শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২৯ ভাদ্র ১৪৩২

নীল জলের দ্বীপে বীরশ্রেষ্ঠর স্মৃতি

নীল জলের দ্বীপে বীরশ্রেষ্ঠর স্মৃতি

সংগৃহীত

চারদিকে কাপ্তাই হ্রদের নীল জল, মাঝখানে ছোট্ট একটি দ্বীপ। সেই দ্বীপেই শায়িত আছেন বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্সনায়েক মুন্সি আব্দুর রউফ। তাঁর স্মৃতিতেই দ্বীপে নির্মাণ করা হয়েছে স্মৃতিসৌধ। সাদা রঙের বেদির ওপর সমাধিফলক এবং পাশে রাইফেলের ভাস্কর্যের এই সৌধ দেখতে দেশের নানান প্রান্ত থেকে ভিড় করেন বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ।

রাঙামাটির নানিয়ারচরের এই স্মৃতিসৌধে যাওয়ার পথে দেখা মেলে শরতের মেঘ, হ্রদের বুকে ছুটে চলা নৌকা, জেলেদের জাল ফেলার দৃশ্য ও দ্বীপের পাশে থাকা গ্রাম আর সবুজ পাহাড়। যা দেখে যে কারও মন জুড়াবে। পথে পথে আনারসের বাগান, পাহাড়ের ঢালে জুমচাষ আর অচেনা পাখির কূজন ভালো লাগবে না এমন ভ্রমণপ্রেমীর দেখা পাওয়া মুশকিল।

নানিয়ারচরের সেতুঘাট থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় সমাধিতে যাওয়াটাই সবচেয়ে সহজ রাস্তা। এর বাইরে কাপ্তাই লেকের অন্য প্রান্ত থেকেও নৌকা দিয়ে যে কেউ যেতে পারেন সেখানে।

যেমন দেখা গেল

সম্প্রতি স্মৃতিসৌধটি সরেজমিনে দেখা হয়। সেখানে পৌঁছাতেই হ্রদের ঢেউয়ের শব্দের সঙ্গে শোনা যায় দূরে পাখির ডাক। স্মৃতিসৌধ দেখতে হাজির হয়েছেন অনেক পর্যটক। তাঁদের কেউ সমাধির পাশে বসে রয়েছেন, আবার কেউ ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন। সমাধিফলকের খোদাই করা ‘তুমি দুর্জয়, নির্ভীক মৃত্যুহীন এক প্রাণ’ লেখাটিই যেন একবাক্যে এই বীরশ্রেষ্ঠর জীবনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধরেছে।

খাগড়াছড়ি থেকে দল বেঁধে আসা দর্শনার্থীদের একজন ছিলেন জেলা পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মাহাফুজ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মহান শহীদের সমাধি দেখা, সম্মান জানানো আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অনুভবের জন্যই এখানে এসেছি। প্রকৃতির সৌন্দর্যের সঙ্গে স্মৃতিসৌধ মিলিয়ে জায়গাটি সত্যিই অসাধারণ।’

স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস বা শহীদ দিবসের মতো জাতীয় দিবসে হাজারো দর্শনার্থী ভিড় করেন এখানে। এর বাইরেও প্রকৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের টানে অনেকে আসছেন। স্মৃতিসৌধের কেয়ারটেকার বিনয় কুমার চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিদিনই দলে দলে নৌকায় পর্যটক এখানে আসেন। ছুটির দিনে ভিড় আরও বেশি হয়। তবে বর্ষায় দর্শনার্থীদের কষ্ট হয়। কারণ, কোনো ছাউনি দেওয়া ঘর এখানে নেই।’

স্মৃতিসৌধে লেখা বীরের গল্প

১৯৭১ সালের ২০ এপ্রিল রাঙামাটির বুড়িঘাট এলাকায় পাকিস্তানি সেনাদের মুখোমুখি হয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। ওই দিন অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একদল মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে জড়ান। ভারী অস্ত্রে সজ্জিত তিনটি লঞ্চ ও দুটি স্পিডবোট নিয়ে একপর্যায়ে হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের ঘিরে ফেলে। সেই ভয়াল মুহূর্তে মেশিনগান হাতে একাই শত্রুর মোকাবিলা করেন মুন্সি আব্দুর রউফ।

স্মৃতিসৌধের নামফলকের পাশে এসব ইতিহাস খোদাই করে লেখা রয়েছে। সেখান থেকে জানা যায়, মুন্সি আব্দুর রউফের গোলার আঘাতে সেদিন দুটি লঞ্চ ও একটি স্পিডবোট ডুবে প্রাণ হারায় প্রায় দুই প্লাটুন পাকিস্তানি সেনা। উপস্থিত অন্য বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদে সরে যেতেও সাহায্য করেছিলেন তিনি। তবে যুদ্ধের পর হানাদার বাহিনীর মর্টার শেলের আঘাতে শহীদ হন তিনি। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ২৪ বছর।

সেখান থেকে এ বীরের মরদেহ উদ্ধার করেন স্থানীয় বাসিন্দা দয়াল চাকমা। শহীদের মরদেহ দ্বীপটিতে সমাহিত করা হয়। স্বাধীনতার প্রায় ২৫ বছর পর ১৯৯৬ সালের ২৫ এপ্রিল মুক্তিযোদ্ধা ও এলাকাবাসীর সহায়তায় সমাধিস্থল শনাক্ত হয়। পরে ২০০৬ সালে এই সমাধিতেই নির্মাণ করা হয় স্মৃতিসৌধ।

যাওয়ার প্রস্তুতি যেভাবে নেবেন

ঢাকা থেকে রাঙামাটি বা খাগড়াছড়ি জেলা হয়ে স্মৃতিসৌধে যাওয়া যায়। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বাসে ঢাকা থেকে ভাড়া লাগে প্রায় দুই হাজার টাকা। এ ছাড়া সাধারণ বাসে ১ হাজার ২০০ টাকায় এ দুই জেলায় যাওয়া যায়। রাঙামাটি শহর থেকে নানিয়ারচর প্রায় ৪০ কিলোমিটারের পথ। তবে জেটিঘাট থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকায় স্মৃতিসৌধে যাওয়া যায়। তবে যাত্রীসংখ্যা আর সময় অনুযায়ী ভাড়া কম–বেশি হয়।

খাগড়াছড়ি হয়ে গেলে প্রথমে মহালছড়ি যেতে হয়। সেখান থেকে নৌকায় এই স্মৃতিসৌধে যাওয়া যায়। স্মৃতিসৌধের আশপাশে কোথাও খাবারের দোকান নেই। এ ক্ষেত্রে নৌকাভ্রমণের সময় শুকনা খাবার ও পানি সঙ্গে রাখা ভালো।

সূত্র: প্রথম আলো

সর্বশেষ:

শিরোনাম: