মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

খাঁটি মুনাফিকের সঠিক পরিচয় কী?

খাঁটি মুনাফিকের সঠিক পরিচয় কী?

মুনাফিকি একটি মারাত্মক ব্যাধি। এ ব্যাধির কারণেই মানুষ ইসলাম থেকে দূরে সরে যায়। এর ক্ষতিকর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। মানুষের মনকে কলুষিত করার মারাত্মক ব্যাধি মুনাফিকি। কোনো মানুষই স্বেচ্ছায় মুনাফিক হয়ে যায় না, বরং মনের অজান্তেই তা আস্তে আস্তে তা প্রকাশ হতে থাকে। তাহলে খাঁটি মুনাফিকের সঠিক পরিচয় কী?

মুনাফিকের সঠিক পরিচয় ওসে এসেছে কোরআন সুন্নাহর দিক দিকনির্দেশনায়। যা ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হলো-
১. কোরআনের নির্দেশনা
কোরআনের আয়নায় মুনাফিক চেনার উপায় একেই বারেই সহজ। আল্লাহ তাআলা তাদের গতি প্রকৃতি এভাবে তুলে ধরেছেন-
وَإِذَا لَقُواْ الَّذِينَ آمَنُواْ قَالُواْ آمَنَّا وَإِذَا خَلَوْاْ إِلَى شَيَاطِينِهِمْ قَالُواْ إِنَّا مَعَكْمْ إِنَّمَا نَحْنُ مُسْتَهْزِئُونَ
‘আর তারা (মুনাফিক) যখন ঈমানদারদের সঙ্গে মিলিত হয়, তখন বলে আমরা ঈমান এনেছি। আবার যখন তাদের শয়তানদের (অবিশ্বাসীদের) সঙ্গে নির্জনে মিলিত হয়, তখন বলে আমরা তোমাদের সঙ্গেই আছি। আমরা তো (মুসলমানদের সঙ্গে) ঠাট্টা-বিদ্রেুাপ করি মাত্র।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৪)

মুনাফিকরা সংক্ষেপে নামাজ পড়ে। নামাজ আল্লাহর ভয় ও বিনয়-নম্রতা থেকে খালি হলে তা ধীর-স্থিরতার সঙ্গে আদায় করা বড়ই কঠিন হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন-
اِنَّ الۡمُنٰفِقِیۡنَ یُخٰدِعُوۡنَ اللّٰهَ وَ هُوَ خَادِعُهُمۡ ۚ وَ اِذَا قَامُوۡۤا اِلَی الصَّلٰوۃِ قَامُوۡا کُسَالٰی ۙ یُرَآءُوۡنَ النَّاسَ وَ لَا یَذۡکُرُوۡنَ اللّٰهَ اِلَّا قَلِیۡلًا
নিশ্চয়ই মুনাফিক (কপট) ব্যক্তিরা আল্লাহকে প্রতারিত করতে চায়। বস্তুত তিনি তাদেরকে ধোঁকায় ফেলেন এবং যখন তারা নামাজে দাঁড়ায় তখন শৈথিল্যের সঙ্গে নিছক লোক-দেখানোর জন্য দাঁড়ায় আর আল্লাহকে তারা (সংক্ষিপ্ত নামাজের মাধ্যমে) অল্পই স্মরণ করে থাকে।’ (সুরা নিসা : আয়াত ১৪২)

এ আয়াতের ভিত্তিতে নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘এটা মুনাফিকের নামাজ। এটা মুনাফিকের নামাজ, এটা মুনাফিকের নামাজ। সে বসে বসে সূর্যের অপেক্ষা করতে থাকে। অবশেষে যখন সূর্য শয়তানের দুইটি শিংয়ের মধ্যবর্তী স্থানে (অস্ত যাওয়ার কাছাকাছি সময়ে) পৌঁছে, তখন (তড়িঘড়ি) উঠে চারটি ঠোকর মেরে নেয়।’ (মুসলিম, মুয়াত্তা মালেক)

২. হাদিসের নির্দেশনায়
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যার মাঝে ৪টি অভ্যাস পাওয়া যাবে; সে নিখাদ মুনাফিক। এছাড়া যার মধ্যে এর কোনো একটি পাওয়া যায়, সে তা পরিত্যাগ না করা পর্যন্ত তার মধ্যে মুনাফিকের একটি অভ্যাস হিসেবে বিদ্যমান থাকে। অভ্যাস ৪টি হলো-
> কখনও আমানত রাখলে সে খেয়ানত করে।
> কথা বললে মিথ্যা বলে।
> প্রতিশ্রুতি দিলে ভঙ্গ করে এবং
> যখন কারও সঙ্গে ঝগড়া করে তখনই (নৈতিক ও সততার) সব সীমালঙ্ঘন করে।’ (বুখারি ও মুসলিম)

৩. নামাজে অলসতা
নামাজ ইসলামের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ রোকন ও ফরজ কাজ। এতেও তারা অবহেলা ও অলসতা প্রদর্শন করত। কারণ তাদের অন্তর ঈমান, আল্লাহভীতি এবং ঐকান্তিকতা থেকে ছিল বঞ্চিত ও শূন্য। বিশেষ করে তারা ইশা ও ফজরের নামাজকে ভারী মনে করে। হাদিসে এসেছে-
إِنَّ أَثْقَلَ صَلَاةٍ عَلَى الْمُنَافِقِينَ صَلَاةُ الْعِشَاءِ وَصَلَاةُ الْفَجْرِ
মুনাফিকদের উপর এশা এবং ফজরের নামাজ সব থেকে বেশি ভারী।’ (বুখারি ও মুসলিম)

মুনাফিকের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও চরিত্র
যুগে যুগে মুনাফিকের বৈশিষ্ট্য ও চরিত্র ছিল দ্বিমুখী। তারা যখন ইসলামের অনুসারীদের বিজয় দেখতো তখন তারা বলতো আমরা কি তোমাদের সঙ্গে ছিলাম না? আবার যখন অবিশ্বাসীরা কোনো কিছুতে বিন্দুমাত্র সফল হতো তখন তাদেরকেও এরকম কথা বলতো। মুনাফিকদের এ বৈশিষ্ট্যও আল্লাহ তাআলা কোরআনে এভাবে তুলে ধরেছেন-
الَّذِیۡنَ یَتَرَبَّصُوۡنَ بِکُمۡ ۚ فَاِنۡ کَانَ لَکُمۡ فَتۡحٌ مِّنَ اللّٰهِ قَالُوۡۤا اَلَمۡ نَکُنۡ مَّعَکُمۡ ۫ وَ اِنۡ کَانَ لِلۡکٰفِرِیۡنَ نَصِیۡبٌ ۙ قَالُوۡۤا اَلَمۡ نَسۡتَحۡوِذۡ عَلَیۡکُمۡ وَ نَمۡنَعۡکُمۡ مِّنَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ ؕ فَاللّٰهُ یَحۡکُمُ بَیۡنَکُمۡ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ ؕ وَ لَنۡ یَّجۡعَلَ اللّٰهُ لِلۡکٰفِرِیۡنَ عَلَی الۡمُؤۡمِنِیۡنَ سَبِیۡلًا
‘যারা তোমাদের (অমঙ্গলের) প্রতীক্ষায় থাকে; সুতরাং আল্লাহর অনুগ্রহে তোমাদের বিজয় হলে তারা (তোমাদেরকে) বলে, ‘আমরা কি তোমাদের সঙ্গে ছিলাম না?’ আর যদি অবিশ্বাসীদের আংশিক বিজয় লাভ হয়, তাহলে তারা (তাদেরকে) বলে, ‘আমরা কি তোমাদের বিরুদ্ধে জয়ী ছিলাম না এবং আমরা কি তোমাদেরকে বিশ্বাসীদের হাত থেকে রক্ষা করিনি? অতএব আল্লাহই কেয়ামতের দিন তোমাদের মধ্যে বিচার-মীমাংসা করবেন এবং আল্লাহ কখনই বিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে অবিশ্বাসীদের জন্য কোনো পথ রাখবেন না।’ (সুরা নিসা : আয়াত ১৪১)

مُّذَبۡذَبِیۡنَ بَیۡنَ ذٰلِکَ لَاۤ اِلٰی هٰۤؤُلَآءِ وَ لَاۤ اِلٰی هٰۤؤُلَآءِ ؕ وَ مَنۡ یُّضۡلِلِ اللّٰهُ فَلَنۡ تَجِدَ لَهٗ سَبِیۡلًا
‘(মুনাফিকরা) দোটানায় দোদুল্যমান; না এদের দিকে, না ওদের দিকে! আর আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন আপনি তার জন্য কখনো কোন পথ পাবেন না।’ (সুরা নিসা : আয়াত ১৪৩)

তাফসিরে তাবারিতে এসেছে, মুনাফিক নিজেকে মুশরিকও বলতে চায় না। আবার ঈমানদারও হতে চায় না। তাইতো প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উপমা তুলে ধরেছেন এভাবে- ‘মুনাফিকের উদাহরণ হচ্ছে, ঐ ছাগীর ন্যায়, যে দুই পাঠা ছাগলের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়। (প্রবৃত্তির তাড়নায়) কখনও এটার কাছে যায়, কখনও অপরটির কাছে যায়।’ (মুসলিম)

সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, মুনাফিকির সব চরিত্র থেকে নিজেদের বিরত রাখা। কোরআন-সুন্নায় ঘোষিত কঠিন পরিণাম থেকে মুক্ত থাকা। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে মুনাফিকির চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য থেকে মুক্ত থেকে জাহান্নামের কঠিন আজাব থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।

দৈনিক বগুড়া

সর্বশেষ: