শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১১ শ্রাবণ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেল সেতুর ৮৫ ভাগ কাজ শেষ

ডিসেম্বরে ঘুরবে ট্রেনের চাকা

ডিসেম্বরে ঘুরবে ট্রেনের চাকা

সংগৃহীত

প্রমত্তা যমুনার বুকে পুরোপুরি দৃশ্যমান হয়েছে উত্তরাঞ্চলবাসীর স্বপ্নের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রেল যোগাযোগে নতুন দিগন্তের সূচনা করবে। ঢাকার সঙ্গে রাজশাহী, রংপুর ও খুলনা অঞ্চলের রেল যোগাযোগে যে দুর্গতি আছে, এ সেতু চালু হলে তা কেটে যাবে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক পথ হিসেবে ভারতের সঙ্গে রেল সংযোগেও এ সেতু মেলবন্ধন হিসেবে কাজ করবে। এরই ধারাবাহিকতায় নীলফামারীর চিলাহাটী অংশে ব্রডগেজ পথ নির্মাণ প্রকল্পের কাজও চলছে। অন্যপাশে ভারতের ফুলবাড়ী অংশে শিলিগুড়ি পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ করছে দেশটির রেল বিভাগ।

বঙ্গবন্ধু সেতুর ৩০০ মিটার উজানে যমুনার বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো এ সেতুটি ঢাকার সঙ্গে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রেল যোগাযোগে নতুন দিগন্তের সূচনা করবে। নির্মাণের পর সেতুটি দিয়ে প্রতিদিন অন্তত ৮৮টি যাত্রীবাহী ও মালবাহী ট্রেন চলাচল করবে। কমে যাবে পরিবহন খরচও। সেই সঙ্গে মহাসড়কের ওপর চাপও অনেকটা কমে আসবে। উত্তরবঙ্গ থেকে বিভিন্ন পণ্য সহজেই ঢাকাসহ সারাদেশ রফতানি করা সম্ভব হবে। ফলে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে।

জানা য়ায়, নিরাপত্তাবেষ্টনী দিয়ে দিন-রাত চলছে শেষ মুহূর্তের কাজ। প্রকল্পে রয়েছেন দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী। ৫০ পিলারের ওপর ৪৯টি স্প্যান বসিয়ে সেতুর ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার স্থাপনা এখন দৃশ্যমান। এরই মধ্যে ৮৫ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। এখন চলছে সেতুর ওপর ডুয়েলগেজ রেলপথ বসানোর কাজ। সেতুর দু’পাশে নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে রেলস্টেশন। দীর্ঘ প্ল্যাটফর্মের এ স্টেশন দুটি তৈরিতে আধুনিক নির্মাণশৈলী ব্যবহার করা হয়েছে। এ ছাড়া সেতু ঘিরে পূর্ব ও পশ্চিম পাশের অতিরিক্ত রেলপথ বসানো কাজও শেষ করা হয়েছে। স্টেশন ইয়ার্ড আধুনিকায়ন কাজের জন্য স্টেশন বিল্ডিং, প্ল্যাটফর্ম বাড়ানোসহ ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণকাজ শেষের দিকে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বঙ্গবন্ধু রেল সেতুটি দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক), বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টিসেক্টরাল, টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কোঅপারেশন (বিমসটেক), সাউথ এশিয়া সাব-রিজিওনাল ইকোনমিক কোঅপারেশন (সাসেক), অন্যান্য আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক রেলওয়ে রুট এবং ট্রান্স-এশিয়ান রেলপথ নেটওয়ার্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ হবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু প্রকল্প অফিস সূত্রে জানা যায়, জাপান ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ অর্থায়নে ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এর নির্মাণ ব্যয় ১৬ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা। ডব্লিউডি-১ ও ডব্লিউডি-২ নামে দুটি প্যাকেজে জাপানি ৫টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। ডব্লিউডি-১ প্যাকেজটি বাস্তবায়ন করছে জাপানি আন্তর্জাতিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ওবাইসি, টোআ করপোরেশন ও জেইসি (ওটিজে) জয়েন্ট ভেনচার। ডব্লিউডি-২ প্যাকেজটি বাস্তবায়নে রয়েছে জাপানের আইএইচআই ও এসএমসিসি জয়েন্ট ভেনচার। এছাড়া সেতুর উভয় প্রান্তের দুই স্টেশনে সিগন্যালিং সিস্টেম স্থাপনে ডব্লিউডি-৩ নামে অপর একটি প্যাকেজের কাজও চলছে। সেতুটি নির্মাণে জাপান, ভিয়েতনাম, নেপাল, অস্ট্রেলিয়া, ফিলিপাইন ও বাংলাদেশের কর্মীরা নিয়োজিত আছেন।

প্রকল্পের প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, প্রতিটি স্প্যানের ওপর জাপানিদের অত্যাধুনিক প্রযুক্তির রেললাইন বসানো হচ্ছে। ফলে সেতুর ওপর দিয়ে ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার বেগে ট্রেন চলাচল করতে পারবে। সমান্তরাল ডুয়েল গেজ ডাবল ট্র্যাকের এ সেতুটির নির্মাণকাজ ডিসেম্বরেই শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

কর্তৃপক্ষ জানায়, মূল সেতুর উভয় প্রান্তে মোট প্রায় শূন্য দশমিক শূন্য ৫ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট (রাস্তা), প্রায় ৭ দশমিক ৬৬৭ কিলোমিটার অ্যাপ্রোচ এমব্যাংকমেন্ট (বেড়িবাঁধ) এবং লুপ (চক্র), সাইডিংসহ মোট প্রায় ৩০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হবে। এ সেতুতে ৫০টি পিলারের ওপর কংক্রিটের রেলপথ বসানো হচ্ছে। সেখানে কোনো সিøপার থাকছে না। এ ছাড়া ওয়েদারিং স্টিল (যা মরিচ ও ক্ষয় প্রতিরোধী) এবং ড্রিলমে প্রিভেনশন গার্ড (দুর্ঘটনা প্রতিরোধী) এ রকম নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে।

১৯৯৮ সালে বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হওয়ার পরই ঢাকার সঙ্গে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রেল যোগাযোগ স্থাপিত হয়। তবে ২০০৮ সালে সেতুটিতে ফাটল দেখা দেওয়ায় কমিয়ে দেওয়া হয় ট্রেনের গতিসীমা। বর্তমানে প্রতিদিন প্রায় ৩৮টি ট্রেন ঘণ্টায় ২০ কিলোমিটার গতিতে সেতু পারাপার হওয়ায় সময়ের অপচয়ের পাশাপাশি ঘটছে শিডিউল বিপর্যয়। বাড়ছে যাত্রী ভোগান্তি। এসব সমস্যা সমাধানে সরকার যমুনা নদীর ওপর আলাদা রেলসেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। ২০২০ সালের ২৯ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেতুটি নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এর পিলার নির্মাণে পাইলিংয়ের কাজ শুরু হয় ২০২১ সালের মার্চ মাসে। ২০২০ সালের ২৯ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেতুটি নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। সমান্তরাল ডুয়েল গেজ ডাবল ট্র্যাকের এ রেলসেতুর পিলার নির্মাণে পাইলিংয়ের কাজ শুরু হয় ২০২১ সালের মার্চ মাসে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতুর প্রকল্প পরিচালক আল ফাত্তাহ মো. মাসুদুর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতুর ৮৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। সুপার স্টাকচারগুলোর মেইন মেম্বারগুলো লাগানো হয়েছে। সেই সঙ্গে কার্ভ, মেটারল কর্টসহ ছোটখাট মেম্বারগুলোও লাগানো হয়েছে। অ্যালাইনমেন্ট ঠিক করা হচ্ছে, লেভেল ঠিক করা হচ্ছে। বিভিন্ন ড্রেনে কাজ, কালভার্টগুলো শেষ হয়ে গেছে। দুই পাশের স্টেশন বিল্ডিংয়ের কাজ, প্লাটফর্ম স্থাপনের কাজ ও ট্র্যাকের কাজ চলছে। আশা করছি, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই সব কাজ শেষ হয়ে যাবে। তারপরই চালু হবে ট্রেন চলাচল।

সূত্র: দৈনিক ইনকিলার

সর্বশেষ: