
সংগৃহীত
২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচন সামনে রেখে দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নতুন নতুন কৌশল প্রণয়ন করছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। বিশেষ করে আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনী নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায় সরকার। সেই লক্ষ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিশেষ কিছু কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।
সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো— পূর্ববর্তী নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করা কোনো কর্মকর্তাকে এবার আর দায়িত্ব না দেওয়া, দেশের সব ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় আনার পাশাপাশি রাজনৈতিক পক্ষপাত ছাড়াই সব সংস্থাকে সমন্বিতভাবে কাজ করার আহ্বান জানানো; পাশাপাশি নির্বাচনের আগে বেহাত হওয়া সব অস্ত্র উদ্ধার এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিদ্বেষমূলক অপপ্রচার প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ।
সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে এসব বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সভায় সভাপতিত্ব করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্র সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শকসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানরা।
অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে নতুন পরিকল্পনা, ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রগুলোতে বাড়ছে গোয়েন্দা নজরদারি ও সিসিটিভি ক্যামেরা / ছবি- সংগৃহীত
বিজ্ঞাপন
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষভাবে নিশ্চিত করতে ৩১ ডিসেম্বর ডেডলাইন নির্ধারণ করা হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে নির্বাচনের সব প্রস্তুতি শেষ করতে বলা হয়েছে। একইসঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে সদস্য নিয়োগ ও পাসিং আউট কার্যক্রমও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ করতে বলা হয়েছে
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্বাচনের আগে বেহাত হওয়া অস্ত্র উদ্ধার সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ, আগে একাধিকবার উদ্যোগ নিলেও সেগুলো আর আলোর মুখ দেখেনি। নির্বাচনের সময় সংঘর্ষ বা সন্ত্রাসী কার্যক্রম সাধারণত অস্ত্রনির্ভর হয়ে থাকে। যেহেতু এখনো বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ বেহাত রয়েছে এবং সেগুলো উদ্ধার না হলে সব প্রস্তুতি সত্ত্বেও সহিংসতা ঠেকানো কঠিন হবে।
ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র থাকবে কঠোর নজরদারিতে
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, নির্বাচন নির্বিঘ্ন করতে সরকার গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানোর পাশাপাশি প্রযুক্তিগত বেশকিছু উদ্যোগ নিচ্ছে। দেশের সব ঝুঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্রের তালিকা করে সেগুলো বিশেষ নজরদারির আওতায় আনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এজন্য কেন্দ্রগুলোতে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন ও কার্যকর মনিটরিং ব্যবস্থা গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনকেও অবহিত করা হয়েছে এবং একটি কেন্দ্রীয় মনিটরিং সেন্টার স্থাপন করতে বলা হয়েছে। এছাড়া, জেলাপর্যায়েও রাখা হচ্ছে মনিটরিং ব্যবস্থা।
দায়িত্ব পাবেন না গত নির্বাচনে দায়িত্বপালনকারীরা
সভায় সিদ্ধান্ত হয়, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের বিতর্কিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দায়িত্বপালনকারী ব্যক্তিদের আসন্ন নির্বাচনে কোনো দায়িত্ব দেওয়া হবে না। এর আগে গত তিন নির্বাচনে দায়িত্বপালন করা কর্মকর্তাদের তথ্য চেয়ে বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকদের চিঠি দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এদিকে, নির্বাচনের অনিয়ম পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে খতিয়ে দেখতে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের তথ্য চেয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন। সভায় এসব বিষয়ে নির্বাচন কমিশন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ ও পুলিশ অধিদপ্তরকে কাজ করতে বলা হয়েছে।
নির্বাচনী সহিংসতা ঠেকাতে সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ বেহাত হওয়া অস্ত্র উদ্ধার। পুরস্কার ঘোষণার মাধ্যমে তথ্যদাতাদের উৎসাহিত করা হচ্ছে / ছবি- সংগৃহীত
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখতে বাড়ছে গোয়েন্দা নজরদারি
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যাতে অবনতি না ঘটে সেজন্য গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর- ডিজিএফআই, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা- এনএসআই এবং পুলিশের বিশেষ শাখা- এসবিকে নজরদারি বাড়ানো এবং সম্ভাব্য ঝুঁকির বিষয়ে সজাগ থাকতে বলা হয়েছে। নির্বাচন ঘিরে বিশেষ এই নিরাপত্তা ব্যবস্থার অংশ হিসেবে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ, পুলিশ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড, আনসার ও ভিডিপি এবং বিজিবিকেও সহায়তা করার কথা বলা হয়েছে সভায়।
বিদ্বেষমূলক প্রচারণায় নজরদারি
সভায় নির্বাচনের আগে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক প্রচারণা থেকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। নির্বাচনপূর্ব ও নির্বাচনকালীন সব সংস্থাকে একসঙ্গে ও নিরপেক্ষভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার কথা বলা হয়েছে। এ বিষয়ে গোয়েন্দা সংস্থাকে তৎপর থেকে তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণপূর্বক ঝুঁকি বিবেচনা করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ, একইসঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও কঠোর মনিটরিংয়ের আওতায় আনার কথা বলা হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, নির্বাচন নির্বিঘ্ন করতে সরকার গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানোর পাশাপাশি প্রযুক্তিগত বেশকিছু উদ্যোগ নিচ্ছে। দেশের সব ঝুঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্রের তালিকা করে সেগুলো বিশেষ নজরদারির আওতায় আনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এজন্য কেন্দ্রগুলোতে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন ও কার্যকর মনিটরিং ব্যবস্থা গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনকেও অবহিত করা হয়েছে এবং একটি কেন্দ্রীয় মনিটরিং সেন্টার স্থাপন করতে বলা হয়েছে
নির্বাচনের আগে প্রস্তুতিমূলক দুই মহড়া
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দুটি পৃথক প্রস্তুতিমূলক মহড়া পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ, পুলিশ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড, আনসার, বিজিবি ও র্যাবকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সব নির্বাচনী প্রস্তুতি শেষ করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে সরকার, জোর দেওয়া হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রশিক্ষণ মহড়ায় / ছবি- সংগৃহীত
এই মহড়ার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট এলাকায় কোন ধরনের ঝুঁকি বা সংঘাত হতে পারে তা পর্যালোচনা, ঝুঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্র চিহ্নিত করা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কীভাবে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, আনসার, কোস্ট গার্ড সমন্বয় করবে তার পরিকল্পনা, মোবাইল টিম, স্ট্রাইকিং ফোর্স ও টহল টিম কীভাবে কাজ করবে তার নির্দেশনা পাওয়া যাবে। এছাড়া, কোন এলাকায় কতজন পুলিশ/আনসার সদস্য থাকবেন, কোথায় বিজিবি মোতায়েন হবে— এসব নির্ধারণ করার একটি রোডম্যাপ তৈরি করা হবে। নির্বাচন কমিশনের প্রতিনিধি, জেলা প্রশাসন ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যে তথ্য শেয়ারিং, সম্ভাব্য নাশকতা বা সহিংসতা প্রতিরোধে গোয়েন্দা রিপোর্ট পর্যালোচনা, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের ভোটকেন্দ্রে আচরণবিধি, অস্ত্র ব্যবহার, জননিরাপত্তা নিশ্চিতের বিষয়ে ব্রিফিং এবং জরুরি পরিস্থিতিতে কে কাকে রিপোর্ট করবে এবং কীভাবে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে সেজন্য যোগাযোগ কাঠামো চূড়ান্ত করা হবে।
প্রস্তুতির ডেডলাইন ৩১ ডিসেম্বর
সভায় সিদ্ধান্ত হয়, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষভাবে নিশ্চিত করতে ৩১ ডিসেম্বর ডেডলাইন নির্ধারণ করা হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে নির্বাচনের সব প্রস্তুতি শেষ করতে বলা হয়েছে। একইসঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে সদস্য নিয়োগ ও পাসিং আউট কার্যক্রমও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ করতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে পুলিশ অধিদপ্তর, আনসার, বিজিবি ও কোস্ট গার্ডকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে মাঠপর্যায়ে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও ওসিদের নিরপেক্ষভাবে কাজ করার নির্দেশ দিতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে একটি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের বিতর্কিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দায়িত্বপালনকারী ব্যক্তিদের আসন্ন নির্বাচনে কোনো দায়িত্ব দেওয়া হবে না। এর আগে গত তিন নির্বাচনে দায়িত্বপালন করা কর্মকর্তাদের তথ্য চেয়ে বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকদের চিঠি দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এদিকে, নির্বাচনের অনিয়ম পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে খতিয়ে দেখতে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের তথ্য চেয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন
নির্বাচনের আগে বড় চ্যালেঞ্জ অস্ত্র উদ্ধার
সভা সূত্রে জানা যায়, গত বছরের ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এজন্য সংশ্লিষ্টদের একাধিকবার নির্দেশনা দেওয়া হয়। কিন্তু কোনো কার্যকর ফল পাওয়া যায়নি। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে গত এক বছরে ‘ডেভিল হান্ট’ নামে বিশেষ অভিযান চালায় সরকার। এরপরও লুণ্ঠিত অস্ত্র ও গোলাবারুদের বড় অংশ রয়ে যায় অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণে। আশানুরূপ ফলাফল না আসায় অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে অব্যাহত তৎপরতা চলছে।
পূর্ববর্তী নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী বিতর্কিত কর্মকর্তাদের বাদ দিয়ে নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে চাইছে সরকার / ছবি- সংগৃহীত
দেশে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসেও যৌথ বাহিনীর অভিযান পরিচালনা করা হয়। এর আগে সব ধরনের অস্ত্র জমা দেওয়ার সময়সীমাও বেঁধে দেয় সরকার। গত বছরের সেপ্টেম্বরে বিগত ১৫ বছরে বেসামরিক জনগণকে দেওয়া আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্সও স্থগিত করে সরকার। সেই সময় গোলাবারুদসহ এসব আগ্নেয়াস্ত্র সংশ্লিষ্ট থানায় জমা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়; কিন্তু এসবের কিছুই সফলতা আনতে পারেনি।
তবে, এবার নির্বাচনের আগে এসব অস্ত্র উদ্ধারে জোরেশোরে উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। এদিকে মন্ত্রণালয় ও পুলিশ অধিদপ্তর সূত্র বলছে, গত বছর ৫ আগস্টের পর থেকে এখন পর্যন্ত বেহাত রয়েছে এক হাজার ৩৬৩টি আগ্নেয়াস্ত্র এবং দুই লাখ ৫৭ হাজার ৭২০ রাউন্ড গুলি। গত বছর আগস্টে ৪৬০টি থানায় হামলায় লুট হয় পাঁচ হাজার ৭৫৩টি অস্ত্র ও ছয় লাখ ৫১ হাজার ৮৩২ রাউন্ড গুলি। এর মধ্যে উদ্ধার হয়েছে চার হাজার ৩৯০টি অস্ত্র ও তিন লাখ ৯৪ হাজার ১১২ রাউন্ড গুলি। এ অবস্থায় অস্ত্র উদ্ধারে তথ্যদাতাদের জন্য সরকার পুরস্কার ঘোষণা করেছে। প্রতিটি পিস্তল বা শটগানের জন্য ৫০ হাজার, চায়না রাইফেলের জন্য এক লাখ, এসএমজির জন্য এক লাখ ৫০ হাজার, এলএমজির জন্য পাঁচ লাখ এবং প্রতিটি রাউন্ড গুলির জন্য ৫০০ টাকা দেওয়া হবে।
নির্বাচনের আগে চুরি-ছিনতাই বন্ধে জোরালো পদক্ষেপ
নির্বাচনের আগে দেশের সামগ্রিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, দখলবাজি ও সংঘবদ্ধ দুষ্কৃতিকারীদের কর্মকাণ্ড রোধে জোরালো পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার। সভা সূত্র বলছে, নির্বাচনের আগে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে চুরি-ডাকাতি রোধ এবং জনগণের জানমালের নিরাপত্তায় সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ, পুলিশ অধিদপ্তর, কোস্ট গার্ড, বিজিবি ও সব গোয়েন্দা সংস্থাকে একযোগে কাজ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া, নির্বাচনের আগে মব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে দল, মত, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে দ্রুত ও যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচার রোধে কঠোর নজরদারি, তৈরি করা হচ্ছে ‘কাউন্টার ন্যারেটিভ’ কৌশল / ছবি- সংগৃহীত
সভায় নির্বাচনের আগে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক প্রচারণা থেকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। নির্বাচনপূর্ব ও নির্বাচনকালীন সব সংস্থাকে একসঙ্গে ও নিরপেক্ষভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার কথা বলা হয়েছে। এ বিষয়ে গোয়েন্দা সংস্থাকে তৎপর থেকে তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণপূর্বক ঝুঁকি বিবেচনা করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ, একইসঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও কঠোর মনিটরিংয়ের আওতায় আনার কথা বলা হয়েছে
অপপ্রচার রোধে কাউন্টার ন্যারেটিভ
নির্বাচনের আগে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অসত্য ও ভিত্তিহীন তথ্যের (অডিও-ভিডিও) প্রচার বেড়ে যায়। এসব অপপ্রচার রোধে কাউন্টার ন্যারেটিভ প্রস্তুত করে প্রতিটি বিভাগ বা সংস্থার নিজস্ব মুখপাত্রের মাধ্যমে প্রকৃত ঘটনা দেশবাসীকে জানানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়, এনটিএমসি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া, অনলাইনে জুয়ার সব সাইট বন্ধ এবং এর সঙ্গে জড়িত সংঘবদ্ধ চক্রগুলোর বিরুদ্ধে অতিদ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলার রোডম্যাপ ‘ইতিবাচক’ উদ্যোগ
নির্বাচনের আগে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের এসব উদ্যোগ নিয়ে কথা হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সরকার যে আইনশৃঙ্খলার রোডম্যাপ তৈরি করেছে তা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক উদ্যোগ। বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র চিহ্নিত করে সেখানে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো, মনিটরিং সেল গঠন এবং দুই দফা মহড়া— এসব পদক্ষেপ নির্বাচনের সময় শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সহায়ক হবে। তবে, অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে কেবল নীতিগত সিদ্ধান্তই যথেষ্ট নয়। মাঠপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে না পারলে ভোটারদের মধ্যে আস্থার যে সংকট তা দূর হবে না।’
নির্বাচনকে সামনে রেখে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও দখলবাজি রোধে প্রয়োজন জোরদার অভিযান / ছবি- সংগৃহীত
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিদ্বেষমূলক প্রচারণা। প্রযুক্তিগত নজরদারি জরুরি হলেও সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে মনে রাখতে হবে যে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সীমা অতিক্রম করলে তা উল্টো অবিশ্বাস ও অস্থিরতা তৈরি করতে পারে। তাই ‘অপপ্রচার রোধ’ আর ‘সমালোচনার স্বাধীনতা’— দুটোর মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবেমো. সাখাওয়াত হোসেন, সহকারী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “এটি প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করা হলেও বাস্তবে এই অভিযান কতটা সফল হয় সেটিই এখন বড় প্রশ্ন! এখনো বিপুল পরিমাণ অস্ত্র বেহাত আছে। সেগুলো নির্বাচনের সময় সংঘর্ষে ব্যবহৃত হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিদ্বেষমূলক প্রচারণা। প্রযুক্তিগত নজরদারি জরুরি হলেও সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে মনে রাখতে হবে যে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সীমা অতিক্রম করলে তা উল্টো অবিশ্বাস ও অস্থিরতা তৈরি করতে পারে। তাই ‘অপপ্রচার রোধ’ আর ‘সমালোচনার স্বাধীনতা’— দুটোর মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে।”
অস্ত্র উদ্ধার না হলে সহিংসতা ঠেকানো কঠিন হবে
অবৈধ ও বেহাত হওয়া অস্ত্র উদ্ধার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সরকার মুহাম্মদ শামসুদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘নির্বাচনকালীন নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ, নির্বাচনের সময় সংঘর্ষ বা সন্ত্রাসী কার্যক্রম সাধারণত অস্ত্রনির্ভর হয়ে থাকে। পরিসংখ্যান বলছে, এখনো বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ বেহাত রয়েছে। এগুলো উদ্ধার না হলে সব প্রস্তুতি সত্ত্বেও সহিংসতা ঠেকানো কঠিন হবে।’
নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, সরকারের এসব উদ্যোগ ইতিবাচক হলেও মাঠপর্যায়ে নিরপেক্ষতা ও সমন্বয় নিশ্চিত করাই আসল চ্যালেঞ্জ
‘অতীতে আমরা দেখেছি, শুধু বিশেষ অভিযান বা সময়সীমা বেঁধে অস্ত্র জমা দেওয়ার নির্দেশ দিলেই কাজ হয়নি। অস্ত্র উদ্ধারে চাই গোয়েন্দা তথ্যনির্ভর অভিযান, স্থানীয়ভাবে তথ্যদাতাদের সক্রিয় করা এবং সীমান্তে নজরদারি বাড়ানো। এবার সরকার যে পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছে তা কার্যকর হতে পারে। তবে, বাস্তবে মাঠপর্যায়ে এটির প্রয়োগ নিশ্চিত করাই আসল কাজ।’
নির্বাচনকালীন নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ, নির্বাচনের সময় সংঘর্ষ বা সন্ত্রাসী কার্যক্রম সাধারণত অস্ত্রনির্ভর হয়ে থাকে। পরিসংখ্যান বলছে, এখনো বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ বেহাত রয়েছে। এগুলো উদ্ধার না হলে সব প্রস্তুতি সত্ত্বেও সহিংসতা ঠেকানো কঠিন হবেব্রি. জেনারেল (অব.) সরকার মুহাম্মদ শামসুদ্দিন, নিরাপত্তা বিশ্লেষক
‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে সমন্বয়ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ’— উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, আনসার বা সেনাবাহিনী— যে সংস্থা যেভাবে দায়িত্ব পাবে, তাদের মধ্যে তথ্য আদান–প্রদান ও দ্রুত রেসপন্স নিশ্চিত করা না হলে হঠাৎ সহিংস পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না। মহড়ার পরিকল্পনা ভালো উদ্যোগ, তবে এটি কেবল আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ না রেখে মাঠপর্যায়ে বাস্তব অনুশীলন হওয়া জরুরি।’
আরেকটি বিষয় হলো মাঠ প্রশাসনের নিরপেক্ষতা। অতীতে দেখা গেছে, কিছু জায়গায় প্রশাসনের পক্ষপাতিত্ব নির্বাচনী সহিংসতা বাড়িয়েছে। তাই এবার জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও ইউএনওদের ওপর বিশেষভাবে নজরদারি দরকার, যেন তারা কোনো রাজনৈতিক চাপ ছাড়াই কাজ করতে পারেন— উল্লেখ করেন এই নিরাপত্তা বিশ্লেষক।
সূত্র: ঢাকা পোষ্ট