শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আত্মসমালোচনার গুরুত্ব ও পদ্ধতি

আত্মসমালোচনার গুরুত্ব ও পদ্ধতি

মুহাসাবাতুন নাফস’ বা আত্মসমালোচনা নিজেকে শুধরে নেওয়া ও বদলে দেওয়ার শ্রেষ্ঠ উপায়। দুই চোখ দিয়ে মানুষ অন্যকে এবং অন্যের দোষ-ত্রুটি দেখতে পায়। কিন্তু অন্তরের চোখে নিজের আয়নায় নিজেকে দেখতে পায়। পরকালীন জবাবদিহিতার প্রতি লক্ষ্য রেখে নিজের ভালো-মন্দ নিয়ে নিজের সঙ্গে প্রতিনিয়ত বোঝাপড়া করার নাম আত্মসমালোচনা। নিজেকে নিয়ে সমালোচনার এই চর্চা পাপে নিমজ্জিত হওয়া থেকে বিরত রাখে। চরম পদস্খলন থেকে রক্ষা করে। তাই আত্মিক পরিশুদ্ধতায় আত্মসমালোচনা একজন মুমিনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

আত্মসমালোচনাকে প্রত্যেক মুমিনের জন্য অপরিহার্য ঘোষণা করে আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদাররা, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য উচিত আগামীকালের জন্য (অর্থাৎ আখিরাতের জন্য) সে কী প্রেরণ করেছে, তা চিন্তা করা। আর তোমরা তাদের মতো হয়ো না, যারা আল্লাহকে ভুলে গেছে, ফলে আল্লাহ তাদের আত্মভোলা করে দিয়েছেন। নিশ্চয়ই তারা ফাসিক।’ (সুরা হাশর, আয়াত : ১৮)

এই আয়াতের মাধ্যমে মহান আল্লাহ প্রত্যেক মুমিনের জন্য আত্মসমালোচনা ওয়াজিব করে দিয়েছেন।

অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা আত্মসমালোচনাকারীদের প্রশংসা করে বলেন, ‘যাদের মনে আল্লাহর ভয় আছে, তাদের ওপর শয়তানের আগমন ঘটার সঙ্গে সঙ্গে তারা সতর্ক হয়ে যায় এবং তখন তাদের বিবেচনাশক্তি জাগ্রত হয়ে ওঠে।’ (সুরা আরাফ, আয়াত : ২০১)

আত্মসমালোচনার গুরুত্ব সম্পর্কে ওমর (রা.)-এর নিম্নোক্ত বাণী প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, ‘তোমরা নিজেদের আমলনামার হিসাব নিজেরাই গ্রহণ করো, চূড়ান্ত হিসাব দিবসে তোমাদের কাছ থেকে হিসাব গৃহীত হওয়ার আগেই। আর তোমরা তোমাদের আমলনামা মেপে নাও চূড়ান্ত দিনে মাপ করার আগেই। কেননা, আজকের দিনে নিজের হিসাব নিজেই গ্রহণ করতে পারলে আগামী দিনের চূড়ান্ত মুহূর্তে, তা তোমাদের জন্য সহজ হয়ে যাবে। তাই সেই মহাপ্রদর্শনীর দিনের জন্য তোমরা নিজেদের সুসজ্জিত করে নাও, যেদিন তোমরা (তোমাদের আমলসহ) উপস্থিত হবে এবং তোমাদের কিছুই সেদিন গোপন থাকবে না।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৪৫৯)

আত্মসমালোচনার উপকারিতা

১. নিজের দোষ-ত্রুটি নিজের সামনে প্রকাশ করার মাধ্যমে মানুষ স্বীয় ভুল-ত্রুটি জানতে পারে।

২. আত্মসমালোচনা মানুষকে আল্লাহর দরবারে খাঁটি বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করে।

৩. আত্মসমালোচনার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর নিয়ামত ও অধিকার জানতে পারে। আর সে যখন আল্লাহর নিয়ামত ও তার অবস্থান সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে, তখন সে আল্লাহর নিয়ামতের শুকরিয়া আদায়ে উদ্বুদ্ধ হয়।

৪. আত্মসমালোচনার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে পরকালীন জবাবদিহিতার উপলব্ধি সৃষ্টি হয়।

৫. আত্মসমালোচনার ফলে কোনো পাপ দ্বিতীয়বার করতে গেলে বিবেকে বাধা দেয়। ফলে পাপের কাজ থেকে মুক্তি পাওয়ার পথ আমাদের জন্য সহজ হয়ে যায়।

আত্মসমালোচনার পদ্ধতি

আত্মসমালোচনা করার পদ্ধতি হলো—

১. আল্লাহর আদেশ আদায়ের ব্যাপারে আত্মসমালোচনা করা। অর্থাৎ ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত ও নফলগুলো পর্যালোচনা করা। নিজেকে জিজ্ঞেস করতে হবে যে আমি কি আমার ওপর আরোপিত ফরজ আদায় করেছি? আদায় করলে সঙ্গে সঙ্গে নফল বা মুস্তাহাব কতটুকু আদায় করেছি? কারণ ফরজের কোনো অপূর্ণতা হলে নফলগুলো সেটা পূরণ করে দেয়।

ইবাদতে আল্লাহর হক ছয়টি—ক. আমলের মধ্যে ইখলাস বা নিষ্ঠা থাকা, খ. তার মধ্যে আল্লাহর জন্য নসিহত থাকা (আল্লাহর একত্ববাদের প্রতি সঠিক বিশ্বাস পোষণ করা), গ. রাসুল (সা.)-এর প্রতি আনুগত্য থাকা, ঘ. একাগ্রতা থাকা, ঙ. নিজের ওপর আল্লাহর ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের পূর্ণ উপলব্ধি থাকা, চ. অতঃপর এসব বিষয়ে নিজের ত্রুটি হচ্ছে—এই অনুভব থাকা। (ইহয়াউ উলুমিদ্দিন ৪/৩৯৪)

এসব হক পূর্ণভাবে আদায় করা হয়েছে কি না—আমল সম্পন্ন করার পর তা চিন্তা করতে হবে।

২. অপ্রয়োজনীয় কাজ পরিত্যাগ করা। দ্বিনি দৃষ্টিকোণে অপ্রয়োজনীয় কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখা। কোনো কাজ করার আগে এই চিন্তা করা যে এর দ্বারা দুনিয়াবি ও পরকালীন জীবনে আমার বা মানবসমাজের কী লাভ হবে? এটি অন্য কোনো লাভজনক কাজ থেকে আমাকে বিরত করছে কি না? ইত্যাদি প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব না পেলে সে পথে অগ্রসর না হওয়া। (ইহয়াউ উলুমিদ্দিন ৪/৩৯৪)

৩. ক্ষমা প্রার্থনা করা ও সৎ কাজ করা। পূর্ণ সতর্কতার পরও যদি অনিচ্ছাকৃতভাবে কোনো পাপ হয়ে যায়, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে লজ্জিত হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা ও তাওবা করা। সঙ্গে সঙ্গে সৎ আমল দ্বারা এই অপরাধের ক্ষতিপূরণ করার চেষ্টা করা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই ভালো কাজ মন্দকাজকে দূর করে দেয়, আর এটা স্মরণকারীদের জন্য স্মরণ।’ (সুরা হুদ, আয়াত : ১১৪)

দৈনিক বগুড়া