শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ঐতিহ্যের পালকি বহন এখন তাদের নেশা

ঐতিহ্যের পালকি বহন এখন তাদের নেশা

পালকি বাঙালির ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন এক বাহন। এ দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতিতে পালকি আছে বিশেষ মর্যাদা নিয়ে। পালকির ব্যবহার ঠিক কত আগে শুরু হয়, বছরের মাপকাঠিতে তা বলা মুশকিল। যদিও কালের বিবর্তনে পালকির ব্যবহার হারিয়ে যেতে বসেছে। তবে, এখনো বিয়ে কিংবা সুন্নতে খাৎনাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে হঠাৎ করেই ঐতিহ্যবাহী পালকির ব্যবহার চোখে পড়ে। একটা সময় ছিল, যখন গ্রাম বাংলা এমনকি শহরের বিয়ের অনুষ্ঠান পালকি ছাড়া কল্পনাই করা যেত না।

বিলুপ্ত প্রায় এ বাহনটির ব্যবহার এখনো ধরে রেখেছেন বগুড়ার ধুনট উপজেলার মথুরাপুর ইউনিয়নের দাসপাড়া গ্রামের বাসিন্দা শ্রী মানিক চন্দ্র দাস, বাবলু চন্দ্র দাস, দ্বীনেবন্ধু, সনাতনরা। তারা কয়েকজন মিলে কৃষি কাজের পাশাপাশি এখনো ধরে রেখেছেন বাঙালির ঐতিহ্যবাহী পালকির ব্যবহার। বংশানুক্রমে পেশা পালকি বাহক বা বেয়ারা হলেও আধুনিক যুগে এসে এটি তাদের পেশা নয় বরং নেশায় পরিণত হয়েছে।  

রোববার (১১ সেপ্টেম্বর) সরেজমিনে দেখা যায়, মথুরাপুরের দাসপাড়া গ্রামে বাঙালির ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন বাহন একটি পালকিকে ঘিরে রয়েছে নারী-পুরুষ ও শিশুসহ অনেকেই।

ধুনটের দাসপাড়া গ্রামসহ আশপাশের তল্লাট মিলে এই একটি মাত্র পালকিই রয়েছে। ঘর আকৃতির পালকিটির দৈর্ঘ্য প্রায় সাড়ে ৪ ফুট এবং প্রস্থ ৩ ফুট। আর উচ্চতা প্রায় সোয়া ৩ ফুট। কাঠের ফ্রেমে টিনের আবরণকৃত পালকিটির সামেনে ও পেছনে লাগানো হয়েছে ৫ ফুট দৈর্ঘ্যের দুটি বাঁশ। পালকিটি দেখতে বিলাসবহুল মনে না হলেও এটি এ এলাকার অনেকেরই জীবন-জীবিকার একটি মাধ্যম হয়ে রয়েছে। সেই সঙ্গে বহন করছে বাংলার ঐতিহ্য।

জানা যায়, ধুনট উপজেলার মথুরাপুর ইউনিয়নের রায়পাড়া এলাকায় প্রায় ৩০-৩৫টি পারিবারের বসবাস। তারা সবাই ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সদস্য। পেশা হিসেবে একটা সময় তারা সবাই বেহারার কাজ করতেন। বংশানুক্রমে রাজা ও জমিদার প্রথা থেকে তারা পালকি বহনের কাজ করতেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিকতার ছোঁয়ায় বিলুপ্তির পথে তাদের এ পেশা। তবুও বিভিন্ন মানত, বিয়ে ও সুন্নতে খাৎনায় এখনো মানুষ পালকির ব্যবহার করেন বলেই এটাকে স্বল্প পরিসরে ধরে রেখেছেন তারা। অপেক্ষা করেন ডাক আসার। ডাক আসলেই ছুটে যান পালকি নিয়ে।

ইতিহাসে পালকি সাধারণত এক ধরনের বিলাসবহুল যানবাহন। ধনিকগোষ্ঠী ও দাপুটে লোকেরা পালকিতে চড়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতেন। চাকাবিহীন যানবাহন হওয়ায় কয়েকজন পালকিকে ঘাড়ে বহন করে এগিয়ে চলেন। এক সময় সাধারণ মানুষ পায়ে হেঁটেই দূরের যাত্রা করত। কিন্তু যারা দাপুটে জমিদার, কিংবা রাজা-মহারাজা, পালকি ছিল তাঁদের অন্যতম বাহন। ঘোড়া ছিল, ঘোড়ার গাড়িও ছিল, কিন্তু ধনীদের আভিজাত্যের প্রতীক ছিল পালকি।

মোঘল আমলে বাদশা, সুলতান, বেগম ও শাহজাদিরা পালকিতে যাতায়াত করতেন। মুসলিম সম্প্রদায়ের মেয়েরা পর্দা করতে পালকিতে চড়ে চলাফেরা করতেন। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা প্রাচীনকালে তাদের বউ মেয়েদের যাতায়াতের জন্য পালকি ব্যবহার করতেন। সম্ভ্রান্ত পরিবারগুলো নিজস্ব পালকি ও বেয়ারা রাখত। অন্যদিকে নিম্নবিত্ত পরিবার যাতায়াতের জন্য ভাড়ার পালকি ব্যবহার করত।

এক শত বছর আগেও এ দেশে মোটরগাড়ি ছিল না, রেলগাড়ির প্রচলন হয় সবেমাত্র। তখন গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি আর পালকিই ছিল ভরসা। পরিবারের লোকেরা ছোটখাটো দূরত্বে চলাচলের জন্য ব্যবহার করত পালকি। সেই পালকি সময়ের পরির্বতনে বিয়ের অনুষ্ঠানে বিশেষ ভাবে ব্যবহার হত।

যে ব্যাক্তিরা পালকির ভার বহন করেন, তারা পালকি বেহারা নামে পরিচিত। কোথাও কোথাও আবার বলে কাহার। চারকোণা বিশিষ্ট পালকি বহন করতে প্রয়োজন হয় চার থেকে ছয় জন পুরুষের। দূরত্ব ভেদে বেয়ারাদের হাতে শোভা পেত লাঠি কিংবা দেশীয় অস্ত্র। তারা পালকি নিয়ে ‘হুমনা’, ‘হুমনা’ ধ্বনিতে তালে তালে পা ফেলে, গন্তব্যে ছুটে চলতেন। গ্রামীণ সেই চেনা আঁকাবাঁকা মেঠো পথে বেয়ারারা নববধূকে বরসহ শ্বশুরবাড়িতে আনা নেওয়া করতেন। এখন শিশু-কিশোরদের ছড়া-কবিতার বই ছাড়া পালকির কথা কোথাও শোনা যায় না।  

বগুড়ার ধুনট উপজেলার মথুরাপুর ইউনিয়নের রায়পাড়ার প্রবীণ বাসিন্দা সাধন চন্দ্র রায়, মদন চন্দ্র রায় নামে দুইজন বেহারা  জানান, রায়পাড়া এলাকার সবাই ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী। এ পাড়ার সবাই একটা সময় বেহারার কাজ করতেন। বাপ-দাদার থেকে তারা এ পেশায় জড়িত ছিলেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আর আধুনিকতার ছোঁয়ায় বিলুপ্তির পথে তাদের এ পেশা। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে স্বল্প পরিসরে পালকির ব্যবহার হলেও বছর পাঁচেক আগে থেকে তাদের গ্রামে আর একটি পালকিও নেই।

তারা বলেন, হঠাৎ কোনো বিয়ে বা মানত অনুষ্ঠানের কাজ পেলে একই ইউনিয়নের দাসপাড়া গ্রামের মানিক চন্দ্র দাসের কাছ থেকে পালকি ভাড়া করে নিয়ে যান। অত্র এলাকায় ওই একটি পালকিই রয়েছে। সবার পেশা পরিবর্তন হওয়ায় ও পালকির ব্যবহার কমে আসায় নতুন করে তাদের গ্রামের কেউ আর পালকি তৈরি করছেন না। প্রয়োজন হলে ৩শ’ থেকে ৫শ’ টাকায় দাসপাড়া থেকে পালকি ভাড়া করেন।

পালকি টিকিয়ে রাখা দাসপাড়া গ্রামের বাসিন্দা শ্রী মানিক চন্দ্র দাস জানান, এ এলাকায় তাদের এই একটি পালকিই রয়েছে। বাবলু চন্দ্র দাস, দ্বীনেবন্ধু, সনাতন নামে চার জনের তাদের একটি দল রয়েছে। এখন মূলত কৃষি কাজই তাদের পেশা। তবুও এর বাইরে কোনো বিয়ে বা অন্য কোনো অনুষ্ঠানে ডাক পেলে ছুটে যান পালকি নিয়ে। কোনো সময় নিজ বা অন্য গ্রামের বাসিন্দা যারা একসময় পেশায় বেহারার কাজ করতেন তারাও ভাড়ায় নেন এই পালকি। দাসপাড়া গ্রামের আশপাশের গ্রামে আর পালকি না থাকলেও ডাক এলেই তাদের কাছে আসেন অন্যরা। ভাড়ায় নেন পালকি। বলা যেতে পারে এ কাজ পেশার বাইরে তাদের এক ধরনের নেশা।

তিনি জানান, সম্প্রতি সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার খোকশাবাড়ী চর ব্রাহ্মনগাঁতী গ্রামের বাসিন্দা এক ছেলের সঙ্গে বাগবার্টী ইউনিয়নের চর মিরাখোর গ্রামে এক মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে যান তারা। ছয় হাজার টাকায় চুক্তি ছিল তাদের। বিয়ের অনুষ্ঠানে বর পালকিতে চড়ে যাওয়ায় এলাকাবাসী ছেলে-বুড়োরা দেখতে ভিড় করেন। পালকিতে বরযাত্রা দেখতে এ সময় বিয়েবাড়ি ও আশপাশের সড়কের বিভিন্ন জায়গায় অনেকেই ভিড় করেন বলেও জানান তিনি।

আজ রাজাদের রাজত্ব নেই, নেই জমিদারের জমিদারিও। রেলগাড়ি, মোটরগাড়ি, রিকশা ইত্যাদি নানা ধরনের যানবাহন এসেছে। এসব যানবাহনে ধনী-গরিব সবাই চলাচল করতে পারে। বিয়েতে ব্যবহৃত হয় বাহারি গাড়ি। শেষ হয়েছে বেয়ারাদের রোদে পোড়া, বৃষ্টিতে ভেজা কষ্টের জীবন। সেই সঙ্গে হারাতে বসেছে গ্রামবাংলার প্রাচীন বাহন পালকি। বলা যেতে পারে আধুনিক যুগে বিলুপ্তির শেষ প্রান্তে এসেও কেউ কেউ জীবিকা নয় বরং নেশায় ধরে রেখেছেন ঐতিহ্যবাহী বাহন এই পালকি।

দৈনিক বগুড়া