শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নারীদের দখলে বগুড়ার ‘টমটমের গ্রাম’

নারীদের দখলে বগুড়ার ‘টমটমের গ্রাম’

চৈত্রের ভর দুপুরবেলা। বগুড়া থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে দুপচাঁচিয়ার ধাপের হাট এলাকায় পৌঁছালাম। উদ্দেশ্য খেলনার গ্রামে যাওয়া। হাটের একেবারে উত্তরপাশে গেলে রিকশায় বসে থাকা চালকের কাছে ঠিকানা শুনে আবার ছুটে চলা। 

দেখানো পথে পাড়ার মধ্যে এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ল রাস্তার সাথে মাটির বাড়ি। দরজা থেকেই চোখে পড়ল বাঁশ চিকন করে কাটা। এক পাশে স্তুপ করে রাখা মাটির ছোট বাটি। তিন নারী একসাথে বসে কাজ করছেন। অপরিচিত মানুষ দেখে ঘোমটা একটু টেনে দিলেন তারা।  

জিজ্ঞেস করতে বললেন, এ খেলনার নাম টমটম। দেশব্যাপী বিভিন্ন মেলাকে কেন্দ্র করে এ খেলনা তৈরি করেন তারা। সারাবছর চলে খেলনা তৈরি ও বিক্রি। এটা তাদের পারিবারিক ব্যবসা।

গ্রাম বাংলার মেলার খুব প্রচলিত খেলনা টমটম। উপজেলার সদর ইউনিয়নের খোলাস গ্রাম শিশুদের এসব গ্রামীণ খেলনা বানানোর জন্য প্রসিদ্ধ।

তবে মাঝে দু বছর ছিল বিরতি। মহামারী করোনাভাইরাসের কারণে গত দুটি বছর খোলাস গ্রামবাসী বেশ বিপত্তিতেই দিনপাড় করেছে। মহামারীর প্রকোপ কমতেই তারা আবার ফিরেছে পুরোনো খেলনা তৈরির পেশায়।  

প্রবীন কারিগরদের মতে, পাকিস্তান আমল থেকে এলাকায় বিভিন্ন খেলনা বানানো শুরু হয়। এখন গ্রামের অন্তত ১০০ ঘর এ পেশায় জড়িত রয়েছে। 

অবাক করা বিষয়, ছোট্ট গ্রামটির এই কয় ঘর মিলে বছরে প্রায় পাঁচ কোটি টাকার খেলনা তৈরি করে। এখানকার তৈরি গ্রামীণ এসব খেলনা চলে যায় ঢাকা, বরিশাল, কুমিল্লা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলায়। 

ছোট ঠেলাগাড়ির আদলে তৈরি এই টমটম খেলনা। গাড়ির উপরে মাটির একটি বাটি শক্ত কাগজে মোড়া। এতে দুটো কাঠি বসানো থাকে। গাড়ির আগায় সুতো দিয়ে বাধা। ছোট ছেলে মেয়েরা গাড়িটি টেনে নিয়ে যাওয়ার সময় কাঠি দুটি মাটির বাটিতে বাড়ি খায়। আর টমটম করে শব্দ হয়। এ জন্যই নাম টমটম গাড়ি।

টমটম তৈরিতে ব্যস্ত নারীদের সঙ্গে খেলনা বানানোর নিয়ে আলাপ হয়। তারা জানান, করোনার কারণে গত দুই বছর সব খেলনা তৈরি বন্ধ ছিল। ওই সময়টায় অন্য কাজ করে সংসার চালাতে হয়েছে তাদের। সবকিছু স্বাভাবিক হওয়ায় চলতি বছর থেকে আবার আদি পেশা শুরু করেছেন তারা। এবার মূলত বৈশাখী মেলাকে কেন্দ্র করে খেলনা তৈরি হচ্ছে।

তিন কারিগরদের একজন বুলবুলি বেওয়া। বয়স প্রায় ৫০। এ গ্রামে তার জন্ম; বিয়েও এখানেই। তার বাবার হাতে ধরে এ কাজ শেখা। এখনও খেলনা তৈরি করছেন।

