শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

যেসব ক্ষেত্রে কান্নাকে উৎসাহিত করে ইসলাম

যেসব ক্ষেত্রে কান্নাকে উৎসাহিত করে ইসলাম

আল্লাহ ভয়ে বিভিন্ন সময় কান্না করা ইবাদত। ইসলামি শরিয়তও কান্নাকে উৎসাহিত করেছে। আবার কান্নার সীমারেখাও নির্ধারণ করে দিয়েছে। যেসব সময় কান্না করায় ইসলামের অনুমোদন রয়েছে সে রকম কিছু স্থান ও সময় উল্লেখ করা হলো-

১. কোরআন তেলাওয়াতের সময়

কোরআনুল আসমানি গ্রন্থ। মানুষের জীবন বিধান। কাজেই তা তেলাওয়াত ও অনুধাবনের সময় গভীর মনোযোগ নিতে হবে। আল্লাহ তাআলা একাধিক আয়াতে ঘোষণা করেন-

اِنَّ فِیۡ ذٰلِکَ لَذِکۡرٰی لِمَنۡ کَانَ لَهٗ قَلۡبٌ اَوۡ اَلۡقَی السَّمۡعَ وَ هُوَ شَهِیۡدٌ

‌‘এতে অবশ্যই উপদেশ রয়েছে তার জন্য যার আছে (বোধশক্তিসম্পন্ন) অন্তর কিংবা যে খুব মন দিয়ে কথা শুনে।’ (সুরা কাফ : আয়াত ৩৭)

আল্লাহর কোরআন মনোযোগ দিয়ে শোনার সময় কান্না আসা বা কান্নার অবস্থা সৃষ্টি হওয়া একটি প্রশংসনীয় গুণ এবং সব নবীগণের সুন্নাত। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও কোরআন তেলাওয়াত করার সময় কাঁদতেন। কোরআন তেলাওয়াতের সময় কান্না করা মুস্তাহাব। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-

‘তোমরা কোরআন তেলাওয়াত কর ও কান্না কর, যদি তোমাদের কান্না না আসে তবে কান্নার ভান কর।’ (মুসনাদে বাযযার)

২. নামাজের সময় কান্না

একনিষ্ঠতা ও বিশুদ্ধ নিয়তে ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত ও নফল নামাজ পড়া। নামাজে আল্লাহর ভয় ও বিনয় থাকা জরুরি। তাই নামাজ আদায়ের সময় আল্লাহর ভয়ে কান্না করা। এ কারণেই হজরত জাসসাস রাহমাতুল্লাহি আলাইহি আহকামুল কোরআনে বলেছেন, ‘নামাজের মধ্যে আল্লাহর ভয়ে কান্না করা নামাজকে বিনষ্ট করে না। বরং আল্লাহ তাদের প্রশংসা করেছেন।

৩. কবরের আজাবের ভয়ে কান্না

কোরআন ও সুন্নায় মৃত্যু পরবর্তী সময়ে কথা এসেছে। মৃত্যুর পরই কবরে পাপীদের শাস্তি ও নেককার বান্দাদের শান্তি শুরু হয়ে যাবে। পাপেীদের কবরের আজাব বা শাস্তি হবে ভয়াবহ। তাই ইসলাম আমাদের কবর আজাব ও তার ভয়াবহতা থেকে আশ্রয় চাওয়ার জন্য বলেছেন। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সব সময় কবরের আজাব ও তার ভয়াবহতার জন্য কান্না করতেন। (মুসনাদে আহমাদ)

কবরের আজাব থেকে বাঁচতে নবিজির নির্দেশনা

হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমরা যখন কেউ নামাজের তাশাহহুদ পড়, তখন চারটি জিনিস থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রার্থনা করা চাই। এই বলে দোয়া করবে-

اَللَّهُمَّ إِنِّيْ أَعُوْذُ بِكَ مِنْ عَذَابِ جَهَنَّمَ،  وَمِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ،  وَمِنْ فِتْنَةِ الْمَحْيَا وَالْمَمَاتِ، وَمِنْ شَرِّ فِتْنَةِ الْمَسِيْحِ الدَّجَّالِ

উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিন আজাবি জাহান্নাম, ওয়া মিন আজাবিল কাবর, ওয়া মিন ফিতনাতিল মাহয়িয়া ওয়াল মামাতি ওয়া মিন শাররি ফিতনাতিল মাসিহিদ দাজ্জাল।’

অর্থ : ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে জাহান্নামের আজাব থেকে আশ্রয় চাই। কবরের আজাব থেকে আশ্রয় চাই। জীবন-মৃত্যুর ফিতনা থেকে আশ্রয় চাই। আর মাসিহ দাজ্জালের ফিতনার ক্ষতি থেকে আশ্রয় চাই।’ (মুসলিম)

৪. বিশেষ সাহায্য চেয়ে কান্না

বিশেষ কোনো কাজে সফলতা পাওয়ার জন্য দোয়া করার সময় আল্লাহর সাহায্য চেয়ে কাছে কান্না করার অনুমোদন দিয়েছে ইসলাম। যার প্রমাণ নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনেও রয়েছে। তিনি বদরের যুদ্ধের আগের দিন আল্লাহর কাছে কান্না করেছিলেন। হাদিসে এসেছে-

হজরত আলি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, বদরের যুদ্ধের দিন মিকদাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু ছাড়া আর কেউ অশ্বারোহী ছিল না। আমরা দেখলাম রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে সারারাত নামাজ পড়েছেন আর কেঁদেছেন। এ অবস্থায় সকাল হয়ে গেলো।’ (মুসনাদে আবু ইয়ালা)

৫. কবর জিয়ারতের সময় কান্না করা

কবর জিয়ারতে মন নরম হয় এবং মৃত্যুর কথা স্মরণ হয়। মানুষের আশা ছোট হয়, দুনিয়ার প্রতি আসক্তি কমে যায়। চোখজুড়ে কান্না আসে। উদাসিনতা দূর হয়ে যায়। ইবাদত-বন্দেগির আগ্রহ তৈরি হয়। এ কারণেই নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একাধিক হাদিসে বলেছেন-

> ‘আমি তোমাদের কবর জিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম, এখন কবর জিয়ারত কর।’ (মুসলিম)

> ‘তোমরা কবর জিয়ারত কর। কবর জিয়ারত মৃত্যুকে স্মরণ করিয়ে দেয়।’ (মুসলিম)

> কবর জিয়ারত মানুষকে তার নিজের মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তাই কবর জিয়ারতের সময় কান্নাকাটি করার অনুমোদন রয়েছে ইসলামে। ‘নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবর জিয়ারতের সময় কাঁদতেন।’ (মুসলিম)

৬. নিকটাত্মীয়ের মৃত্যুর পর কান্না

সন্তান-সন্তুতি ও আত্মীয়-স্বজনের মৃত্যুর পর কান্নাকাটি করা স্বাভাবিক ব্যাপার। তাই ইসলামি শরিয়ত এক্ষেত্রে কান্নার অনুমতি দিয়েছে। স্বয়ং নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে তাঁর সন্তান-সন্তুতি ও আত্মীয়-স্বজনের মৃত্যুতে কান্নার উদাহরণ রয়েছে। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর চাচা হজরত হামজার ইন্তেকালের পর তার নাক, কান কেটে বিকৃত করা হয়েছিল। তা দেখে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কেঁদেছিলেন।’ (ইবনে মাজাহ)

৭. বিপদে আল্লাহর সাহায্য চেয়ে কান্না

প্রাকৃতিক বিপদসহ যাবতীয় বিপদ-আপদ থেকে মুক্তি জন্য আল্লাহর সাহায্য চেয়ে কান্নাকাটি করা উচিত। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর উম্মতকে এমন নির্দেশ দিয়েছেন এভাবে-

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে সূর্য গ্রহণ হলে তিনি নামাজ পড়লেন এবং তাতে দীর্ঘ কিয়াম করলেন। এরপর রুকুতে গিয়ে দীর্ঘক্ষণ অবস্থান করলেন। রুকু থেকে সোজা হয়ে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেন। হজরত শোবা বললেন, আমার ধারণা মতে, তিনি (আতা) সেজদার ব্যাপারেও অনুরূপ বলেছেন। তিনি সেজদার অবস্থায় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছেন।’ (নাসাঈ)

৮. অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে গিয়ে কান্না

অন্ধকার দেখে যেমন আলো বোঝা যায়, তেমনি রোগী দেখে সুস্থ মানুষের সুস্থতা ও করণীয় উপলব্দি করা যায়। তখন নিজের সুস্থতার জন্য আল্লাহর শুকরিয়া আদায় এবং অসুস্থ ব্যক্তির প্রতি সহানুভূতি ও সহমর্মিতা প্রকাশ করার জন্য কান্নাকাটি করার জন্য শরিয়তে অনুমোদন রয়েছে। হাদিসে পাকে এসেছে-

হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, সাদ বিন আবি উবাদাতাহ কোনো এক রোগে ভুগছিলেন। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আব্দুর রহমান ইবনে আউফ, সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস এবং আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহুমসহ তাঁকে দেখতে এলেন। তার কাছে গিয়ে দেখলে তিনি পরিবার-পরিজন দ্বারা বেষ্টিত আছেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি কি মারা গেছেন? তারা বলল, না, হে আল্লাহর রাসুল! এ কথা শুনে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কেঁদে ফেললেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কান্না দেখে তারাও কাঁদতে লাগলেন। তখন তিনি বললেন, তোমাদের কোনো চোখের অস্রু এবং অন্তরের শোকের জন্য আল্লাহ কাউকে শাস্তি দেবেন না। …’ (বুখারি)

৯. আল্লাহর ভয়ে কান্না

আল্লাহর ভয়ে কান্না করা মুমিনের একটি বিশেষ গুণ এবং একনিষ্ঠতার বড় প্রমাণ। আল্লাহর ভয় ঈমানের অপরিহার্য উপাদন। কেননা ঈমান হলো, আশা ও ভয়ের ভেতরে। নবি রাসুলদের বৈশিষ্ট্যের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন-

اِنَّهُمۡ کَانُوۡا یُسٰرِعُوۡنَ فِی الۡخَیۡرٰتِ وَ یَدۡعُوۡنَنَا رَغَبًا وَّ رَهَبًا ؕوَ کَانُوۡا لَنَا خٰشِعِیۡنَ

‘এরা সৎ কাজে ছিল ক্ষিপ্রগতি, তারা আমাকে ডাকতো আশা নিয়ে ও ভীত হয়ে, আর তারা ছিল আমার প্রতি বিনয়ী।’ (সুরা আম্বিয়া : আয়াত ৯০)

জীবনের সব ক্ষেত্রে মহান আল্লাহ তাআলাকে ভয় করতে হবে। আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করা যাবে না। আল্লাহ বলেন-

فَلَا تَخۡشَوُا النَّاسَ وَ اخۡشَوۡنِ

‘সুতরাং তোমরা মানুষকে ভয় করো না, আমাকে ভয় কর।’ (সুরা মায়েদা : আয়াত ৪৪)

আল্লাহর ভয়ই বান্দার অন্তরকে বিগলিত করে আর বান্দার অন্তর বিগলিত হলে আল্লাহর ভয়ে অশ্রু প্রবাহিত হয়। কেননা আল্লাহ  মানুষ ও তার অন্তরের মাঝে আড়াল হয়ে আছেন। আল্লাহ বলেন-

وَ اعۡلَمُوۡۤا اَنَّ اللّٰهَ یَحُوۡلُ بَیۡنَ الۡمَرۡءِ وَ قَلۡبِهٖ وَ اَنَّهٗۤ اِلَیۡهِ تُحۡشَرُوۡنَ

‘তোমরা জেনে রাখ! নিশ্চয়ই আল্লাহ মানুষ ও তার হৃদয়ের মাঝে অন্তরায় হন। আর নিশ্চয়ই তাঁর কাছে তোমাদেরকে সমবেত করা হবে।’ (সুরা আনফাল : আয়াত ২৪)

সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, উল্লেখিত প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করে নিজেদের পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত রাখা। দ্বীনের সঠিক পথে চলা। পরকালকে সহজ ও সফল করা। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে আমলগুলো যথাযথভাবে আদায় করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

দৈনিক বগুড়া