন একটি কৌশলকে বোঝায় যা কম্পিউটারবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে পুনরাবৃত্তিমূলক পদ্ধতি ব্যবহার করে বিশ্লেষণ সম্পন্ন করার জন্য ব্যবহৃত হয়।

আল-খাওয়ারিজমির রচনাগুলো তাঁর মৃত্যুর পর ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। তাঁর ভূগোল চতুর্দশ শতক পর্যন্ত ইসলামি জগতে প্রভাবশালী ছিল, যদিও পাশ্চাত্য মানচিত্র নির্মাতাদের ওপর অধিক প্রভাব ফেলেছিল টলেমির ভূগোল। তাঁর হিন্দু সংখ্যাপদ্ধতি-সম্পর্কিত গ্রন্থের মতো আল-জাব্‌র ওয়াল-মুকাবালাও লাতিনে অনূদিত হয় এবং পাশ্চাত্যের গণিতকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।

তাঁর জিজ ছিল সংশ্লিষ্ট বিষয়ের প্রথম রচনা যা লাতিনে অনূদিত হয়েছিল। জিজ-এর কিছু অংশ পরবর্তীকালে টলেডান টেবিলসে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, যা ইসলামি জ্যোতির্বিদদের রচনা থেকে সংগৃহীত বিভিন্ন জ্যোতির্বিদ্যার সারণির সমষ্টি ছিল। এই রচনা ইউরোপে ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে প্রভাব বিস্তার করে।

সূত্র: ঢাকা পোষ্ট

সর্বশেষ:

শিরোনাম: