শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২৯ ভাদ্র ১৪৩২

ইসলামী জীবন

মহানবীর (সা.) প্রথম ওহির ঘটনা

মহানবীর (সা.) প্রথম ওহির ঘটনা

সংগৃহীত

মহানবী মুহাম্মদ (সা.)-এর নবুয়তের সূচনা ইসলামের ইতিহাসে একটি মহান ঘটনা, যা তাঁর জীবন এবং সমগ্র মানবজাতির জন্য একটি যুগান্তকারী মুহূর্ত হিসেবে বিবেচিত হয়। এই ঘটনা মক্কার হেরা গুহায় সংঘটিত হয়, যখন তিনি ৪০ বছর বয়সে প্রথম ওহি লাভ করেন, যদিও ইবনে আব্বাস ও সাইদ ইবন মুসাইয়াবের মতে তাঁর বয়স তখন ৪৩ বছর ছিল। (ইবন কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৩, পৃ. ১১৫, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৮৮)

প্রথম ওহির পূর্বপ্রস্তুতি

নবুয়তের আগে মহানবীর জীবনে কিছু আধ্যাত্মিক প্রস্তুতি লক্ষ্য করা যায়। আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, “নবুয়তের প্রথম সূচনা ছিল সত্য স্বপ্ন। তিনি যে স্বপ্নই দেখতেন, তা সকালের আলোর মতো স্পষ্টভাবে সত্য হয়ে উঠত।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩)

নবুয়তের প্রথম সূচনা ছিল সত্য স্বপ্ন। তিনি যে স্বপ্নই দেখতেন, তা সকালের আলোর মতো স্পষ্টভাবে সত্য হয়ে উঠত।

হজরত আয়েশা (রা.), সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩

এই সত্য স্বপ্নগুলো তাঁর হৃদয়কে ওহির জন্য প্রস্তুত করেছিল। এছাড়া তাঁর মধ্যে একাকীত্বের প্রতি ভালোবাসা জন্মায়। তিনি মক্কার নিকটবর্তী হেরা গুহায় গিয়ে তাহান্নুস বা ধ্যানমগ্ন সময় কাটাতেন।

তিনি সেখানে কয়েকদিন অবস্থান করতেন, ইবাদতের জন্য খাদ্য সঙ্গে নিতেন এবং পরে খাদিজা (রা.)-এর কাছে ফিরে এসে পুনরায় সরবরাহ নিয়ে যেতেন। (ইবন হিশাম, সিরাতুন নবী, ১/২৩৪, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৮)

হেরা গুহায় প্রথম ওহি

হিজরিপূর্বে ১৩ সালে (৬০৯ খ্রিষ্টাব্দ), মক্কায় হেরা গুহায় থাকাকালীন মহানবীর কাছে প্রথম ওহি আসে।

আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, “একদিন তিনি গুহায় থাকাকালীন ফেরেশতা জিবরাঈল (আ.) তাঁর কাছে এসে বললেন, ‘ইকরা’ (পড়ো)। তিনি বললেন, ‘আমি তো পড়তে জানি না।’ ফেরেশতা তাঁকে জড়িয়ে ধরে এত জোরে চাপ দিলেন যে তিনি প্রচণ্ড কষ্ট অনুভব করলেন। এরপর তিনি তাঁকে ছেড়ে দিয়ে আবার বললেন, ‘ইকরা’। তিনি পুনরায় বললেন, ‘আমি পড়তে জানি না।’

ফেরেশতা দ্বিতীয়বার তাঁকে জড়িয়ে ধরে চাপ দিলেন এবং ছেড়ে দিয়ে আবার বললেন, ‘ইকরা’।

তৃতীয়বার তিনি তাঁকে জড়িয়ে ধরে চাপ দিয়ে বললেন, (সুরা আলাকের ১-৫ আয়াত) ‘পড়ো, তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন রক্তপিণ্ড থেকে। পড়ো, তোমার প্রভু সবচেয়ে দয়ালু, যিনি কলমের মাধ্যমে শিক্ষা দিয়েছেন, মানুষকে শিখিয়েছেন যা সে জানত না’।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩)

মহানবী (সা.) ভীত ও উদ্বিগ্ন হয়ে কাঁপতে কাঁপতে খাদিজা (রা.)-এর কাছে ফিরে এসে বললেন, “আমাকে কম্বলে জড়িয়ে দাও, আমাকে কম্বলে জড়িয়ে দাও।”

এই ঘটনার পর মহানবী ভীত ও উদ্বিগ্ন হয়ে হৃদয় কাঁপতে কাঁপতে খাদিজা (রা.)-এর কাছে ফিরে এসে বললেন, “আমাকে কম্বলে জড়িয়ে দাও, আমাকে কম্বলে জড়িয়ে দাও।” তাঁরা তাঁকে কম্বলে জড়িয়ে দিলেন, যতক্ষণ না তাঁর ভয় কেটে গেল।

তিনি খাদিজাকে ঘটনাটি জানিয়ে বললেন, “আমি আমার জীবন নিয়ে ভয় পাচ্ছি।” খাদিজা তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, “কখনোই নয়, শপথ আল্লাহর, আল্লাহ কখনো আপনাকে লাঞ্ছিত করবেন না। আপনি আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করেন, অতিথিদের আপ্যায়ন করেন, দরিদ্রদের সাহায্য করেন, ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ান এবং সত্যের সহায়তা করেন।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩)

ওয়ারাকা ইবন নাওফালের সাক্ষ্য

খাদিজা (রা.) মহানবীকে তাঁর চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইবন নাওফালের কাছে নিয়ে যান, যিনি ছিলেন একজন খ্রিষ্টান পণ্ডিত এবং হিব্রু ভাষায় ইঞ্জিলের অংশবিশেষ লিখতেন। তিনি তখন বৃদ্ধ ও অন্ধ ছিলেন।

মহানবী তাঁকে ঘটনাটি বর্ণনা করলে ওয়ারাকা বলেন, “এটি সেই নামুস (ফেরেশতা), যিনি মুসা (আ.)-এর কাছে এসেছিলেন। হায়, আমি যদি তখন যুবক হতাম! আমি যদি বেঁচে থাকতাম যখন তোমার সম্প্রদায় তোমাকে বের করে দেবে!”

মহানবী অবাক হয়ে বললেন, “তারা কি আমাকে বের করে দেবে?” ওয়ারাকা বললেন, “হ্যাঁ, যে কেউ তোমার মতো বাণী নিয়ে এসেছে, তাকে শত্রুতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। আমি যদি তোমার সময়ে বেঁচে থাকি, তবে তোমাকে পূর্ণ সমর্থন দেব।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩)

এর কিছুদিন পর ওয়ারাকা মারা যান।

ওহির বিরতি ও পুনরায় শুরু

প্রথম ওহির পর কিছুকাল ওহি বন্ধ ছিল, যাকে ‘ফাতরাতুল ওহী’ বলা হয়। এই সময়ে মহানবী এতটাই দুঃখিত হয়েছিলেন যে, বর্ণনা অনুযায়ী, তিনি কয়েকবার পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে নিজেকে নিক্ষেপ করতে চেয়েছিলেন।

কিন্তু প্রতিবার জিবরাইল (আ.) তাঁর সামনে আবির্ভূত হয়ে বলতেন, “হে মুহাম্মদ, আপনি সত্যিই আল্লাহর রাসুল।” এতে তাঁর মন শান্ত হতো এবং তিনি ফিরে আসতেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৯৮২)।

এই সময়ে মহানবী এতটাই দুঃখিত হয়েছিলেন যে, বর্ণনা অনুযায়ী, তিনি কয়েকবার পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে নিজেকে নিক্ষেপ করতে চেয়েছিলেন।

এই বিরতির পর ওহি পুনরায় শুরু হয়। জাবির ইবন আবদুল্লাহ (রা.) বর্ণনা করেন, নবীজি বলেছেন, “একদিন আমি হাঁটছিলাম, হঠাৎ আকাশ থেকে একটি শব্দ শুনলাম। আমি দৃষ্টি তুলে দেখলাম, হেরায় যে ফেরেশতা আমার কাছে এসেছিলেন, তিনি আকাশ ও পৃথিবীর মাঝে একটি কুরসিতে বসে আছেন। আমি ভয় পেয়ে ফিরে এসে বললাম, ‘আমাকে কম্বলে জড়িয়ে দাও।’

তখন আল্লাহ তাআলা নাজিল করলেন, (সুরা মুদ্দাসসিরের ১-৫ আয়াত) ‘হে কম্বলে জড়ানো, ওঠো এবং সতর্ক করো, তোমার প্রতিপালককে মহত্ত বলো, তোমার কাপড় পবিত্র করো, মূর্তির উপাসনা ত্যাগ করো’।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৪)

এরপর থেকে ওহি নিয়মিতভাবে আসতে শুরু করে।

ঐতিহাসিক তাৎপর্য

প্রথম ওহির ঘটনা মহানবীর জীবনে একটি ঐতিহাসিক মোড়। এটি কেবল তাঁর নবুয়তের সূচনাই নয়, বরং মানবজাতির জন্য ঐশী পথনির্দেশের শুরু। সুরা আলাকের প্রথম পাঁচটি আয়াত জ্ঞান, শিক্ষা এবং সৃষ্টির মহানতার ওপর জোর দিয়েছে। “ইকরা” (পড়ো) শব্দটি ইসলামের জ্ঞানার্জনের প্রতি গুরুত্বকে প্রতিফলিত করে। এই ঘটনা মহানবীকে একজন রাসুল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং তাঁর জীবনের উদ্দেশ্যকে স্পষ্ট করে দিয়েছে।

সূত্র: প্রথম আলো

সর্বশেষ:

শিরোনাম: