রোববার, ১৩ জুলাই ২০২৫, ২৯ আষাঢ় ১৪৩২

ডিএনএ বিশ্লেষণে যেভাবে মরদেহ শনাক্ত করা হয়

ডিএনএ বিশ্লেষণে যেভাবে মরদেহ শনাক্ত করা হয়

সংগৃহীত

গত জুনে ভারতের গুজরাটের আহমেদাবাদে এয়ার ইন্ডিয়ার একটি যাত্রীবাহী বিমান উড্ডয়নের কিছুক্ষণের মধ্যেই বিধ্বস্ত হয়। ভয়াবহ এ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ২৬০ জন। বিমানে ছিল ৩৩ হাজার গ্যালনের বেশি জ্বালানি, যার কারণে ঘটনার পরপরই ছড়িয়ে পড়ে দাউ দাউ আগুন। এতে অনেক মরদেহ এমনভাবে পুড়ে যায় বা ছিন্নভিন্ন হয়, যা দেখে চেনার উপায় ছিল না। অবশেষে দুই সপ্তাহ পর ডিএনএ বিশ্লেষণ করেই শনাক্ত করা সম্ভব হয় সব মৃত ব্যক্তিকে।

বিশ্বজুড়ে এই ডিএনএ বিশ্লেষণই এখন মানুষের পরিচয় শনাক্ত করার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উপায় হিসেবে বিবেচিত। যেকোনো ভয়াবহ দুর্ঘটনা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা সন্ত্রাসী হামলায় হতাহতদের শনাক্ত করতে এটি ব্যবহৃত হয়।

ডিএনএ বিশ্লেষণ যেভাবে কাজ করে

ডিএনএ বিশ্লেষণ করতে হলে প্রথমেই সংগ্রহ করতে হয় দুই ধরনের নমুনা—একটি মরদেহ থেকে সংগৃহীত (postmortem), আরেকটি ভিকটিমের জীবিত অবস্থায় নেওয়া (antemortem) নমুনা। মরদেহ থেকে নমুনা সংগ্রহের সময় ছবিতে ধারণ করা হয় দাঁতের গঠন, সংগ্রহ করা হয় ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও পরনের জামাকাপড় বা ব্যক্তিগত সামগ্রী।

সুইডেনের জাতীয় ফরেনসিক মেডিসিন বোর্ডের আণবিক জীববিজ্ঞানী কার্সটিন মন্টেলিয়াস জানান, ডিএনএ নমুনা শরীরের যেকোনো টিস্যু থেকে নেওয়া যায়। নমুনা সংগ্রহের পর তা ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয়, যেখানে নমুনা থেকে ডিএনএ বের করে বিশ্লেষণ করা হয়।

তবে এর মধ্যে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং কাজ হলো দূষণমুক্ত নমুনা সংগ্রহ করা। কারণ, এত বড় দুর্ঘটনায় অনেক সময় মৃতদেহ একসঙ্গে মিশে যেতে পারে বা পরিবেশের প্রভাবে ডিএনএ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ৯/১১ হামলা বা ২০০৪ সালের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সুনামির ঘটনায়ও দেখা গেছে, উচ্চ তাপমাত্রা, আগুন ও পানির কারণে ডিএনএ নমুনা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।

২০০৭ সালে ফরেনসিক সায়েন্স, মেডিকেল অ্যান্ড প্যাথলজি সাময়িকীতে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, নমুনায় দূষণের ঝুঁকি কমাতে রক্ত বা অক্ষত নরম টিস্যু নেওয়া হয়। তবে যদি মৃতদেহ পচে যায় বা একে অপরের সঙ্গে মিশে যায়, তখন হাড় বা দাঁতের নমুনা বেশি কার্যকর।

এরপর শুরু হয় মূল ডিএনএ বিশ্লেষণ প্রক্রিয়া। এতে প্রথমে টিস্যু থেকে ডিএনএ আলাদা এবং বিশুদ্ধ করা হয়, তারপর উপস্থিত ডিএনএর আনুমানিক পরিমাণ নির্ধারণ করা এবং বিশ্লেষণের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ ডিএনএ থাকার জন্য এনজাইম ব্যবহার করে সেই ডিএনএর অনেকগুলো অনুলিপি করা হয়। ডিএনএ খণ্ডগুলো তাদের আকারের ওপর ভিত্তি করে পৃথক করা হয়। ফলে এক ব্যক্তির ডিএনএর একটি দৃশ্যমান প্রতিনিধিত্ব তৈরি হয়।

অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড ফরেনসিক সায়েন্সের গবেষণা ও উদ্ভাবন বিভাগের নির্বাহী ব্যবস্থাপক জেরেমি ওয়াদারস্টন জানান, ‘এই ডিএনএ প্রোফাইল তখন মেলানো হয় ভিকটিমদের পুরোনো ব্যবহৃত জিনিস; যেমন—টুথব্রাশ, রেজরে পাওয়া ডিএনএর সঙ্গে কিংবা মা-বাবার মতো আত্মীয়দের ডিএনএ নমুনার সঙ্গে।’

পর্যাপ্ত নমুনা থাকলে এবং বিশ্লেষণ সঠিকভাবে সম্পন্ন হলে এটি নির্ভুল পদ্ধতি বলেই গণ্য হয়। ইন্টারপোলের ডিজাস্টার ভিকটিম আইডেন্টিফিকেশন ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রধান অস্ট্রেলিয়ান ফরেনসিক প্যাথলজিস্ট পিটার এলিস বলেন, ‘অনুরূপ রাসায়নিক বিশ্লেষণ যুক্ত হলে এমনকি একই ডিএনএর অধিকারী যমজ ভাইবোনকেও আলাদা করে শনাক্ত করা যায়।’

তবে এই প্রক্রিয়ায় কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। যেমন উন্নত প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি প্রয়োজন বা যদি মৃতদেহ পুরোপুরি পুড়ে যায়, তখন ডিএনএ সংগ্রহের মতো কিছুই অবশিষ্ট থাকে না।

এ ছাড়া রয়েছে নৈতিক দিক। যুক্তরাজ্যের সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ক্যারোলিন বেনেট মনে করেন, ডিএনএ বিশ্লেষণের পেছনে একধরনের সামাজিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করে। যেমন: ২০০৫ সালে ইরাকে যখন সাদ্দাম হোসেনের আমলে নিখোঁজ হওয়া মানুষদের শনাক্তে ডিএনএ সংগ্রহ করা হচ্ছিল, তখন সরকার দাবি করেছিল, হাড়ের নমুনা ফেরত দিতে হবে, যাতে তা মূল দেহের সঙ্গে সমাহিত করা যায়।

বেনেট বলেন, ‘ডিএনএ বিশ্লেষণ শুরুর আগে অবশ্যই ভাবতে হবে—এটি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সমাজ ও সংস্কৃতির কাছে কতটা গ্রহণযোগ্য এবং মৃতদের কীভাবে সম্মানের সঙ্গে সমাধিস্থ করা হবে।’

সূত্র: আজকের পত্রিকা

সর্বশেষ: