শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আধুনিক জীবনব্যবস্থা গ্রহণে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি

আধুনিক জীবনব্যবস্থা গ্রহণে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি

খ্রিস্টীয় উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ইসলামী বিশ্বকে একটি সংকটপূর্ণ ও জটিল বিষয়ের মুখোমুখি হতে হয়। এ বিষয়ে তাদের সঠিক কর্মপন্থা ও দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভর করে একটি স্থায়ী ও স্বাধীন পৃথিবীতে তাদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ও অস্তিত্ব। বিষয়টি হলো কর্মক্ষম জীবন ও প্রফুল্ল, সাহসিকতা ও সংকল্প এবং উন্নতি ও সম্প্রসারণের ক্ষমতা মূর্তিমান পাশ্চাত্য সভ্যতা।

কেননা পশ্চিমা সভ্যতাকে মানব ইতিহাসের অধিক শক্তিশালী ও অতি বিস্তৃত সভ্যতার একটি হিসেবে গণ্য করা যায়। আর বিস্তৃত সভ্যতা এক দিনেই গড়ে ওঠেনি; বরং তা ছিল সেসব প্রভাব ও কার্যক্রমের স্বভাবগত ফলাফল, যা বহুদিন ধরে ইতিহাসে সক্রিয় ছিল এবং যথাসময়ে স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। পশ্চিমা সভ্যতার উত্থানে মুসলিম বিশ্বই বেশি বিপদের সম্মুখীন হয়। কেননা জীবনের কারখানা থেকে যখন সব পুরনো ধর্ম বাদ পড়ে যায়, তখন শুধু ইসলামই ধর্ম ও নৈতিকতার এবং মানবজাতির রক্ষক ও তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে অবশিষ্ট থেকে যায়। তাই যান্ত্রিক সভ্যতার চ্যালেঞ্জ অন্য কোনো জাতি ও জীবনপদ্ধতির তুলনায় মুসলিম বিশ্ব ও ইসলামের দিকে প্রবলভাবে ধেয়ে আসে।

আধুনিক সভ্যতা নিজের প্রশস্ত গণ্ডিতে অনেক কিছু অন্তর্ভুক্ত করেছে এবং তা আত্মস্থ করেছে। যেমন : আকিদা ও বিশ্বাস, চিন্তা ও চেতনা, তত্ত্বীয় বিধি-বিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দর্শন, সামাজিক, প্রাকৃতিত ও নির্মাণশিল্প ইত্যাদি। এসব বিষয়ে আশ্চর্যজনক ও অভিনব জ্ঞান-বিজ্ঞান পশ্চিমা জাতিগুলো তাদের দীর্ঘ অগ্রযাত্রার নানা পর্যায়ে আত্মস্থ করেছে। তারা সাধারণ মানবিক জ্ঞান, পদার্থ, রসায়ণ, কারিগরি ও গণিতশাস্ত্রে অতুলনীয় সাফল্য অর্জন করে। তবে পশ্চিমা সভ্যতাকে অবশ্যই একটি মিশ্র সভ্যতাই বলতে হবে। মিশ্র এই সভ্যতা এক পর্যায়ে অসম্পূর্ণ ও আরেক পর্যায়ে সম্পূর্ণ ছিল। তার উপকারী ও ক্ষতিকর উভয় রূপই ছিল। কোনো ক্ষেত্রে সঠিক আবার কোনো ক্ষেত্রে ভুল। কেননা তারা তাদের সন্দেহাতীত জ্ঞানের সঙ্গে এমন ত্রুটিপূর্ণ অনুমান, কল্পনা ও চিন্তা অন্তর্ভুক্ত করে, যার মধ্যে বাদানুবাদ, গভীর চিন্তা ও বিবেচনার স্থান আছে। সভ্যতায় এমন অংশ ও উপাদান ছিল, যা কোনো বিশেষ দেশ ও জাতির জন্য নির্দিষ্ট নয়।

