শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ইসলামে প্রতিবন্ধীর অধিকার

ইসলামে প্রতিবন্ধীর অধিকার

১৯৯২ সাল থেকে প্রত্যেক বছরের ৩ ডিসেম্বর বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে ‘বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস’। প্রতিবন্ধীদের প্রতি সহমর্মিতা, সহযোগিতা ও তাদের সমঅধিকারের ব্যাপারে গণসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পালিত হয় দিবসটি।

প্রতিবন্ধী বলতে আমরা তাদের বুঝি, যাদের দেহের কোনো অংশ বা তন্ত্র আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে, ক্ষণস্থায়ী বা চিরস্থায়ীভাবে তার স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা হারিয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপে দেখা গেছে, দেশের মোট জনসংখ্যার ২ দশমিক ৮০ শতাংশের মধ্যে শারীরিক বা মানসিক কোনো না কোনো প্রতিবন্ধিতা রয়েছে। সে হিসেবে দেশের ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে এই সংখ্যা ৪৮ লাখের কম নয়। তারা কেউ যাতে অবহেলা ও অবজ্ঞার শিকার না হয় এবং সমাজে একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে জীবন যাপন করার অধিকার পায়, সেই ব্যবস্থা করতে বলেছে ইসলাম। একইসঙ্গে এসব মানুষের মানসম্মান রক্ষা এবং তাদের সঙ্গে কোমল আচরণ করারও নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম।

শুধু প্রতিবন্ধী নয়, যেকোনো ধরনের অসুস্থ ও অক্ষম ব্যক্তির প্রতি মানবিক ও সহযোগিতাপূর্ণ আচরণ করা প্রত্যেক মুসলিমের দায়িত্ব ও কর্তব্য। আমাদের মনে রাখতে হবে, আল্লাহই সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা। তিনি ভালো-মন্দেরও সৃষ্টিকর্তা। কিন্তু তাঁর সৃষ্টিকুলের কিছু অংশকে আমরা অনেক সময় অস্বাভাবিক ও অসুস্থ দেখতে পাই। অথচ এর পেছনে রয়েছে রহস্য ও কল্যাণ। যা সসর্বশক্তিমান আল্লাহ তাআলাই ভালো জানেন। কী কী রহস্য থাকতে পারে এমন কিছু কথা বিজ্ঞজনেরা উল্লেখ করেছেন। যেমন—

ক) আল্লাহর একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রকাশ। অর্থাৎ তিনি যেমন স্বাভাবিক সুন্দর সৃষ্টি করতে সক্ষম, তেমন তিনি এর ব্যতিক্রমও করতে সক্ষম- এ বিষয়টি বান্দাদের জানানো।

খ) শারীরিক মানসিকভাবে সুস্থরা যেন আল্লাহর দয়া ও অনুকম্পাকে স্মরণ করে, অতঃপর তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। কারণ আল্লাহ চাইলে তার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম কিছু করতে পারতেন।

গ) প্রতিবন্ধীকে আল্লাহ তাআলা এই প্রতিবন্ধিতার বিনিময়ে তাঁর সন্তুষ্টি, দয়া, ক্ষমা এমনকি জান্নাতও দিতে পারেন। নবী (স.) বলেছেন, ‘আমি যার দুই প্রিয়কে (দুই চোখ) নিয়ে নিই, অতঃপর সে ধৈর্য ধরে এবং নেকির আশা করে, তাহলে আমি তার জন্য এর বিনিময়ে জান্নাত ছাড়া অন্য কিছুতে সন্তুষ্ট হই না।' (তিরমিজি: ২৪০১)

ঘ) প্রতিবন্ধীরা আল্লাহর পরীক্ষা। তারা সবর করবেন এবং আল্লাহর ফায়সালার ওপর সন্তুষ্ট থাকবেন। আবার এই পরীক্ষা সুস্থ মানুষদের জন্যও। আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘আল্লাহ দয়ালুদের ওপর দয়া ও অনুগ্রহ করেন। যারা জমিনে বসবাস করছে তাদের প্রতি তোমরা দয়া করো, তাহলে যিনি আকাশে আছেন, তিনি তোমাদের প্রতি দয়া করবেন। যে লোক দয়ার সম্পর্ক বজায় রাখে, আল্লাহও তার সঙ্গে নিজ সম্পর্ক বজায় রাখেন। যে লোক দয়ার সম্পর্ক ছিন্ন করে, আল্লাহও তার সঙ্গে দয়ার সম্পর্ক ছিন্ন করেন।’ (তিরমিজি: ১৯২৪)

অর্থাৎ মহান আল্লাহ দেখতে চান যে কারা প্রতিবন্ধী, অসহায়, অসুস্থ ও অক্ষমদের সহযোগিতার মাধ্যমে আল্লাহর পরীক্ষায় পাস করে।

ইসলামের সোনালী যুগে প্রতিবন্ধীরাও সর্বোচ্চ সম্মান ও মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। তাঁদের অনেকেই বিখ্যাত আলেম ও মুহাদ্দিস ছিলেন; যেমন—ইবনে আব্বাস (রা.) আসিম আল আহওয়াল, আমর ইবনে আখতাব আল আরাজ, আবদুর রহমান আল আসম ও আমাশ প্রমুখ।

অক্ষম ও প্রতিবন্ধীদের নবী (স.) সম্মান ও সহমর্মিতা প্রদর্শন করতেন। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘এক নারীর বুদ্ধিতে কিছু ত্রুটি ছিল। সে বলল, হে আল্লাহর রাসুল! আপনার সঙ্গে আমার প্রয়োজন আছে। রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন, হে অমুকের মা, তুমি কোনো রাস্তা দেখে নাও, আমি তোমার কাজ করে দেব। তারপর তিনি কোনো পথের মধ্যে তার সঙ্গে দেখা করলে সে তার কাজ সেরে নিল।’ (সহিহ মুসলিম: ২৩২৬)

হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (স.)-কে বলতে শুনেছি, ‘আল্লাহ তাআলা আমার কাছে ওহি পাঠিয়েছেন যে, যে ব্যক্তি ইলম অন্বেষণের রাস্তায় চলবে, আল্লাহ তার জান্নাতের রাস্তা সহজ করে দেবেন। আর আমি (আল্লাহ) যার দুই প্রিয় জিনিস (চোখ) নিয়ে নিয়েছি তার জন্য জান্নাত রেখে দিয়েছি।’ (শুয়াবুল ঈমান লিল বায়হাকি: ৫৩৬৭)

ইসলাম প্রতিবন্ধী, অক্ষম ও দুর্বল ব্যক্তিদের অনেক কঠিন কাজ সহজ করে দিয়েছে এবং তাদের থেকে কষ্ট দূর করার বিধান দিয়েছে। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘তিন ব্যক্তি থেকে কলম উঠিয়ে রাখা হয়েছে—ঘুমন্ত ব্যক্তি যতক্ষণ না সে জাগ্রত হয়, নাবালেগ যতক্ষণ না সে বালেগ হয় এবং পাগল যতক্ষণ না সে জ্ঞান ফিরে পায় বা সুস্থ হয়।’ (ইবনে মাজাহ: ২০৪১)

অন্ধ লোককে পথ না দেখিয়ে বিপথগামী করা, তাদেরকে অনর্থক কষ্ট দেওয়া ও উপহাস করা থেকে নবী (স.) কঠোরভাবে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেন, ‘সেই ব্যক্তি অভিশপ্ত, যে অন্ধকে পথ ভুলিয়ে দিল।’ (মুসনাদে আহমদ: ১৮৭৫)

রাসুলুল্লাহ (স.) আমর ইবন জামুহ (রা.)-কে সম্মান ও মর্যাদা দিয়ে বলেছিলেন, ‘তোমাদের সর্দার হলো ফরসা ও কোঁকড়ানো চুলবিশিষ্ট আমর ইবনে জামুহ।’ (হিলয়াতুল আউলিয়া: ৭/৩১৭)

আবু কাতাদাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার আমর ইবনে জামুহ (রা.) রাসুলুল্লাহ (স.)-এর কাছে এসে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমি যদি আল্লাহর পথে জিহাদ করে শহীদ হই, তাহলে জান্নাতে আমি কি সুস্থ ও স্বাভাবিক পায়ে হাঁটতে পারব? তার পা পঙ্গু ছিল। রাসুল (স.) বললেন, হ্যাঁ। উহুদের যুদ্ধে তিনি, তাঁর এক ভাইয়ের ছেলে ও তাঁদের একজন দাস শহীদ হন। তার কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় রাসুল (স.) তাকে লক্ষ্য করে বললেন, আমি যেন তোমাকে জান্নাতে সুস্থ ও স্বাভাবিক পায়ে হাঁটতে দেখছি। রাসুল (স.) তাদের দুজন ও গোলামকে এক কবরে দাফন করার আদেশ দিলেন, ফলে তারা তাদেরকে এক কবরে দাফন করল।’ (মুসনাদে আহমদ: ২২৫৫৩)

আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) ইবনে উম্মে মাকতুম (রা.) মদিনায় দুইবার তাঁর স্থলাভিষিক্ত করেছেন এবং তিনি অন্ধ হওয়া সত্ত্বেও সালাতের ইমামতি করেছেন। (মুসনাদে আহমদ: ১৩০০০)

রাসুলুল্লাহ (স.)-এর পর মুসলিম খলিফারাও প্রতিবন্ধীদের ব্যাপারে তাঁর পথ অনুসরণ করেন। তাঁরা রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিবন্ধীদের শারীরিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, মানসিক ও তাদের সব ধরনের প্রয়োজন পূরণ করেছেন। খলিফা ওমর ইবনে আবদুল আজিজ (রহ.) সব প্রদেশে ফরমান জারি করেন, সব অন্ধ, অক্ষম, প্লেগ রোগী ও এমন অঙ্গবৈকল্য, যা তাকে সালাতে যেতে বাধা দেয়, তাদের পরিসংখ্যান তৈরির আদেশ দেন। ফলে তারা এসব লোকের তালিকা করে খলিফার কাছে পেশ করলে তিনি প্রত্যেক অন্ধের জন্য একজন সাহায্যকারী নিয়োগ করেন, আর প্রতি দুজন প্রতিবন্ধীর জন্য একজন খাদেম নিযুক্ত করেন, যে তাদের দেখাশোনা ও সেবা করবে।

উমাইয়া খলিফা ওয়ালিদ ইবন আবদুল মালিকও প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে কাজ করেন। তিনি সর্বপ্রথম প্রতিবন্ধীদের দেখাশোনার জন্য বিশেষ ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সেবাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। ৮৮ হিজরি মোতাবেক ৭০৭ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত এসব শিক্ষাকেন্দ্রে ডাক্তার ও সেবক নিয়োগ করেন। প্রতিবন্ধীদের নিয়মিত ভাতা প্রদান করেন। সব অক্ষম, পঙ্গু ও অন্ধের জন্য খাদেম নিযুক্ত করেন।

প্রতিবন্ধী হয়েও ইসলামের ইতিহাসে সম্মান ও খ্যাতি অর্জন করেন বহু মনীষী; যেমন—

১. হজরত মুয়াজ বিন জাবাল (রা.) পঙ্গু ছিলেন। তাঁকে রাসুলুল্লাহ (স.) ইয়েমেনের গভর্নর হিসেবে প্রেরণ করেন।

২.  আবদুল্লাহ ইবনে মাকতুম (রা.)-কে ১৪ বার মদিনার স্থলাভিষিক্ত করা হয়। অথচ তিনি ছিলেন অন্ধ।

৩. হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) শেষ জীবনে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। তারপরও তিনি কোরআনের শ্রেষ্ঠ ভাষ্যকার ও সমকালের শ্রেষ্ঠ হাদিস বিশারদের মর্যাদা অর্জন করেন।

৪. শ্রেষ্ঠ তাবেয়িদের অন্যতম হজরত আতা (রহ.) কৃষ্ণাঙ্গ, অন্ধ ও বোজা নাকের অধিকারী ছিলেন। শুধু তা-ই নয়, তাঁর হাত ছিল পক্ষাঘাতগ্রস্ত এবং পা ছিল ল্যাংড়া।

৫. আল-আসাম (সাদা পা-বিশিষ্ট)। হাতিম ইবনে উনওয়ান (মৃত্যু ২৩৭ হিজরি), তিনি আল্লাহভীরুতা, আত্মসংযম ও অনাড়ম্বর জীবনযাপনের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তাঁকে এ উম্মতের লোকমান হাকিম বলা হতো।

৬. আল-আহওয়াল (ট্যারা চোখবিশিষ্ট)। ‘আসিম ইবনে সোলায়মান আল-বসরি (মৃত্যু ১৪২ হিজরি), তিনি হাফিজুল হাদিস ও সিকাহ ছিলেন।

অতএব আমাদের দায়িত্ব হবে- নিজের সুস্থতার জন্য আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা এবং প্রতিবন্ধী ভাইবোনদের সহযোগিতা ও তাদের জন্য দোয়া করা। ইসলাম তাদের যেসব অধিকার দিয়েছে তা যথাযথভাবে আদায় করা। প্রতিবন্ধীর দেখাশোনা করা অভিভাবকের জন্য ফরজ। আর সমষ্টিগতভাবে সব মুসলিমের জন্য ফরজে কিফায়া। অর্থাৎ সমাজের কিছু লোক তাদের দেখাশোনা করলে বাকিরা গুনাহগার হবে না। 

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে সবসময় প্রতিবন্ধী, অসুস্থ ও অসহায়ের পাশে দাড়ানোর তাওফিক দান করুন। আমিন।

দৈনিক বগুড়া