বুলিবুলি বলেন, এটি তার মামার বাড়ি। মামি, মামাতো ভাই ও তার স্ত্রী মিলে টমটম খেলনা তৈরি করেন। আর মামাতো ভাই জাফর সেগুলো বিভিন্ন জেলায় নিয়ে বিক্রি করেন। 

কে কি তৈরি করেন এমন প্রশ্নে বুলবুলির মামি মালেকা বেগম কথা টেনে নেন। হাসি দিয়ে বলেন, ‘এল্লা কি বাপু ছেলেরা করে। হামরা মেয়েছেলেদের হাতে হয়। এই বাঁশ কাটা, বাটির মুখ বন্ধ করে বাঁশের সাথে বান্ধি (বাঁধি)। চাকা লাগাই। বাড়ির বউ বাটিত রঙ করে। তারপর না হয় টমটম।’

মালেকা বলেন, খেলনা বানানোর মৌসুম মেলা দিয়েই হয়। দুর্গাপুজার আগে থেকে শুরু হয়ে রথযাত্রা মেলায় গিয়ে বানানো শেষ হয়।  

আসলেই গ্রামে প্রত্যেক বাড়িতে খেলনা তৈরিতে নারীদের হাতের ছোঁয়াই বেশি। ছেলেরা সাধারণত কাঁচামাল ক্রয় করা এবং বাইরে বিক্রির বিষয়টি দেখে থাকে।

কারিগররা জানান, খেলনা তৈরিতে একেক জন একেক অংশের কাজ করেন। গড়ে প্রতিদিন ১০০টি খেলনা তৈরি করে থাকেন তারা। প্রতিটি টমটম তৈরিতে খরচ পড়ে অন্তত ৬ টাকা। পাইকারী হিসেবে ৮ থেকে ১০ টাকায় বিক্রি হয়। তবে মেলায় বা খুচরা হিসেবে প্রতিটি ১৫ থেকে ২০ টাকা দরে বিক্রি করে থাকেন বিক্রেতারা। 

টমটম ছাড়াও কারিগররা আরও কয়েক ধরনের খেলনা তৈরি করেন। এগুলোর মধ্যে পাখি গাড়ি, কাঠের ট্রাক বেশি বানানো হয়। এই পাখি গাড়ি বানাতে প্রতিটিতে খরচ পড়ে যায় প্রায় ১০ টাকা। পাইকারি হারে বিক্রি হয় ১৪ টাকায়। ট্রাক বানাতে খরচ পড়ে আরও বেশি; ২০টাকার উপরে।

আলাপের এক পর্যায়ে যোগ দেন মালেকার ছেলে ৩১ বছরের জাফর আলী। বাবা কছিম উদ্দিনের হাত ধরে এ পেশায় যুক্ত হওয়া। ১২ বছর বয়স থেকে যেতেন বিভিন্ন মেলায়। বিক্রি করে আবার ফিরে আসেন বাড়িতে। সংসারের খরচ মিটিয়ে আবার নতুন কাঁচামাল ক্রয় করে প্রস্তুত করেন নতুন খেলনা।

জাফর বলেন, এবার বৈশাখী মেলা করার জন্য খেলনা বানানো হচ্ছে। এ জন্য মার্চ মাস থেকে শুরু করা হয় খেলনা তৈরি করা। এখন পর্যন্ত ১৪ হাজার পিস বানানো হয়েছে। 

নিজে মেলায় নিয়ে গেলে আয় একটু বেশি হয়। দেশের যেখানে মেলা থাকে সেখানে আমরা খেলনা নিয়ে যাই। এভাবে বছরে গড়ে ৫০ হাজার পিস খেলনা বিক্রি হয়। কিন্তু গেল দু বছর তো কোনো খেলনা বানাতে পারেননি বলে জানান জাফর।

এই কারিগর জানান, করোনার সময় খুব কষ্টের ভিতরে যেতে হয়েছে। কোথাও মেলা ছিল না। খেলনা বানানো বন্ধ। 

ওই সময়টায় সংসার চলেছে কিভাবে জানতে চাইলে জাফর আলী বলেন, করোনা শুরুর প্রথম দিকে খুব ভয়ে কেটেছে। পরে সংসার চালাতে গিয়ে দেখা যায় কাজ নেই। কারণ সবকিছু বন্ধ। একটা সময় গাছ কাটার কাজ ধরি। সে টাকায় সংসার চালাতে হয়েছে।

জাফরের কাছে জানা যায় এ গ্রামের সবারই করোনার কারণে দুই বছর বড় সংকট গেছে। এমনি এক জন মো. ইনছান। তিনি খেলনা তৈরি করেননা। তবে গ্রাম থেকে খেলনা নিয়ে বাইরের জেলায় বিক্রি করেন। 

ইনছান বলেন, করোনার সময় প্রথম দিকে বসে ছিলাম। এটা যে এত ভয়াবহ হবে বুঝতে পারিনি। মেলা করার জন্য ঘরে মাল। কিন্তু সব বন্ধ। পরে খেলনা বাদ দিয়ে ফলের ব্যবসা শুরু করি।

করোনার আগে প্রতি বছর গড়ে ৬০ হাজার পিস খেলনা বিক্রি করেছেন। এখন করোনার প্রকোপ কমায়ে আবার মাল ক্রয় করছেন। 

ইনছানের হিসাব মতে, গড়ে প্রতি ঘর খেলনার কারিগর বছরে অন্তত ৫০ হাজার পিস টমটমসহ অন্যান্য খেলনা তৈরি করে।

এ পাইকার জানান, উত্তরবঙ্গের দিকে কম যায় গ্রামের পাইকাররা। তারা খেলনা নিয়ে বেশিরভাগই ঢাকায় যায়। কারণ সেখানে চাহিদা ভালো। এ ছাড়া বরিশাল, পটুয়াখালী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, সিলেট অঞ্চলেও খেলনা নিয়ে যান পাইকাররা। 

গ্রামের ১০ জন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, খোলাস গ্রামে পাইকার ব্যবসায়ী আছেন ১০ জন। এ ছাড়া দুপঁচাচিয়া বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ৫ জনের এবং ধাপের হাটে একজনের দোকান রয়েছে। এসব দোকানে বাইরের জেলার অনেক ব্যবসায়ী আসেন খেলনা ক্রয় করতে।   

খোলাস গ্রামে খেলনা তৈরির ইতিহাস সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয় অনেককে। সঠিক সময়কাল কেউ ঠিক মতো বলতে পারেন না। তবে অবেদ আলী নামে প্রবীন এক কারিগর ও ব্যবসায়ীর মুখে শুরু গল্পটা শোনা হয়। 

প্রায় ৬০ থেকে ৭০ বছর আগে পাকিস্তান আমলে কুড়ানু নামে গ্রামের এক লোকের হাত ধরে শুরু হয় টমটম খেলনা তৈরি। কুড়ানু ছোট বেলায় হারিয়ে যান। তাকে খুঁজে পায় সৈয়দপুরের কয়েকজন বিহারী। তাদের কাছে থেকে টমটম খেলনা তৈরি করা শিখেন কুড়ানু। পরে বড় হওয়ার পর ফিরে আসেন খোলাস গ্রামে। তখন পরিপূর্ণ যুবক কুড়ানু। গ্রামে এসে শুরু করেন টমটম খেলনা তৈরি। তার কাছে থেকেই গ্রামের অন্যরা টমটম বানানো শিখেন। সেখান থেকে শুরু টমটম তৈরির ইতিহাস।   

অবেদ আলী বলেন, টমটম মূলত বিহারীদের সৃষ্টি। বালক বয়সে তিনি নিজেও দেখেছেন কুড়ানুকে। এখন গ্রামে তার মেয়ে বেঁচে রয়েছেন।

দৈনিক বগুড়া