শুক্রবার, ২৯ আগস্ট ২০২৫, ১৩ ভাদ্র ১৪৩২

ইসলামী জীবন

অস্থিরতার মধ্যে ইবাদতে মনোযোগ বাড়ানোর কৌশল

অস্থিরতার মধ্যে ইবাদতে মনোযোগ বাড়ানোর কৌশল

সংগৃহীত

আজকের বিশ্বে মনোযোগ ভঙ্গের পরিমাণ এত বেশি যে মনকে এক জায়গায় স্থির রাখা যেন যুদ্ধের সমান। স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, বিজ্ঞাপন, সোশ্যাল মিডিয়া—সব দিক থেকে আসা তথ্যের স্রোত, শব্দ, ছবি ও ভিডিওর ভিড়ে আমরা প্রায়ই হারিয়ে যাই। এই পরিস্থিতিতে কীভাবে আমরা ইবাদতে মনোযোগ ধরে রাখব? কীভাবে মনঃসংযোগ ও মনঃস্থিরতার ক্ষমতা বাড়াব?

প্রসিদ্ধ মুসলিম প্রোডাক্টিভিটি প্রশিক্ষক এবং দ্য প্রোডাকটিভ মুসলিম কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ ফারিস বলেন, আমরা তিনটি স্তরে মনোযোগ হারাই—বাহ্যিক, অভ্যন্তরীণ এবং আধ্যাত্মিক। মনোযোগ বাড়াতে এই তিন স্তরেই সমাধান খুঁজতে হবে।

স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, বিজ্ঞাপন, সোশ্যাল মিডিয়া—সব দিক থেকে আসা তথ্যের স্রোত, শব্দ, ছবি ও ভিডিওর ভিড়ে কীভাবে আমরা ইবাদতে মনোযোগ ধরে রাখব?

বাহ্যিক স্তরে করণীয়

মোহাম্মদ ফারিসের মতে, বাহ্যিক বিভ্রান্তি কমাতে প্রথম ধাপ হলো মুঠোফোনের নোটিফিকেশন বন্ধ করা। অ্যাপ লুকানো এবং স্ক্রিন সাদাকালো করে দেওয়ার মতো সাধারণ কৌশলও অত্যন্ত কার্যকর। এই ছোট পরিবর্তনগুলো চিন্তার গতিপথ শান্ত করে এবং মনঃসংযোগ ধরে রাখতে সহায়তা করে। এ জন্য—

  • টেক-ফ্রি জোন: প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে ‘টেক-ফ্রি জোন’ তৈরি করুন, যেখানে ফোন বা ডিভাইস ব্যবহার করবেন না।

  • নির্দিষ্ট সময়ে মেসেজ চেক: মেসেজ বা ই–মেইল চেকের জন্য নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করুন।

  • ঘুমের আগে পড়া: কোরআন বা বই পড়ার অভ্যাস গড়ুন, যা মনকে শান্ত করবে।

অভ্যন্তরীণ সংগ্রাম

অভ্যন্তরীণ বিভ্রান্তি আমাদের মনের মধ্যেই। ফোন না থাকলেও মন অতীত, ভবিষ্যৎ বা অপ্রয়োজনীয় চিন্তায় ঘুরপাক খায়। ইসলাম এখানে তাফাক্কুর (গভীর চিন্তা) ও তাদাব্বুর (অনুধাবন)–এর চর্চার নির্দেশ দেয়।

মহান আল্লাহ বলেন: ‘যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে মহান আল্লাহকে স্মরণ করেন এবং আসমান ও জমিনের সৃষ্টি সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করে বলে: ‘হে আমাদের প্রতিপালক, আপনি এটি ব্যর্থতার সঙ্গে সৃষ্টি করেননি। আপনি পবিত্র, আমাদের জাহান্নামের আজাব থেকে রক্ষা করুন।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৯১)

যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে মহান আল্লাহকে স্মরণ করেন এবং আসমান ও জমিনের সৃষ্টি সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করে বলে: ‘হে আমাদের প্রতিপালক, আপনি এটি ব্যর্থতার সঙ্গে সৃষ্টি করেননি।’

সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৯১

এই আয়াত মনে করিয়ে দেয় যে মহান আল্লাহকে স্মরণ ও সৃষ্টি নিয়ে চিন্তার মাধ্যমে আমরা মনঃসংযোগ ও আত্মিক প্রশান্তি লাভ করি। তাই—

  • তাফাক্কুরের চর্চা: প্রতিদিন কিছুক্ষণ মহান আল্লাহর সৃষ্টি ও নিয়ামত নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করুন।

  • মনকে সংযত করা: অপ্রয়োজনীয় চিন্তা এড়াতে কোরআন তিলাওয়াত বা জিকিরের অভ্যাস গড়ুন।

আধ্যাত্মিক স্তরের শুদ্ধতা

মনোযোগের সর্বোচ্চ শুদ্ধতা আসে আধ্যাত্মিকতা থেকে। সালাত বা নামাজ মনোযোগ ও স্থিরতার শ্রেষ্ঠ অনুশীলন। মহানবী (সা.) বলেছেন: ‘সালাত আমার নয়ন জুড়ায়।’ (সুনান নাসাঈ, হাদিস: ৩,৯৪০)

প্রযুক্তিনির্ভর যুগে নামাজকে অমনোযোগ, অবহেলা বা অলসতা থেকে রক্ষা করা একপ্রকার আত্মরক্ষা। মোহাম্মদ ফারিস বলেন, যাঁরা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ সময়মতো আদায় করেন, তাঁরা সময় ব্যবস্থাপনায় দক্ষ হন। নামাজ সময় ভাগ করে নেওয়া, মন নিয়ন্ত্রণ ও আত্মাকে সংযত করার শিক্ষা দেয়। তাই:

  • নামাজে খুশু: নামাজের আগে দুই-তিন মিনিট চোখ বন্ধ করে গভীর শ্বাস নিন এবং মনকে প্রস্তুত করুন।

  • জিকির ও দোয়া: নামাজের পর জিকির ও দোয়ার মাধ্যমে মহান আল্লাহর সঙ্গে সংযোগ মজবুত করুন।

এ ছাড়া মনোযোগ বাড়াতে ঘুম থেকে ওঠার দুই ঘণ্টার মধ্যে স্ক্রিন এড়িয়ে দিনের পরিকল্পনা করুন, হালকা ব্যায়াম করুন, পানি পান করুন; এবং দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় ‘মনোযোগ চর্চা’ বা ‘ডিপ ওয়ার্ক’–এর জন্য নির্ধারণ করুন।

আজকের সময়ে মনোযোগ ধরে রাখা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ইসলাম শুধু আধ্যাত্মিক নয়, বাস্তব জীবনব্যবস্থাও শেখায়। যা মন, মনন ও দৈনন্দিন কাজে স্থিরতা ফিরিয়ে আনে। মহান আল্লাহ বলেন: ‘নিশ্চয়ই মানুষ ক্ষতির মধ্যে রয়েছে, তবে তারা নয়, যারা ইমান এনেছে, সৎকর্ম করেছে, পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দিয়েছে এবং ধৈর্যের উপদেশ দিয়েছে।’ (সুরা আসর, আয়াত: ১-৩)।

এই আয়াত আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে সময় আমাদের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। আসুন, প্রযুক্তিকে আয়ত্তে আনি, এর হাতে বন্দি না হই এবং নিজের জীবন ও সময়ের জন্য জবাবদিহির অনুভূতি গড়ে তুলি।

সূত্র: প্রথম আলো