শনিবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৫, ১ অগ্রাহায়ণ ১৪৩২

ফুটবল

হামজা একা কী করবেন

হামজা একা কী করবেন

সংগৃহীত

স্টেডিয়ামে তখন ম্যাচ চলছে। ঝড় বইছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। আনন্দে এই মূর্ছা যাওয়ার দশা তো কিছুক্ষণ পরই হতাশা। ভালো–মন্দ কথা মিলিয়ে সরগরম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। কত যে আশার সব কথা! আশার প্রদীপ নিভে যাওয়ার পরই আবার দপ করেই ভর করছে হতাশা।

আপনি বলবেন এটাই তো খেলাধুলার মজা। বিলক্ষণ তাই। কিন্তু বাংলাদেশের ফুটবল নিয়ে মানুষের আবেগের এ উত্থান–পতনের খেলায় মজে ওঠা একটু নতুন নতুন লাগে না? না, বাংলাদেশের মানুষ তো ফুটবলকে ভালোবাসেই। আর এই ভালোবাসার সম্পর্কটা অনেক অনেক প্রজন্ম ধরেই চলমান। পার্থক্যটা হলো সেই সম্পর্কে মাঝে একটা দীর্ঘ সময় শুধু হতাশা–ই জমা পড়েছে। মাঝেমধ্যে হয়তো দু–একটি জয়, বাদবাকি সময় হারই ছিল যেন নিয়তি।

হারেও সমস্যা তেমন ছিল না, কিন্তু খেলার ধরনটা চোখে বিঁধেছে অনেক দিন। জাতীয় পতাকার জন্য, দেশের জন্য লড়াইয়ের খিদেটা চোখে পড়েছে খুব খুব কমই। আর তাই কখনো কখনো বাংলাদেশ জিতলেও ৫৫ হাজার বর্গমাইলের এই জনবসতিকে একসঙ্গে জাগিয়ে তুলতে পারেনি সেসব জয়ও!

কিন্তু দেখুন কী কাণ্ড—নেপালের বিপক্ষে কাল প্রীতি ম্যাচে ২–২ গোলে ড্র করেছে বাংলাদেশ। জেতেনি, বলতে পারেন জয়ের আশা জাগিয়ে ড্র করেছে। তাতে হতাশা তো আছেই। কিন্তু সমর্থকদের সেই হতাশার মাঝেও কেমন যেন আশার সুর। যাহ, হলো না—এমন সব আক্ষেপ। কিন্তু সেই সময়ে বাংলাদেশ জিতলেও আশার কথা শোনা যেত খুব খুব কম। বাংলাদেশের ফুটবল আর কোনো দিন উঠে দাঁড়াতে পারবে না—এমন সব কথাই শোনা গেছে বেশি। এখন জিতলে তো কথাই নেই, হার কিংবা ড্রতেও সমর্থকেরা ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন ঠিকই, তবে আশাটাও রাখছেন। অর্থাৎ আশার অঙ্কুরোদগমটুকু ঘটেছে।

সেটা ঠিক কবে থেকে—সেই দিন–তারিখ স্পষ্ট করে বলা কঠিন। তবে সময়টা মনে করিয়ে দেওয়া যায়। ২০১৩ সালে জামাল ভূঁইয়া আসার পর কেউ কেউ আশার প্রদীপ জ্বেলেছিলেন। তখন আশার প্রদীপ জ্বলেছিল একটু। টেকেনি বেশি দিন। তারিক কাজী আসার পরও এমনটা হয়েছে। ফল পাল্টায়নি। কিন্তু এ বছর থেকে হামজা চৌধুরী, শমিত সোম, ফাহমিদুল আর জায়ানরা যোগ দেওয়ার পর বাতাস যেন পাল্টে গেল। আপনি জানেন তাঁরা সবাই বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত, বিদেশি লিগে খেলা, আর ঠিক সে কারণেই আশার প্রদীপটা জ্বলে উঠেছে বড় করে। আরও স্পষ্ট করে বললে হামজা সেই প্রদীপের মূল শিখা। ফুটবলের ভাষায় আগুন!

হামজা দীর্ঘদিন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে খেলেছেন, এখন খেলেন ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় বিভাগ চ্যাম্পিয়নসশিপে। বিশ্বের শীর্ষ লিগে খেলা ফুটবলার বাংলাদেশের জার্সিতে খেলেন—আগ্রহ জাগাতে শুধু এতটুকু তথ্যই তো যথেষ্ট। কিন্তু শুধু নাম দিয়ে তো আর বেশি দিন চলা যায় না। ভক্তদের মনে স্থায়ীভাবে আসন নিতে লাগে নিবেদন। গত মার্চে জাতীয় দলে হামজার অভিষেকের পর থেকে হামজার এই ব্যাপারটি যেন চোখে মায়াঞ্জন মেখে দিচ্ছে। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের মান থেকে বাংলাদেশের ফুটবল ঠিক কত ধাপ নিচে তা বলা কঠিন। কিন্তু হামজাকে দেখে মনে হয়, বাংলাদেশের জার্সিই যেন তাঁর মোক্ষধাম।

ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগজয়ী লেস্টার সিটির জার্সিতেও নিজেকে নিংড়ে দেন হামজা। কিন্তু সেটা শুধুই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডের জায়গাটুকু। কারণ লেস্টারে অন্য সব পজিশনে অন্তত বাংলাদেশ দলের চেয়ে ভালো ফুটবলার আছেন—এ কথায় নিশ্চয়ই কেউ আপত্তি করবেন না। বাংলাদেশের বাস্তবতা ভিন্ন—যেন মাঠে ১১ জন হামজা হলে ভালো হয়! সেটা যেহেতু সম্ভব না, হামজাকে তাই আসলে খেলতে হয় মাঠজুড়ে। এই রক্ষণে গোল ঠেকাচ্ছেন তো মাঝমাঠে খেলা বানাচ্ছেন আবার গোলও করছেন। কালকের জোড়া গোলে বাংলাদেশের হয়ে ৬ ম্যাচে হলো তাঁর চতুর্থ গোল। এই গোলগুলোর বাইরেও শুধু হামজা নয়, অন্য সবার খেলাও এখন মনে রাখছেন সমর্থকেরা। খেলা শেষে চলছে তাঁর চুলচেরা বিশ্লেষণ—গত বছরেও যা নিয়ে তেমন একটা আগ্রহ ছিল না সমর্থকদের।

কিন্তু এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রব উঠেছে, হামজা একা কী করবেন! কথাটা কি পরিচিত লাগছে? হামজার জায়গায় অন্য একজনের নাম বসালেই কিন্তু মিলে যায়। সে কথায় পরে আসা যাবে। আগে অন্য একটি বিষয় বলতেই হয়।

ফুটবল দলীয় খেলা। দুনিয়ার সবচেয়ে বড় তারকাও ধারাবাহিকভাবে একা সব ম্যাচ জেতাতে পারেন না। সেটা সম্ভব না। এ কারণে মাঠে বড় তারকাদের আশপাশে সমর্থন লাগে। এভাবে সাহায্য করা সেসব সতীর্থরাও একসময় বড় তারকা হয়ে ওঠেন। উদাহরণ চাইলে দেওয়া যায়। আর্জেন্টিনা জাতীয় দলে লিওনেল মেসির পাশে যেমন রদ্রিগো দি পল, এনজো ফার্নান্দেজ, অ্যালেক্সিস ম্যাক–অ্যালিস্টার। মেসিকে কেন্দ্র করে তাঁকে সাহায্য করতে করতে এসব খেলোয়াড়ও এখন বড় তারকা। ব্রাজিল কিংবা পর্তুগাল দলেও ব্যাপার একই।

আর্জেন্টিনা দলের কথা আলাদা করে বলার কারণ, গতকাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ওঠা ঝড়। নেপালের বিপক্ষে হামজাকে কখনো রক্ষণে, কখনো মাঝমাঠে, কখনো আবার আক্রমণভাগে দেখে দিশাহারা সমর্থক। দু–একজন তো ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের পার্ক জি সুংকেও স্মরণ করলেন। খেলোয়াড়ি জীবনে এই দক্ষিণ কোরিয়ানকে শুনতে হয়েছে, তাঁর নাকি ‘দুটো ফুসফুস।’ ক্লান্তিহীন দৌড়ের কারণে ইউনাইটেড সমর্থকদের এমন উক্তি। বাংলাদেশের সমর্থকেরাও কম যান না। লাল–সবুজের জার্সিতে এই পাঁচ ম্যাচেই হামজার গোটা মাঠে ক্লান্তিহীন দৌড় দেখে কাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন মন্তব্যও চোখে পড়েছে, ‘হামজার তিনটি ফুসফুস। একটি নিজের, অন্য দুটি বাংলাদেশের জন্য।’

চিকিৎসাবিজ্ঞানের চোখে এই মন্তব্য ঠিক না ভুল, তা যাচাইয়ের প্রয়োজন নেই। আবেগটা বুঝুন। লেস্টার যেন এখানে ‘বহিরাগত।’ হ্যাঁ, হামজা লেস্টারের হয়েও নিজেকে নিংড়ে দেন। কিন্তু বাংলাদেশের জার্সিতে নিংড়ে দেওয়ার পরও যদি কিছু অবশিষ্ট থাকে—হামজা সেটুকুও মাঠে রেখে আসছেন। তবু কি প্রত্যাশিত ফলটা মিলছে? অবশ্যই না। শেষ মুহূর্তে নিজেদের ভুলে গোল হজম করে হার কিংবা ড্র এখন প্রায় অভ্যাস বানিয়ে ফেলেছে বাংলাদেশ। কালও একই কায়দায় সমতায় ফিরতে বাধ্য হওয়ার পর হামজার ছলছল চোখ দুটো নিশ্চয়ই টিভি পর্দায় দেখেছেন? তখন কি মনে হয়েছে, হামজা একা কী করবেন!

বাংলাদেশের ফুটবল সমাজে ‘একা কী করবেন’ উক্তিটি বেশ পরিচিত। একসময় আর্জেন্টিনার ম্যাচ শেষে লিওনেল মেসিকে নিয়ে ফেসবুক সয়লাব হতো এই স্ট্যাটাসে—মেসি একা কী করবেন! শুধু বাংলাদেশ কেন, ফুটবলের বড় বড় বিশ্লেষকেরাও একটা সময় একই কথা বলেছেন আর্জেন্টিনার ম্যাচ শেষে মেসিকে নিয়ে।

যে আক্ষেপ থেকে মেসিকে নিয়ে বাংলাদেশের আর্জেন্টিনা সমর্থকেরা কিংবা বিশেষজ্ঞরা এই কথা বলতেন, হামজার বিষয়েও গোটা বাংলাদেশের অনুভূতিটা ঠিকই একই রকম। একটা মানুষ আর কয় জায়গায় সামাল দেবেন! তবু সেটুকু সাধ্যমতো করার পর যখন ফলটা মেলে না, তখন ছলছল ওই চোখ দুটো দেখে আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন। যেমনটা হয়েছে একসময় মেসির ছলছল চোখ দেখেও। রদ্রিগো দি পল, এনজোরা আসার আগে মাঠে মেসি ১১০ শতাংশ দিলেও সতীর্থদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত সাহায্যটুকু সেভাবে পাননি। ফল? হারতে হারতে একসময় সবারই মন উঠে যায়।

মেসিও কিন্তু একবার অভিমানে আর্জেন্টিনা দলের জার্সি তুলে রেখেছিলেন। পরে অনেক বুঝিয়ে–সুঝিয়ে মেসিকে ফেরানো হলো। কোচ পাল্টাল সঙ্গে খেলোয়াড়ও। বাকিটা আপনি জানেন। তবে এটুকু পড়ে মনের ভেতর কু–ডাকটা এখন নিশ্চয়ই জেগে উঠেছে—হামজাও যদি এভাবে হোঁচট খেতে খেতে অভিমানে...!

থাক, ওই পর্যন্ত এখনই ভাবার প্রয়োজন নেই। কারণ, হামজা এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের জার্সিতে ‘আজ আমরা উইন খরমু’ মানসিকতা নিয়েই মাঠে নামছেন। আর সেই মনের জোরে তিনি কী করছেন, তা তো কালই পরিষ্কার হয়ে গেল। আচ্ছা বলুন তো, বাংলাদেশের জার্সিতে সর্বশেষ কবে পেনাল্টিতে ‘পানেনকা’ শটে গোল দেখেছেন? ওভারহেড কিকে গোল দেখেছেন সর্বশেষ কবে?

নিশ্চিত করে বলা যায়, পেছনে তাকিয়ে খুঁজতে খুঁজতে কেউ কেউ হয়তো নব্বই, আশি কিংবা সত্তর দশকে ফিরে গেছেন। তবু কি খুঁজে পাওয়া গেল? এই দেশের ফুটবলে একটা পানেনকা শটে গোল দেখাটাই যেখানে ‘কোহিনুর’ হীরার মতো বিরল, সেখানে এক ম্যাচেই পানেনকা ও ওভারহেড কিকে গোলকে কী বলবেন—‘কোহিনূর’ ও ‘দরিয়া–ই–নুর’?

যা খুশি বলতে পারেন। যা খুশি ভাবতে পারেন। এখন সময়টাই আসলে তাই। উত্তুরে হাওয়া নিয়ে শীতের আমেজ চলে এলেও দেশের ফুটবলে আসলে ঝিরঝির করে দখিনা হাওয়া বইছে। সেই হাওয়া যে বা যাঁরা নিয়ে এলেন, তাঁরা আসলে পরিবর্তনের দূত—যেটার আশায় একসময় আপনার বছরের পর বছর কেটেছে। কৈশোর থেকে যুবা হয়েছেন, তারপর দাড়িতেও হয়তো পাক ধরেছে—তবু যখন কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না, ঠিক তখনই তাঁরা একের পর এক আসতে শুরু করলেন। আর তাতে পাল্টে যাচ্ছে বাংলাদেশের ফুটবলের সংস্কৃতিও।

এই তো গত পরশু পর্যন্তও ওভারহেড কিক কিংবা পানেনকা শটে গোলের কথা এলে আপনার কণ্ঠে উঠে আসত ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, লিওনেল মেসি, কিলিয়ান এমবাপ্পেদের নাম।
এখন?

সূত্র: প্রথম আলো

সর্বশেষ:

শিরোনাম: