শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১১ শ্রাবণ ১৪৩১

বগুড়া থেকে মধ্যপ্রাচ্যে যাচ্ছে আরবের ঐতিহ্যবাহী পোশাক ‘বিশত’

বগুড়া থেকে মধ্যপ্রাচ্যে যাচ্ছে আরবের ঐতিহ্যবাহী পোশাক ‘বিশত’

সংগৃহীত

বিশত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে বিশেষ অনুষ্ঠান বা উদ্‌যাপনের ঐতিহ্যগত একটি পোশাক। ২০২২ সালে কাতার বিশ্বকাপে অধিনায়ক লিওনেল মেসির গায়ে পরিয়ে দেওয়া হয় বিশত। সে সময় পোশাকটি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। শত শত বছর ধরে উপসাগরীয় দেশগুলোতে বিশেষ সব অনুষ্ঠানে পরা হয় পোশাকটি।

সুদূর আরব ঐতিহ্যবাহী এ পোশাক বাংলাদেশের বগুড়ার এক পল্লীগ্রামে তৈরি হচ্ছে। নিয়মিত সরবরাহও হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে। আসন্ন ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে জেলার বিশত কারিগরদের ব্যস্ততাও বেড়েছে ব্যাপক।  

প্রতিষ্ঠানটির সূত্রে জানা যায়, ২০০০ সালের দিকে শ্রমিক হিসেবে সৌদি আরবে যান নুর আলম। সেখানে ‘বিশত’ নামে বিশেষ ধরনের এক পোশাক তৈরি কারখানায় কাজ করেন তিনি। পাতলা কাপড়ে বিভিন্ন ধরনের সুতা দিয়ে নকশা করা তার কাজ ছিল। এক পর্যায়ে ‘বিশত’ তৈরিতে হাতের কাজের সবগুলোতে দক্ষ হয়ে ওঠেন তিনি।

সৌদিতে কাজ করার কয়েক বছর পর নূর আলম কাতারে যান। সেখানেও নুর আলম এই বিশেষ ধরনের পোশাক তৈরির কারখানায় কাজ শুরু করেন। পরে সেখানকার মালিককে প্রস্তাব দেন, এমন একটি কারখানা তিনি বাংলাদেশে স্থাপন করতে চান। দেশে কম মূল্যের শ্রমিক দিয়ে কাজ করাতে চান। তখন তার কাতারের তৎকালীন মালিক রাজি হলে দেশে এসে নুর আলমসহ ১০ জন শ্রমিক মিলে বিশত তৈরির কাজ শুরু করেন।

নুর আলম এখন দেশে থাকেন না। বেশিরভাগ সময় কাতার কিংবা সৌদি আরবে থাকেন। কারণ কাতারে ‘বিশত’ বিক্রি হয় বেশি । তার মেয়ে জামাইও একই কারণে কাতারে থাকেন। আর সৌদি আরবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা দোকানে তিনি দেশে তৈরি ‘বিশত’ পাইকারি মূল্যে জোগান দেন।

বিশত আল নুর কারখানার কলেবর বাড়ছে। দুবছর আগেও যেখানে কাজ করতেন ৩০ জন। এখন সেখানে নারী পুরুষ মিলে ৫০ জন শ্রমিক কাজ করছেন। আর এই কারিগররা সবাই  স্থানীয়। বিশত তৈরি করে এই শ্রমিকরা অনেক স্বচ্ছলও হয়েছেন। অনেকে নিজেদের পড়ালেখার খরচ এখান থেকেই বহন করছেন।

কারখানার কারিগরদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ‘কাঁচামাল’ কাপড় থেকে পূর্ণ একটি ‘বিশত’ তৈরি হতে ছয়টি ধাপ পার করতে হয়। ঐতিহ্যবাহী এই পোশাক তৈরি করতে একজন শ্রমিকের অন্তত সাতদিন সময় লাগে। প্রথমে কাপড় কেটে নিয়ে সেখানে নকশা কাজ শুরু করতে হয়। নকশার প্রথম ধাপকে বলা হয় হেলা। এরপর করা হয় তোপ তাশরিফ। ব্রুজ, মাকসার, বরদাক, সিলালাসহ প্রায় আট ধরনের নকশার সমন্বয়ে পূর্ণতা পায় ‘বিশত’।

হাপুনিয়া গ্রামের আব্দুল্লাহ আল মুরাদ ইংরেজি বিভাগে সম্মান তৃতীয় বর্ষে পড়ছেন। পাশাপাশি বিশত তৈরির কাজ করে নিজের পড়ালেখার খরচ চালান। বিশত তৈরির প্রথম ধাপের অংশ যাকে হেলা (নকশার নাম) বলে সেই কাজটি করেন মুরাদ। জানান, এখানে প্রতিদিন একটি করে বিশতের কাজ শেষ করার চেষ্টা করা হয়। বিশত তৈরির প্রথমে হেলার কাজ হয়। সেটি করে কলারের খেজুরের (নকশার নাম) সেলাই হয়। একটি বিশত তৈরি করতে মোটামুটি আট ধাপে কাজ করতে হয়।

কারখানার পাশের বাসিন্দা রিহাদ হোসেন ২০২২ সালে কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে ডিপ্লোমা করে দুটো প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছিলেন। কিন্তু গত আট মাস হলো বাড়ির পাশের এই বিশত কোম্পানিতে যুক্ত হয়েছেন। কাজ করছেন তোপ তাশরিফ সেলাইয়ে।

রিহাদ হোসেন বলেন, ঈদের সময় এই কাজের চাহিদা বাড়ে। কোরবানির ঈদ পর্যন্ত চলবে বিশত তৈরির চাহিদা। এরপরেও সারা বছর ধরে এই কাজ চলে। একেকটি সেলাইয়ের কাজ করতে দেড় দিন সময় লাগে। আমরা যারা নতুন তাদের একটি বিশতে তোপ তাশরিফের কাজ শেষ করতে দু-দিন লাগে। একটি বিশতের কাজ করে এক হাজার টাকা পাওয়া যায়। মাসে ১০-১২ টি কাজ করা সম্ভব হয়।  

বাড়ির কাছে হওয়ায় এখানে কাজ করা হয় বলে মন্তব্য করেন রিহাদ। বললেন, এখানে স্টুডেন্ট আছে, সাংসারিক মানুষও আছে।  

কারখানার পুরোনো শ্রমিকদের মধ্যে একজন শফিকুল ইসলাম। সাত বছর ধরে নুর আলমের কারখানায় কাজ করছেন। এক সময় তিনি গাড়ির ওয়াশের কাজ করতেন। পরে এই কারখানা মালিকের কথা শুনে কাজ শিখেন। তার মতো কাজ শিখে বেশ কয়েকজন মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে বিশত তৈরির কারখানায় চাকরি পেয়েছেন।

শফিকুল ইসলাম বলেন, কাজ শেখার পরে প্রথম দিকে ৮-৯ হাজার টাকা পেয়েছি। এখন মাসে ১৫ হাজার টাকা আসে। আমার সঙ্গে কয়েকজন কাজ শেখার পর বিদেশে গেছে। সেখানে গিয়ে বিশতের কারখানায় কাজ করছেন তারা।  

নুর আলমের কারখানায় শুধু পুরুষ শ্রমিক নেই। অন্তত ১০ জন নারী এই কাজ করছেন। এর মাধ্যমে তারা নিজেদের সংসারে আয়ের জোগান দিচ্ছেন।

মোছা. তাসলিমা বলেন, আলহামদুলিল্লাহ এখানে কাজ করে সংসার অনেক ভালো চলে। আমি এখানে তিন বছর ধরে কাজ করি। সপ্তাহে ২ হাজার ৫০০ টাকা করে পাই।

সারা বছর চাহিদা থাকলেও ঈদ উপলক্ষ্যে কাজের পরিমাণ বেড়েছে। এই চাহিদা  ঈদুল আজহা পর্যন্ত থাকবে বলে জানান কারখানার ব্যবস্থাপক ও মালিকের মেয়ে জামাই মেহেরুল ইসলাম তুষার।

নুর আলম ও তার বড় মেয়ের জামাই রবিউল ইসলাম মধ্যপ্রাচ্যের ব্যবসা ও বিশতের অর্ডার নেওয়ার কাজ করেন। আর দেশের অংশটি দেখেন ছোট মেয়ের জামাই তুষার।

মেহেরুল ইসলাম তুষার বলেন, আমাদের চাহিদা ভালো। এখন যে কাজ শুরু হয়েছে এটি কোরবানির ঈদ পর্যন্ত চলবে। এই বিশতের দামটা ফিক্সড নয়। জরির কাজের ওপর এর দাম নির্ধারণ হয়। তারপরেও একেকটি বিশত ৩০-৪০ হাজার টাকা দামে বিক্রি হয়।

বিশতের বাজার সম্পর্কে এই ব্যবস্থাপক জানান, এটি মধ্যপ্রাচ্যের যে পাঁচটি মুসলিম দেশ আছে, সেখানে এর চাহিদা। আমাদের দেশে বিশতের কোনো চাহিদা নেই। বছরে কত টাকার বিশত হয় এটা সঠিক বলা যাবে না। কারণ এটা কারিগরের ওপর নির্ভর করে। তবে বছরে গড়ে এক হাজার পিস বিশত তৈরি করা যায়।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) বগুড়া কার্যালয়ের উপ-মহাব্যবস্থাপক একেএম মাহফুজুর রহমান বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের এই বিশত ওখানকার অনেক ডিমান্ডের পোশাক। আমাদের বগুড়ায় এটি তৈরি হচ্ছে। এই কাজটি বগুড়ায় প্রসারিত হচ্ছে। ওই একটি কারখানার দেখাদেখি সেখানে আরও দুটি কারখানা স্থাপন হয়েছে। তিনটি কারখানায় প্রায় শতাধিক শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে এর মাধ্যমে। 

সর্বশেষ: