সংগৃহীত
তখন হোয়াটসঅ্যাপ ছিল না। বাইরে থেকে বাংলাদেশে টেলিফোন করাটা ছিল এক বিরাট ঝক্কি। যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রায়ই সময়ে অসময়ে আমাকে বাংলাদেশে মায়ের সঙ্গে কথা বলতে হতো। টেলিফোন করার দু-একটা অ্যাপ আমার আইফোনে ছিল, কিন্তু সেগুলো ছিল খুব বাজে।
হঠাৎ লাইন কেটে যেত, ক্রেডিট কার্ড থেকে বেশি পয়সা কেটে নিতো। একসময় মনে হলো নিজেই একটা টেলিফোন অ্যাপ বানাই না কেন। যেহেতু আইফোন ব্যবহার করি, তাই নিয়েই শুরু করলাম।
কিছুদিন পড়াশোনা করে বুঝলাম, কাজটা সহজ নয়। আর বেশ সময়সাপেক্ষ। ভয়েসওভার টেলিফোন (ভিওআইপি) অ্যাপ্লিকেশন এমনিতেই বেশ জটিল ধরনের অ্যাপ। আর আমরা যেসব প্ল্যাটফর্মে কাজ করি, সেগুলো কতগুলো নির্দিষ্ট স্ট্যান্ডার্ড ও প্রচলিত প্রটোকল মেনে চলে।
কিন্তু স্টিভ জব আপেলের জন্য সবকিছু নিজস্ব ধারায় করে গেছেন। আপেল তাদের প্ল্যাটফর্মে সব কিছুতে এখনো নিজেদের তৈরি কাস্টম মেনে চলে। তবু কাজ শুরু করলাম, দেখা যাক কতটুকু যাওয়া যায়!
অ্যাপের নাম দিলাম ‘কলকরো’
প্রথমে স্ক্রিনের কাজ, যেমন ডায়াল প্যাড ও বিভিন্ন আইকন। যুক্তরাষ্ট্রে এসব গ্রাফিকসের কাজ খুব ব্যয়বহুল। ঠিক করলাম, বাইরের ফ্রিলান্সার দিয়ে করাব। ইন্টারনেটে ফ্রিলান্সারদের ভালো কিছু প্ল্যাটফর্ম আছে। আমার পছন্দ ‘আপওয়ার্ক’। কী কী লাগবে তার বিবরণ দিয়ে একটা ‘প্রয়োজন’ পোস্ট করলাম।
দুই দিনের মধ্যেই সারা দুনিয়ার গ্রাফিকস ডিজাইনার হাজির! দুজনকে বাছাই করে কয়েক দিন ধরে তাঁদের সঙ্গে আমার প্রয়োজন ও অগ্রাধিকারগুলো নিয়ে কথা বললাম। দুজনের মধ্যে ইউক্রেনের ডিজাইনার ছিলেন ব্যয়বহুল।
তাঁকে বাদ দিয়ে ভারতীয় একজন ডিজাইনারকে নিয়োগ দিলাম। এখানে বলে রাখি, ফ্রিলান্সারের পারিশ্রমিক ও টাকাকড়ির লেনদেন সব আপওয়ার্ক ব্যবহার করে করা হয় এবং একটা অংশ তারা কমিশন হিসেবে কেটে নেয়।
গ্রাফিকস ডিজাইন এমন কাজ যে একবারে তৃপ্ত হওয়া যায় না, বারবার আরও ভালো করার চেষ্টা চলতে থাকে। একসময় ডিজাইন শেষ হলো। স্ক্রিন লে–আউট ডিজাইনও বেশ কষ্টসাধ্য। পরের ধাপগুলো ছিল রুটিন—আপেল এপিআই ব্যবহার করে ব্যাকগ্রাউন্ড সার্ভিসগুলো তৈরি করে ব্যবহারকারী ও ব্যাকগ্রাউন্ড সার্ভিসের মধ্যে সংযোগ সৃষ্টি।

অ্যাপস্টোরে ‘কলকরো’ অ্যাপ
ছবি: সালেহ উদ্দিন আহমদের সৌজন্যে
ব্যাকগ্রাউন্ড সার্ভিসগুলো ডিজাইন করতেও কিছু পর্যায়ে হোঁচট খেতে হয়েছিল। একেকবার মনে হতো, ‘বাদ দাও, কী দরকার মাথাটা নষ্ট করে!’ কিন্তু কাজগুলো এত কৌতূহলোদ্দীপক ছিল যে বাদ দিয়েও আবার শুরু করেছি বারবার। আসলে উৎসাহ আর সংকল্প না থাকলে কোনো কাজই ভালোভাবে সম্পন্ন করা যায় না।
নেপথ্য সার্ভিসগুলো রান করার জন্য অ্যামাজন ক্লাউড থেকে সার্ভার ভাড়া করতে হয়েছিল। ফোনকলের ইতিহাস, হিসাবে-নিকাশ এবং ডাটাবেজের জন্য একটা ভিন্ন সার্ভার ভাড়া নিতে হয়েছিল। অনেক বিষয়েই কোনো পূর্বধারণা আমার ছিল না, কাজ করতে করতে শিখেছি। আর সময় লেগেছিল বেশ। কারণ, বেশির ভাগ আমাকে শুধু রাতেই কাজ করতে হতো।
