
সংগৃহীত
চলতি বছরের মে মাসে ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলিতে ঘটে যায় গণিতের ইতিহাসে এক ব্যতিক্রমী ঘটনা। গোপনীয়তা রক্ষা করে সেখানে জড়ো হন বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ৩০ জন গণিতবিদ। যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আসা এই গুণীজনেরা অংশ নেন একটি ব্যতিক্রমী প্রতিযোগিতায়। এতে গণিতবিদদের প্রতিপক্ষ ছিল একটি কথিত ‘যুক্তসম্পন্ন’ চ্যাটবট, যার পেছনে রয়েছে ওপেনএআইয়ের নতুন প্রজন্মের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মডেল ‘ও ৪ মিনি’।
দুই দিনব্যাপী সেই বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ে তারা এই এআইয়ের সামনে ছুড়ে দেন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণামূলক পর্যায়ের শতাধিক জটিল প্রশ্ন। উদ্দেশ্য—এআই বটটির যুক্তির ক্ষমতা যাচাই করা। তবে পরীক্ষার ফল দেখে গবেষকেরাই চমকে যান। এআইভিত্তিক এই চ্যাটবট এমন সব সমস্যার সমাধান করতে শুরু করে, যেগুলো বিশ্বের শীর্ষ গবেষকেরাও সমাধান করতে পারেননি।
ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতবিদ এবং ওই সম্মেলনের অন্যতম বিচারক কেন ওনো বলেন, ‘আমার অনেক সহকর্মী বলছেন, এই মডেলগুলো যেন গাণিতিক প্রতিভার স্তরে চলে যাচ্ছে।’
এই চ্যাটবট তৈরি করেছে ওপেনএআই। কোম্পানিটির ‘ও৪ মিনি’ হলো একটি ‘রিজনিং’ লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল (এলএলএম), যেটি যুক্তি দিয়ে জটিল বিষয় বিশ্লেষণ করতে পারে। গুগলের জেমিনি ২.৫ ফ্ল্যাশ মডেলের সমতুল্য। তবে আগের প্রজন্মের তুলনায় ও৪ মিনি অনেক বেশি হালকা, দ্রুত ও নির্দিষ্ট ডেটাসেট এবং মানবিক প্রতিক্রিয়াভিত্তিক প্রশিক্ষণে উন্নত। এর ফলে এটি শুধু ভাষা নয়, গণিতের কঠিন সমস্যা নিয়েও যুক্তিমূলক বিশ্লেষণে পারদর্শী।
ও৪ মিনির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া গবেষকদের মধ্যে একজন ছিলেন এলিয়ট গ্লেজার। এই তরুণ ব্যক্তি সম্প্রতি পিএইচডি শেষ করেছেন। তিনি ও তাঁর টিম ‘ফ্রন্টিয়ার ম্যাথ’ নামের একটি মানদণ্ড মূল্যায়ন কাঠামো তৈরি করেন, যাতে চার স্তরের নতুন ধরনের প্রশ্ন তৈরি করা হয়। এই প্রশ্নগুলোর সমাধান আগে কখনো কোথাও প্রকাশিত হয়নি। গ্লেজারের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৫ সালের এপ্রিল নাগাদ ও৪ মিনি প্রায় ‘২০ শতাংশ প্রশ্নের সমাধান দিতে পারে, যেটা পূর্ববর্তী যেকোনো এলএলএমের চেয়ে অনেক বেশি।
ওনো জানান, তিনি একটি প্রশ্ন তৈরি করেন, যা তাঁর গবেষণাক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞরা একটি ‘উন্মুক্ত সংখ্যাতত্ত্ব’ সম্পর্কিত সমস্যা হিসেবে চিনবেন। এটি ছিল পিএইচডি স্তরের মানের একটি চ্যালেঞ্জ। এরপর সম্মেলনের এক সন্ধ্যায় সেটি ও৪ মিনিকে সমাধানের জন্য দেন।
পরবর্তী ১০ মিনিট ধরে ওনো স্তব্ধ হয়ে লক্ষ করেন, বটটি কীভাবে ধাপে ধাপে সমাধান তুলে ধরে। প্রথম দুই মিনিটে এটি সংশ্লিষ্ট গবেষণাগুলো পর্যালোচনা করে আত্মস্থ করে নেয়। এরপর স্ক্রিনে জানায়, মূল সমস্যায় যাওয়ার আগে একটি সহজ সংস্করণ সমাধান করে শেখার চেষ্টা করবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জানায়, এবার সে আসল প্রশ্নটির সমাধানে প্রস্তুত।
অবশেষে, খুব দ্রুত ও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ও৪-মিনি প্রশ্নটির একটি সঠিক সমাধান হাজির করে, যা দেখে ওনো হতবাক হয়ে যান।
সবশেষে মডেলটি জানায়, ‘কোনো সাইটশন উল্লেখের প্রয়োজন নেই; কারণ, সংখ্যাটি আমি নিজেই হিসাব করেছি!’ এ ঘটনায় হতবাক হয়ে ওনো বলেন, ‘এটা শুধু দক্ষতা নয়, এটি যেন একধরনের আত্মবিশ্বাসও।’
উল্লেখ্য, প্রতিটি প্রশ্ন যেটি ও৪ মিনি সমাধান করতে পারেনি, তার জন্য প্রশ্নকর্তাকে ৭ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার পুরস্কার দেওয়া হয়। ফলে একদিকে যেমন ছিল চ্যালেঞ্জের উত্তেজনা, অন্যদিকে ছিল আর্থিক প্রণোদনাও। শেষ পর্যন্ত ১০টি প্রশ্ন বানাতে সক্ষম হয় অংশগ্রহণকারী দল, যেগুলোর সামনে বটটি পরাস্ত হয়।
এআই ও গণিতের সংযোগ নিয়ে গবেষণার পথিকৃৎ লন্ডন ইনস্টিটিউট ফর ম্যাথমেটিক্যাল সায়েন্সেসের গণিতবিদ ইয়াং হুই হে। তিনি বলেন, ‘ও৪ মিনি যা করছে, সেটি একজন অসাধারণ গবেষক ছাত্রের কাজ। তবে মডেলটি বাস্তবের গবেষক থেকেও ভালো করেছে। এমনকি অনেক পেশাদার গবেষকও এত দ্রুত ও নিখুঁতভাবে কাজ করতে পারবেন না।’
সম্মেলনের শেষ দিকে গবেষকেরা আলোচনা করেন ভবিষ্যৎ নিয়ে। যদি এআই এমন প্রশ্নের সমাধানে সক্ষম হয়, যেগুলো আজও মানুষ জানে না, তাহলে গণিতবিদদের ভূমিকা পাল্টে যাবে। ভবিষ্যতের গণিতবিদেরা হয়তো কেবল প্রশ্ন করবেন, আর সমাধান করবে তাদের সহযোগী এআই।
ওনো বলেন, এআই কখনোই আমাদের জায়গা নিতে পারবে না, এমন ভাবা ভুল। আমি আতঙ্ক ছড়াতে চাই না, তবে এখনকার কিছু মডেল ইতিমধ্যে আমাদের সেরা ছাত্রদের চেয়ে ভালো করছে। ভবিষ্যতের জন্য আমাদের শিখতে হবে—সৃজনশীলতাই হবে মানবজ্ঞান রক্ষার শেষ অস্ত্র।
সূত্র: আজকের পত্রিকা