গতকাল রাতের এক বৃষ্টিতে ঢাকাবাসী ভয়াবহ এক ঘটনার সাক্ষী হলো। মিরপুরের ঢাকা কমার্স কলেজ সংলগ্ন ঝিলপাড় বস্তির সামনের রাস্তায় জমে থাকা পানিতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে প্রাণ গেছে একই পরিবারের তিনজনসহ চারজনের। অলৌকিকভাবে বেঁচে গেছে পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য ৭ মাসের শিশু হোসাইন।
গতকাল রাতে ওই রাস্তায় জমে থাকা পানির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলেন মিজান (৩০) ও তার স্ত্রী মুক্তা বেগম (২৫)। সঙ্গে ছিল মেয়ে লিমা (৭) ও ছেলে হোসাইন। হঠাৎ করে তারা পড়ে গেলে তাদের তুলতে এগিয়ে আসেন অনিক নামে একজন অটোরিকশাচালক। হোসাইনকে তিনি পানি থেকে তুলে দিতে পারলেও লিমাকে তুলতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে তিনিও চলে গেছেন না ফেরার দেশে।
যেভাবে বেঁচে গেল সাত মাসের হোসাইন গতকালের মর্মান্তিক ঘটনায় সাত মাসের শিশু হোসাইনের বাবা, মা, বোন ও তাকে বাঁচাতে আসা অনিক নিহত হয়েছেন। স্থানীয়রা বলছেন, অনেকটা অলৌকিকভাবে বেঁচে যায় শিশু হোসাইন। তারা বলছেন মায়ের কোলে থেকে ছিটকে পড়ে যাওয়ায় প্রাণে রক্ষা পায় শিশু হোসাইন।
শনিবার সকালে শিশু হোসাইনকে নিয়ে মিরপুর মডেল থানায় আসেন আমেনা বেগম নামে এক নারী। সেখানে তিনি শিশু হোসাইনের বেঁচে যাওয়া ঘটনার বর্ণনা করেন ঢাকা পোস্টকে। তিনি বলেন, হোসাইনের মা যখন পানিতে পড়ে যায় তখন, হোসাইন মায়ের কোল থেকে ছিটকে পড়ে যায় পানিতে। এ সময় অনিক সঙ্গে সঙ্গে এসে হোসাইনকে পানি থেকে তুলে আমার কোলে দেয়। পরে আমি তাকে আমার বাসায় নিয়ে প্রথমে শরীরে গরম তেল দেই। এরপর তাকে নিয়ে যায় প্রথমে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখান থেকে ডাক্তার হোসাইনকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলে। রাতে তাকে সেখানে নিয়ে যায়, চিকিৎসার পর সকালে ডাক্তার বলে হোসাইন এখন সুস্থ, তাকে বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। পরে আমি জানতে পারি হোসাইনের দাদা ও নানা মিরপুর মডেল থানায় আছে, তখন আমি এখানে আসি।
আমেনা বেগম আরও বলেন, হোসাইনকে অনিকের মাধ্যমে আল্লাহ বাঁচিয়েছেন। না হলে একই ঘটনায় তার মা-বাবা ও বোন এবং অনিক মারা গেছে, তার তো বাঁচার কথা ছিল না। এখন হোসাইনকে কোলে নেওয়ার বা দেখাশোনার লোক নেই। হোসাইনের নানা ও দাদা তার মা, বাবা ও বোনের মরদেহ নেওয়ার জন্য থানা ও হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি করছে। তাই আমি তাকে আপাতত দেখাশোনা করছি৷ তাদের কাজ শেষ হলে আমি হোসাইনকে তার নানা ও দাদার কাছে বুঝিয়ে দেব।
মিজানের স্বজন ও স্থানীয়দের সূত্রে জানা যায়, মিজানের গ্রামের বাড়ি বরিশালের ঝালকাঠিতে। সে গত কয়েক বছর ধরে পরিবার নিয়ে মিরপুর চিড়িয়াখানা রোডে বসবাস করে একটি ভাড়া বাসায়। মিজান মিরপুর এলাকায় ভাসমান দোকানে শরবত বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। গতকাল রাতে তিনি স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে ঝিলপাড় বস্তিতে শ্বশুরবাড়িতে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে নিজ বাসায় ফেরার পথে প্রাণ গেল তাদের।
মিজানের বাবা নাসির হাওলাদার বলেন, আমার দুই ছেলে ও এক মেয়ে। মিজান আমার মেজ ছেলে। পরশুদিন সকালে তারা ঝালকাঠি থেকে ঢাকায় আসে। তাদের এই অকাল মৃত্যু কোনোভাবে আমরা মেনে নিতে পারছি না। মাত্র এক দিন আগে ছেলে আমার ঢাকায় এসেছিল বৌ-বাচ্চা নিয়ে। এই দেখা যে শেষ দেখা হবে আমি কোনো দিন ভাবিনি।
মিজানের স্ত্রী মুক্তার বাবা মো.মহফিজ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার মেয়ে ও জামাই নাতি-নাতিনকে নিয়ে রাতে বাসা থেকে খেয়ে বের হয়। এই বের হওয়া যে শেষ তা জানলে তাদের কোনো দিন ছাড়তাম না। এই মৃত্যু মানতে পারছি না। আমার নাতিটার কী হবে। মাত্র সাত মাস বয়সে সে মা-বাবাকে হারিয়েছে। তার কী হবে এখন।
অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগেই কি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা?
স্থানীয় সূত্র জানা যায়, ঝিলপাড় বস্তিকে কেন্দ্র করে বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগের রমরমা ব্যবসা চলে আসছে বহুদিন ধরে। গতকালের মর্মান্তিক এই ঘটনাটিও এই অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগের কারণে ঘটেছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।
স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলছেন, গতকালকের ঘটনাটি ঘটে ঝিলপাড় বস্তির বিপরীত পাশের রাস্তায়। এই বিপরীত পাশের রাস্তার বিদ্যুতের খুঁটি থেকে অনেক অবৈধ সংযোগ বস্তিতে গেছে। গতকাল বৃষ্টি ও বাতাসের কারণে একটি অবৈধ সংযোগের লাইন রাস্তায় পড়ে। রাস্তায় যখন জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে যায় তখন আর ওই তারটি দেখা যায়নি। আর সেই লাইনেই বিদ্যুতায়িত হয়ে মারা যায় এই চারজন।
এ বিষয়ে স্থানীয় বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, গতকালকের ঘটনাটি অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগের কারণে ঘটেছে। বস্তিতে অনেক অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ রাস্তার এইপার থেকে নেওয়া। গতকাল এসব অবৈধ সংযোগ লাইনের মধ্যে থেকে একটি ছিড়ে পানিতে পড়ে যায়। রাস্তায় জলাবদ্ধতার কারণে এই লাইনটি দেখা যায়নি। আর ফলে এই লাইনে বিদ্যুতায়িত হয়ে তরতাজা চারটি প্রাণ ঝরে যায়। আমরা দাবি জানাচ্ছি এ অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগের সাথে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে যেন প্রশাসন কঠোর ব্যবস্থা নেয়।
এ বিষয়ে মিরপুর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ মহসীন ঢাকা পোস্টকে বলেন, অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগের বিষয়টি আমরা জানতে পেরেছি। এ বিষয়ে আমাদের তদন্ত চলমান রয়েছে। এ ছাড়া নিহতের স্বজনরা আমাদের কাছে একটি অভিযোগ করেছে। অবহেলিতজনিত মৃত্যুর বিষয়ে। অভিযুক্তি মামলা আকারের দায়েরের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ থেকে শুরু করে এই মৃত্যুর পেছনে কারো কোন দায় আছে কি না সেটি আমরা তদন্ত করে দেখব। তদন্ত কারো দায় পেলে আমরা যথাযোগ্য আইনি প্রক্রিয়া গ্রহণ করব।
দৈনিক বগুড়া