শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বগুড়ায় তৈরি হচ্ছে কাতার, সৌদির ঐতিহ্যবাহী পোশাক ‘বেস্ত’

বগুড়ায় তৈরি হচ্ছে কাতার, সৌদির ঐতিহ্যবাহী পোশাক ‘বেস্ত’

এই পোশাকের বাংলাদেশে কোনো চাহিদা নেই। সবগুলো পোশাক-ই যায় সৌদি আরবে কিংবা কাতারে। প্রতিটি ‘বেস্ত’ নকশাভেদে সেখানে ৮০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকায় বিক্রি হয়।

বছর তিনেক আগে বগুড়া সদরের দৃষ্টি প্রতিবন্ধী (এক চোখে দেখতে পান না) সাকিব হোসেন (২৭) বাসের হেলপার ছিলেন। বেতন পেতেন ৫ হাজার টাকা। বাড়িতে মা, বোন, স্ত্রী আর সন্তান নিয়ে এই টাকায় তার সংসার চলতো না। প্রয়োজনের তাগিদেই তিনি চাকরি খুঁজছিলেন। এর মধ্যেই এলাকায় খোঁজ মেলে এক ‘বিদেশি পোশাক কারখানার’। হেলপারের চাকরি ছেড়ে এই কারখানায় কাজ শুরু করেন। প্রথম মাসেই আয় হয় ১০ হাজার টাকা। এখন এই পোশাক কারখানায় কাজ করে সাকিব মাসে প্রায় ২০ হাজার টাকা আয় করেন।

সাকিবের ভাষ্য, “সৌদি, কাতারের ঐতিহ্যবাহী ‘বেস্ত’ নামক পোশাক তৈরি করেই তার স্বচ্ছলতা এসেছে। পুঁজি হলে তিনি নিজেই এমন পোশাক কারখানা করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।”

বিদেশি কাপড়ে হাতের কাজের নকশায় ‘বেস্ত’ তৈরি হচ্ছে। বগুড়া সদরের এরুলিয়া ইউনিয়নের শিকারপুর পূর্বপাড়ায় ‘বেস্ত আল নূর’ নামে কারখানা গড়ে উঠেছে। এখানে এই এলাকার নারী-পুরুষ মিলে ৩০ জন শ্রমিক কাজ করছেন। তাদেরই একজন সাকিব। ‘কাচামালা’ কাপড় থেকে পূর্ণ একটি ‘বেস্ত’ তৈরি হতে ছয়টি ধাপ পার করতে হয়। তার মধ্যে একটি ধাপ ‘মাসকারে’ বিশেষভাবে দক্ষ তিনি। তবে গত তিন বছরে অন্যান্য কাজও শিখেছেন দারুণ নৈপুণ্যের সাথে।

মধ্যপ্রাচ্যের ধনী দেশগুলোর রাজা-বাদশাদের ঐহিত্যবাহী পোষাক ‘বেস্ত’। এই পোশাকের চাহিদা ইসলামী দেশগুলোতে বেশি। প্রায় ১৩ বছর আগে নিজ বাড়িতে ‘বেস্ত আল নূর’ নামে একটি কারখানা গড়ে তোলেন নূর আলম নামের একজন প্রবাসী।

নূর আলমের এই পোশাক কারখানা গড়ে তোলার গল্পটাও ভিন্ন। প্রায় ২০ বছর আগে শ্রমিক হিসেবে সৌদি আরবে ছিলেন নূর আলম। সেখানে বিশেষ ধরনের এই পোশাক তৈরি কারখানায় কাজ করেন তিনি।

পাতলা কাপড়ে বিভিন্ন ধরনের সুতা দিয়ে নকশা করা তার কাজ ছিল। এক পর্যায়ে ‘বেস্ত’ তৈরিতে হাতের কাজের সবগুলোতে দক্ষ হয়ে ওঠেন তিনি। সৌদিতে থাকার কয়েক বছর পর নূর আলম কাতারে যান।

সেখানেও নূর আলম এই বিশেষ ধরনের পোশাক তৈরির কারখানায় কাজ শুরু করেন। পরে সেখানকার মালিককে প্রস্তাব দেন, এমন একটি কারখানা তিনি বাংলাদেশে স্থাপন করতে চান। দেশে কমমূল্যের শ্রমিক দিয়ে কাজ করাতে চান।

তখন তার কাতারের তৎকালীন মালিক রাজি হলে দেশে এসে নূর আলমসহ ১০ জন শ্রমিক মিলে বেস্ত তৈরির কাজ শুরু করেন।

নূর আলম প্রায় সময়ই এখন কাতার কিংবা সৌদি আরবে থাকেন। কারণ কাতারে তার ‘বেস্ত’ বিক্রির শোরুম রয়েছে। আর সৌদি আরবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা দোকানে তিনি দেশে তৈরি ‘বেস্ত’ পাইকারি মূল্যে যোগান দেন। দেশে তার ব্যবসা দেখাশোনা করেন মানিক হোসেন।

নূর আলমের বরাত দিয়ে মানিক জানান, “ঈদের অনুষ্ঠানের পাশাপাশি বিয়ে ও বিভিন্ন উৎসবে এ পোষাকের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। সৌদি কিংবা কাতার থেকে এই পোশাক তৈরির সব কাঁচামাল আমদানি করা হয়।

সুতা, সুঁই থেকে শুরু করে কাপড় সবগুলোই আসে এক নম্বর মানের। বেস্ত তৈরিতে স্বর্ণ ও রৌপ্য প্রলেপযুক্ত সুতা, জরি ও নরম পাতলা কাপড় ব্যবহার করা হয়। এ পণ্যগুলো সৌদি আরব, কাতার ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর পাশাপাশি আমদানি করা হয়। এমনকি এশিয়ার দেশ জাপান থেকেও আনা হয় এসব পণ্য।”

ঐতিহ্যবাহী এই পোশাক তৈরি করতে একজন শ্রমিকের অন্তত সাতদিন সময় লাগে। প্রথমে কাপড় কেটে নিয়ে সেখানে নকশার কাজ শুরু করতে হয়। নকশার প্রথম ধাপকে বলা হয় হেলা। এরপর করা হয় তুক্ত স্রিপ। ব্রুজ, মাকসার, বরদাক এরপর সিলালার মাধ্যমে শেষ হয় এর ধাপগুলো। ধাপগুলো শেষ হলেই পূর্ণতা পায় ‘বেস্ত’।

মানিক জানান, এই পোশাকের বাংলাদেশে কোনো চাহিদা নেই। সবগুলো পোশাক-ই যায় সৌদি আরবে কিংবা কাতারে। দামও খুব ভালো। সেখানে প্রতিটি ‘বেস্ত’ নকশাভেদে ৮০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকায় বিক্রি হয়।

এই কারখানা থেকে প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ২ কোটি টাকার পোশাক বিক্রি করা হয়। এই হিসাবে এই কারখানা থেকে প্রতি বছর গড়ে ২৪ কোটি টাকার পোশাক বিক্রি করা হয়।

তবে সুখের খবর হচ্ছে, কাতারে এবার ফুটবল বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হবে। এই সময় ‘বেস্ত’ পোশাকের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তবে এখনো তাদের অনেক চাহিদা।

নূর আলমের কারখানায় একেকজন শ্রমিক একেক কাজ করেন। কেউ হেলায় দক্ষ, কেউবা সিলালাতে। ব্রুজের কাজে গত সাত বছরে ব্যাপক দক্ষতা অর্জন করেছেন পোশাকের কারিগর (দর্জি) মো. শাকিল রহমান।

তিনি বলেন, “আগে আমি দর্জির কাজ করতাম। কয়েক বছর আগে নূর আলম আমাকে কারখানায় ডেকে ঐতিহ্যবাহী এই পোশাকে নকশার কাজের কথা বলেন।

তখন আমাদের কাজও কম ছিল। এক পর্যায়ে এই কারখানায় কাজ করা শুরু করলাম। এখন এই কারখানায় ব্রুজের কাজ করে মাসে অন্তত ২০ হাজার টাকা আয় হয়।”

করোনার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় স্থানীয় একটি কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী রিমা খাতুনও এখন নূর আলমের এই পোশাক কারখানায় কাজ করছেন।

জানালেন, তার বাবা কৃষিকাজ করেন। মা গৃহিণী। ভাইবোনের মধ্যে রিমা বড়। করোনায় কলেজ বন্ধ থাকার কারণে এখানে এসে হাতের কাজ শেখেন তিনি। এখন প্রতি মাসে গড়ে ১০ থেকে ১৪ হাজার টাকা আয় করেন।

ঐতিহ্যবাহী এই পোশাকে নকশা করে স্বামী-স্ত্রী মিলে সংসার সচল রেখেছেন শিকারপুর পূর্বপাড়ায় রুমা বেগম। জানান, “আমার স্বামী এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করে। আর আমি বাড়ির কাজ শেষ করে অবসর কাটাতাম। প্রতিষ্ঠানের মালিক নূর আলম আমার স্বামীকে এখানে কাজের সুযোগ করে দেন। এখান থেকে আয়ের টাকা দিয়ে নিজের সংসারের অনেক প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ করতে পারি।”

নূর আলমের পোশাক কারখানায় কাজ করে এক ছেলেকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা করাচ্ছেন ওই গ্রামের বাসিন্দা পলি বেগম। তার বাড়ির কাছেই কারখানা। জানান, “এখানে কাজ করে সংসার চালানোর পাশাপাশি আমার ছেলেকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা করাতে পারছি। কাজের ধরনভেদে প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত মজুরি পাওয়া যায়।

এটি ব্যাপক সুবিধা। এখন সরকারের উচিত এই কাজের প্রশিক্ষণ দিয়ে আরও কারিগর তৈরি করা। বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে এই কাজ ব্যাপক সুবিধার।” ‘বেস্ত আল নূর’ নামের এ প্রতিষ্ঠান এখন বেশ বড় পরিসরে শুরু করেছেন মালিক নূর আলম। বাংলাদেশ ছাড়াও বর্তমানে কাতারের দোহাতে ‘বেস্ত আল সালেহ’ নামের আরেক একটি কারখানা তৈরি করেছেন তিনি।

বেস্ত আল নূর এন্টারপ্রাইজের কাতারের ব্যবসা দেখাশোনা করেন মো. রবিউল ইসলাম রনি (সম্পর্কে নূর আলমের জামাই)। তিনি বলেন, “বেস্ত তৈরির কাঁচামাল, স্বর্ণের সুতা ইত্যাদি কাতার থেকে আমদানি করতে হয়। কারণ এই মানের সুতা বাংলাদেশে বা তার আশপাশে নেই। কিন্তু সুতা বা অন্যান্য কাঁচামাল আমদানি বা রপ্তানির ক্ষেত্রে অনেক রকমের ঝামেলার মুখোমখি হতে হয়।

এগুলো সহজ করা গেলে আমাদের জন্য ভালো হতো। একই সাথে আমাদের দেশের বেকার নারী-পুরুষদের প্রশিক্ষণ দিয়ে এই কাজ শেখানো গেলে তারাই সম্পদে পরিণত হবে।” বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে বিভিন্ন রকমের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। তারা ছোট পরিসরে উদ্যোক্তাদের ঋণেরও ব্যবস্থা করে থাকে।

জানতে চাইলে বগুড়া বিসিকের উপ-মহাব্যবস্থাপক একেএম মাহফুজুর রহমান বলেন, “ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের ছোট পরিসরে ঋণ দেওয়া, একই সাথে মাঝে মাঝে পাঁচদিনব্যাপী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।

খুব দ্রুত ওই পোশাক কারখানা পরিদর্শন করে শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। এর পাশাপাশি অন্য কোনো সহযোগিতা লাগলে আমাদের পক্ষ থেকে করা হবে।”

দৈনিক বগুড়া