যেমন অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান। আর এমন জিনিসও ছিল, যাতে পাশ্চাত্য সভ্যতার স্থানীয় প্রভাব সম্পূর্ণভাবে বিদ্যমান ছিল এবং পাশ্চাত্য পরিবেশ ও সামাজিকতার গভীর ছাপও তাদের ওপর পড়েছিল। তাতে এমন জিনিসও ছিল, যার দ্বিন ও বিশ্বাসের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক ছিল এবং এমনও অংশ ছিল, যার সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্কই ছিল না। পশ্চিমা সভ্যতার এই মিশ্ররূপ মুসলিম বিশ্বকে এক সংকটপূর্ণ ও কঠিন অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছে এবং মুসলিম বিশ্বের নেতা ও চিন্তাবিদদের বুদ্ধিমত্তার জন্য একটি পরীক্ষার বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে মুসলিম বিশ্ব তিনটি পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারে—এক. পশ্চিমা সমাজ-সভ্যতার বিরোধিতা করা। অর্থাৎ মুসলিমরা এই সভ্যতার সব ফলাফল ও উপকারিতাকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করবে। তার কোনো ভালো বা মন্দ কথা শুনতে ইচ্ছুক হবে না। দুই. নিরপেক্ষতা অবলম্বন করে পশ্চিমা সভ্যতা থেকে একদিকে সরে পড়া এবং তা থেকে কোনো ফল ভোগ না করা, এমন তার জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে কোনো প্রকার সম্পর্ক না রাখা, যে জ্ঞান-বিজ্ঞান দ্বারা পাশ্চাত্য জাতি শ্রেষ্ঠত্ব ও স্বাতন্ত্র্য লাভ করেছে। যেমন : পদার্থ, গণিত ও কারিগরি জ্ঞান।

তিন. সতর্ক ও সচেতনতার সঙ্গে গ্রহণ ও বর্জন করা। ইসলামী শরিয়তের মূলনীতির আলোকে পশ্চিমা সভ্যতাকে মেপে দেখা এবং সে আলোকেই কোনো গ্রহণ বা কোনো বর্জন করা। পশ্চিমা সভ্যতার ব্যাপারে এটাই ইসলামের প্রকৃত অবস্থান।

ভালো-মন্দ বিচার না করে আধুনিক সমাজ ও সভ্যতাকে বর্জন করার অর্থ হলো মুসলিম বিশ্বকে পিছিয়ে রাখা এবং জীবনপথের দ্রুতগামী যাত্রীদল থেকে বিক্ষিপ্ত হয়ে যাওয়া। এতে মুসলিম বিশ্ব অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে এবং তা একটি দ্বীপে পরিণত হবে। সমুদ্রে এমন বহু দ্বীপ হওয়া সম্ভব। কিন্তু স্থলভাগে এ ধরনের দ্বীপের কোনো স্থান নেই। বস্তুত সংকীর্ণমনা মানুষই এই নীতি গ্রহণ করে থাকে। এতে প্রাকৃতিক শক্তি ও অগ্রযাত্রার ধারা বন্ধ হয়ে যাবে। এটা দ্বিনের সঠিক ব্যাখ্যা ও বর্ণনাও নয়। কেননা ইসলাম জগতে জ্ঞানের সঠিক ব্যবহার ও দূরদর্শী সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিশেষ জোর দিয়েছে। উপকারী জ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গ্রহণে উৎসাহিত করেছে। বরং তা দ্বিনের রক্ষণাবেক্ষণ ও শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করতে মুসলিমদের যথাসাধ্য প্রস্তুতি গ্রহণের আদেশ দিয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আকাশ ও জমিনের সৃষ্টির মধ্যে এবং রাত-দিনের পরিবর্তনের মধ্যে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শন আছে। সেসব জ্ঞানীদের জন্য, যারা কখনো আল্লাহবিমুখ নয়; বরং যারা দাঁড়ানো, বসা ও শোয়া অবস্থায় আল্লাহর জিকির করে। আর তাদের বৈশিষ্ট্য হলো আকাশ ও জমিনের সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা করে। (তারা বলে) হে আল্লাহ, এই সমস্ত যা আপনি সৃষ্টি করেছেন তা নিঃসন্দেহে অকেজো ও অনর্থক নয়। আপনি পূতঃপবিত্র। আমাদের জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করুন।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৯০-৯১)

যদি পৃথিবীর কোনো দেশ চোখ-কান বন্ধ করে নতুন সভ্যতার শক্তিশালী মোকাবেলা থেকে দূরে সরে থাকার চেষ্টা করে অথবা তাকে পুরোপুরি ত্যাগ করে সুখ-নিন্দ্রা দিতে চায় এবং নিজের সীমাবদ্ধ দুনিয়া থেকে কোনো প্রকারেই বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত না থাকে, সে দেশকে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্রোহ ও বিপ্লবের সম্মুখীন হতে হবে। কেননা সময় ও সমাজকে উপেক্ষা করা মানবজাতির স্বভাব ও বৈশিষ্ট্যের সম্পূর্ণ বিপরীত। (সংক্ষেপিত)

‘আস-সিরাউ বাইনাল ফিকরাতিল ইসলামিয়্যা ওয়াল ফিকরাতিল গারবিয়্যা’ থেকে মো. আবদুল মজিদ মোল্লার ভাষান্তর

দৈনিক বগুড়া