একসময় অ্যাপটা তৈরি হয়ে গেল। অ্যাপটার নাম দিলাম ‘কলকরো’। আপেল টেস্ট টুলস ব্যবহার করে নিশ্চিত হলাম, সব কিছু ভালোভাবেই কাজ করছে। একটা বাণিজ্যিক টেলিফোন অ্যাপ্লিকেশনের জন্য যা যা দরকার, সেসব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আমাকে যোগ করতে হয়েছিল।
এগুলো ছাড়া আপেল টেস্ট টিম অ্যাপস্টোরের ছাড়পত্র দেবে না। এগুলোর মধ্যে ছিল ক্রেডিট কার্ড ইন্টারফেস, যা দিয়ে ব্যবহারকারী টাকা জমা রাখতে পারতেন, দেশে দেশে ফোন করার চার্জ, সহজ ‘ইউজার ইন্টারফেস’—এসব কিছু নিয়েই টেস্ট টিমের সঙ্গে বারবার কাজ করতে হয়েছিল।
প্রথম কলটা মাকে করলাম
‘কলকরো’ যেদিন ছাড়পত্র পেল এবং আপেল অ্যাপস্টোরে আপলোড হলো, সেদিনই আমি একটা ই–মেইল পেলাম। সঙ্গে সঙ্গে অ্যাপটা ডাউনলোড করে প্রথম কলটা মাকে করলাম। সেই আনন্দের অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়!
নিজের কাজে ফোন করা ছাড়া অ্যাপটা আর কোনো কাজে লাগবে—এমন কোনো ভাবনা প্রথমে আমার ছিল না। আস্তে আস্তে বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনকে জানালাম। অনেকেই অ্যাপস্টোর থেকে ডাউনলোড করে ব্যবহার করা শুরু করলেন। সমস্যা হলো অনেকেই তো অ্যান্ড্রয়েড সেট ব্যবহার করেন, আইফোনের অ্যাপ সেগুলোতে কাজ করে না।
অ্যাপটা তাই অ্যান্ড্রয়েডে রূপান্তরের সিদ্ধান্ত নিলাম। অ্যান্ড্রয়েডে কাজ করা সহজতর ছিল। কারণ, অ্যান্ড্রয়েড টুলসগুলো স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী নির্মিত এবং সব ইন্টারফেস ‘জাভা’ প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজে লেখা। এ ছাড়া আগেরটার গ্রাফিকসসহ অনেক লজিক বা অ্যালগরিদম আমি পুনর্ব্যবহার করতে পেরেছিলাম। তাই রূপান্তরটা সহজ ছিল।
আস্তে আস্তে আপেল অ্যাপস্টোর ও গুগল প্লে স্টোরে সার্চ করে অনেকে অ্যাপটা ব্যবহার করতে শুরু করলেন। আমিও মজা পেয়ে গেলাম। আরও ব্যবহারকারী বাড়ানোর আশায় নিউইয়র্কের বাংলা পত্রিকাগুলোতে বিজ্ঞাপন দিলাম।
‘কলকরো’ দুই বছরের মতো কার্যকর ছিল। এর মধ্যে হোয়াটসঅ্যাপ কিনে নিল ফেসবুক। ২০১৬ সালের দিকে তারা ফ্রি টেলিফোন সার্ভিস চালু করল। পয়সা দিয়ে কে আর ফোন সার্ভিস ব্যবহার করবে? একসময় কলকরো বন্ধ করে দিয়ে নিজেও হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার শুরু করলাম।
কলকরোর স্বল্পায়ুর জন্য আমার কোনো দুঃখ বা পরিতাপ নেই। অ্যাপটা দিয়ে টাকাকড়ি বানানোর কোনো পরিকল্পনাও আমার ছিল না। কাজটা করেছিলাম অনেকটা শখের বশে। অনেক সময় ব্যয় করেছি, কিছু টাকাকড়িও খরচ হয়েছে। কিন্তু পুরা বিনিয়োগই আমি কড়ায়–গন্ডায় ফেরত পেয়েছি। কাজটা চলাকালীন এবং শেষ করে যে আনন্দ আমি পেয়েছি, কোনো কিছু দিয়েই তা পরিমাপ করা যাবে না।
সূত্র: প্রথম আলো


















