
সংগৃহীত
বন্ধুত্ব মানুষের জীবনের একটি অমূল্য সম্পদ। একজন নেককার বন্ধু যেমন হৃদয়ে আনন্দ নিয়ে আসে, তেমনি প্রতিকূল সময়ে সান্ত্বনা ও সমর্থন দান করে। কিন্তু ভালো বন্ধু খুঁজে পাওয়া এবং তাদের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা তো সহজ নয়। প্রতিনিয়ত আমাদের জীবনধারা বদলে যাচ্ছে এবং মূল্যবোধেরও বদল ঘটছে। ফলে বন্ধু হয় সাময়িক স্বার্থে।
ইসলাম আমাদের শেখায় যে বন্ধু নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। কারণ, তারা আমাদের ইমানের পথকে প্রভাবিত করে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘মানুষ তার বন্ধুর ধর্মের ওপর চলে, তাই প্রত্যেকের উচিত বিবেচনা করা যে সে কাকে তার বন্ধু হিসেবে বেছে নিচ্ছে।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ৪,৮৩৩)
মূল্যবোধের গুরুত্ব
বন্ধু নির্বাচনে মূল্যবোধ ও জীবনধারার মিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ধর্মীয় জীবনের প্রতি গুরুত্ব দিতে শুরু করলেই দেখা যাবে, পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে মূল্যবোধের পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে উঠছে। কেননা তখন মনে হবে, কেউ যদি গিবত, ধূমপান বা অশ্লীল কথাবার্তায় লিপ্ত থাকে, তাহলে তার বন্ধুত্ব আমার ইমানের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
মানুষ তার বন্ধুর ধর্মের ওপর চলে, তাই প্রত্যেকের উচিত বিবেচনা করা যে সে কাকে তার বন্ধু হিসেবে বেছে নিচ্ছে।
সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ৪,৮৩৩
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘হে ইমানদারগণ, আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গ গ্রহণ করো।’ (সুরা তওবা, আয়াত: ১১৯)
ইমাম গাজ্জালি বলেন, ‘ভালো সঙ্গ মানুষের হৃদয়কে আল্লাহর পথে অটল রাখে, আর খারাপ সঙ্গ তাকে পথভ্রষ্ট করে।’ (ইহইয়াউ উলুমিদ্দিন, ২০০৫, পৃষ্ঠা: ২১০, দারুল কুতুব প্রকাশনী)
তাই বন্ধু নির্বাচনের সময় আমাদের সতর্ক হতে হবে যে তার মাধ্যমে আমার ইমান ও নৈতিকতা শক্তিশালী হয়, নাকি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা আছে।
পুরোনো বন্ধুত্ব থেকে দূরে সরে আসা
ধর্মীয় জীবনে পরিবর্তন আসার সঙ্গে সঙ্গে পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্কে দূরত্ব তৈরি হতে পারে। এটি কোনো স্বার্থপর বা অহংকারী সিদ্ধান্ত নয়; বরং নিজের ইমান রক্ষার জন্য একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ।
হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘ভালো সঙ্গ এবং খারাপ সঙ্গর উদাহরণ হলো সুগন্ধি বিক্রেতা ও কামারের দোকানের মতো। সুগন্ধি বিক্রেতা হয় তোমাকে এমনিতেই একটু সুগন্ধি দেবে বা তুমি তার কাছ থেকে কিনবে অথবা তার কাছে যাওয়ামাত্র তুমি সুন্দর গন্ধ পাবে। আর কামারের দোকানে হয়তো তোমার কাপড় পুড়ে যাবে, নয়তো দুর্গন্ধ পাবে।’ (সহিহ বুখারী, হাদিস: ২,১০১)
বোঝা যায় যে বন্ধুরা আমাদের চরিত্র ও জীবনে স্বভাবতই গভীর প্রভাব ফেলে, যদিও তারা প্রভাবশালী কেউ না-ও হয়। তাই ধর্মীয় মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কাজে লিপ্ত লোকজনের বন্ধুত্ব থেকে দূরত্ব বজায় রাখা জরুরি। এটি কোনো বিচ্ছেদ নয়; বরং নিজের ইমান ও মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষার একটি পদক্ষেপ।
মসজিদে নিয়মিত যাওয়া অথবা শিক্ষামূলক ইসলামি কার্যক্রমে যোগ দেওয়া ভালো বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে সাহায্য করতে পারে। কেননা এমন পরিবেশে আমরা এমন মানুষের সঙ্গে পরিচিত হই, যারা আমাদের ধর্মীয় লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
নেক সঙ্গর জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া
নেককার বন্ধু পাওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব।’ (সুরা গাফির, আয়াত: ৬০)
হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তিনটি দোয়া কখনো প্রত্যাখ্যাত হয় না: পিতা-মাতার দোয়া, মজলুমের দোয়া এবং মুসাফিরের দোয়া।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ১,৫৩৬)
যদিও উপর্যুক্ত আয়াত ও হাদিসে সরাসরি বন্ধুর জন্য দোয়ার কথা বলা হয়নি, তবে এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে আন্তরিক দোয়া আল্লাহর কাছে কবুল হয়। তাই নেক সঙ্গর জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করা উচিত।
প্রচেষ্টা ও উদ্যোগ
পাশাপাশি নিজের প্রচেষ্টাও গুরুত্বপূর্ণ। হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমার উটকে বেঁধে রাখো এবং তারপর আল্লাহর ওপর ভরসা করো।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ২,৫১৭)
তাই শুধু দোয়া করলে হবে না, দায়িত্বও পালন করতে হবে। সক্রিয়ভাবে সৎ ও নেককার মানুষের সঙ্গে মেলামেশা বাড়াতে হবে। মসজিদে নিয়মিত যাওয়া অথবা শিক্ষামূলক ইসলামি কার্যক্রমে যোগ দেওয়া ভালো বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে সাহায্য করতে পারে। কেননা এমন পরিবেশে আমরা এমন মানুষের সঙ্গে পরিচিত হই, যারা আমাদের ধর্মীয় লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্কই সবচেয়ে বড় সঙ্গ, যা মানুষকে একাকিত্ব থেকে মুক্তি দেয়।
ইবনুল কাইয়িম (রহ.), আল-ফাওয়াইদ
ধৈর্য ও সময়
ভালো বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে ধৈর্য ও সময় লাগে। এটা একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া, তাড়াহুড়া করে অর্জন করার মতো কিছু নয়। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই মানুষের জন্য তা-ই নির্ধারিত আছে, যা সে চেষ্টা করে।’ (সুরা নাজম, আয়াত: ৩৯)
তাই ধৈর্য ধরে সঠিক মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে হবে।
এই সময়ে একাকিত্ব অনুভূত হতে পারে, তবু তা হতে পারে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করার সুযোগ। ইবনুল কাইয়িম (রহ.) বলেন, ‘আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্কই সবচেয়ে বড় সঙ্গ, যা মানুষকে একাকিত্ব থেকে মুক্তি দেয়।’ (আল-ফাওয়াইদ, ২০০০, পৃষ্ঠা: ১৫০, দারুল ফিকর প্রকাশনী)
নিজেও ভালো বন্ধু হওয়া
নেককার বন্ধু পেতে নিজেরও নেককার হওয়া জরুরি। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎকর্মশীলদের সঙ্গে আছেন।’ (সুরা আনকাবুত, আয়াত: ৬৯)
বন্ধুদের প্রতি আমাকে এমন আচরণ করতে হবে, যা তাদের ইমান ও চরিত্রকে উন্নত করে।
আমাদের আচরণে সততা, নম্রতা, বিশ্বস্ততা ও আল্লাহভীতি থাকলেই আমরা অন্যদের জন্য আদর্শ সঙ্গী হতে পারব। হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘মুমিন একে অপরের জন্য আয়নার মতো।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ৪,৯১৮)
এর মানে, বন্ধুদের প্রতি আমাকে এমন আচরণ করতে হবে, যা তাদের ইমান ও চরিত্রকে উন্নত করে।
মোটকথা, একজন সৎ, নেককার ও ভালো বন্ধু আমার ইমানকে শক্তিশালী করবে, জীবনকে আনন্দময় করবে এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভে সাহায্য করবে বটে, কিন্তু তার জন্য নিজেকেও যথাযথ গুণাবলি অর্জন করতে হবে। বন্ধু নির্বাচনে মূল্যবোধের মিল, আল্লাহর কাছে দোয়া, নিজের প্রচেষ্টা, ধৈর্য এবং নিজেকে ভালো বন্ধু হিসেবে গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই।
সূত্র: প্রথম আলো