
আমরা এখানে সূরা বাকারার ১৭৮-১৯৫ নম্বর আয়াতসমূহের উল্লখযোগ্য শানেনুযুল (আয়াত নাজিলের প্রেক্ষাপট) তুলে ধরছি-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ كُتِبَ عَلَيْكُمُ الْقِصَاص
অর্থ : হে ঈমানদারগণ! তোমাদের প্রতি নিহতদের ব্যাপারে বিধিবদ্ধ করা হয়েছে। স্বাধীন ব্যক্তি স্বাধীন ব্যক্তির বদলায় দাস দাসের বদলায় এবং নারী নারীর বদলায়। অতঃপর তার ভাইয়ের তরফ থেকে যদি কিছুটা মাফ করে দেয়া হয় তবে প্রচলিত নিয়মের অনুসরণ করবে। এবং ভালভাবে তাকে তা প্রদান করতে হবে। এটা তোমাদের পালনকর্তার তরফ থেকে সহজ এবং বিশেষ অনুগ্রহ। এরপরও যে ব্যক্তি বাড়াবাড়ি করে তার জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক আযাব। (আয়াত-১৭৮)।
শানে নুযুল : এই আয়াতের শানে নুযুল সম্পর্কে ওলামায়ে কেরাম লেখেন যে, আইয়্যামে জাহিলিয়াতের যুগে দু’টি গোত্রের মধ্যে লড়াই হয়েছিল। তাদের উভয় দলের লোকই নিহত হয় কিন্তু কেসাস নেয়ার পূর্বেই উভয় গোত্র মুসলমান হয়ে যায়। তখন তারা প্রতিজ্ঞা করে যে, আমাদের একজন নারী হত্যার করণে আমরা তাদের একজন পুরুষ হত্যা করব এবং একজন গোলামের পরিবর্তে একজন স্বাধীন ব্যক্তিকে হত্যা করবো তখন এই আয়াত নাজিল হয়।
وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌ أُجِيبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ
অর্থ : আর আমার বান্দারা যখন তোমার কাছে জিজ্ঞাসা করে আমার ব্যাপারে বস্তুত আমি রয়েছি সন্নিকটে। যারা প্রার্থনা করে তাদের প্রার্থনা কবুল করে নেই, যখন আমার কাছে প্রার্থনা করে। কাজেই আমার হুকুম মান্য করা এবং আমার প্রতি নিঃসংশয়ে বিশ্বাস করা তাদের একান্ত কর্তব্য। যাতে তারা সৎপথে আসতে পারে। (আয়াত : ১৮৪)।
শানে নুযুল : একবার একদল গ্রাম্য লোক রাসূল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করল আল্লাহ তায়ালার কাছে না দূরে? যদি কাছে হয় তাহলে আস্তে ডাকবো আর যদি দূরে হয় তাহলে জোরে ডাকবো। তখনই এই আয়াত নাজিল হয়।
أُحِلَّ لَكُمْ لَيْلَةَ الصِّيَامِ الرَّفَثُ إِلَى نِسَآئِكُمْ
অর্থ : রোজার রাতে স্ত্রীদের সঙ্গে সহবাস করা তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে। তারা তোমাদের পরিচ্ছদ আর তোমরা তাদের পরিচ্ছদ। আল্লাহ অবগত রয়েছেন যে, তোমরা আত্মপ্রতারণা করেছিলে, সুতরাং তিনি তোমাদেরকে ক্ষমা করেছেন এবং তোমাদের অব্যাহতি দিয়েছেন। অতঃপর তোমরা নিজেদের স্ত্রীদের সঙ্গে সহবাস কর এবং যা কিছু তোমাদের জন্য আল্লাহ দান করেছেন তা আহরণ কর। আর পানাহার কর যতক্ষণ না কাল রেখা থেকে ভোরের শুভ্র রেখা পরিস্কার দেখা যায়। অতঃপর রোজা পূর্ণ কর রাত পর্যন্ত। (আয়াত: ১৮৭)।
শানে নুযুল : হজরত বারা ইবনে আযেব (রা.) বলেন, ইসলামের সূচনা লগ্নে নিয়ম ছিলো ইফতারের পর শয্যা গ্রহণের আগ পর্যন্ত খাওয়া দাওয়া এবং স্ত্রী মিলন বৈধ ছিল। আর ঘুমানোর পর খাওয়া দাওয়া ও স্ত্রী মিলন নিষেধ ছিল পরের দিন ইফতার পর্যন্ত। তাতে অনেক সাহাবায়ে কেরাম ভীষণ সমস্যায় পতিত হলেন। একদিনের ঘটনা- হজরত কায়স ইবনে সারমাহ (রা.) সারাদিন কাজ করে ইফতারের সময় বাড়ি ফিরলেন। স্ত্রীর কাছে খাবারের কিছু আছে কিনা জানতে চাইলে না সূচক জবাব দিয়ে বলেন, একটু অপেক্ষা করুন। দেখি কোন ব্যবস্থা করতে পারি কিনা। এই বলে তিনি খাবার তালাশ করতে বের হলেন। এদিকে কায়স ইবনে সারমা (রা.) সারাদিন কর্মজনিত ক্লান্তির কারণে ঘুমিয়ে পড়লেন। স্ত্রী এসে তাকে ঘুমিয়ে দেখে অবাক হয়ে বলেন, তুমি এই কি কান্ড করলে? এভাবে তিনি সারা দিন না খেয়ে পরের দিন রোজা রাখলেন। দুপুর বেলায় ক্ষুধায় তিনি কাতর হয়ে বেহুশ হয়ে গেলেন। অনুরুপ ভাবে অনেক সাহাবীর ঘুম ভাঙ্গার পর স্ত্রী মেলামেশা করে মানসিক কষ্টে পতিত হতেন। আরেক দিনের ঘটনা। একদিন ওমর (রা.) হুজুর (সা.) দরবার থেকে বাড়ি ফিরতে দেরী হয়ে গেল। বাড়িতে গিয়ে দেখে বিবি সাহেবা ঘুমিয়ে পড়েছে। তিনি সহবাস করতে চাইলে বিবি বলে আমি তো ঘুমিয়ে পড়েছি। ওমর (রা.) বলেন, তুমি ঘুমিয়ে আছ আমি তো ঘুমায়নি। এই বলে তিনি সহবাস করলেন। পরবর্তীতে অনুতপ্ত হয়ে তিনি হুজুর (সা.) এর কাছে ঘটনাটি উল্লেখ করেন। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এই আয়াত নাজিল হয়। (ইবনে কাসীব)।
وَلاَ تُبَاشِرُوهُنَّ وَأَنتُمْ عَاكِفُونَ
অর্থ : আর যতক্ষণ তোমরা এতিকাফ অবস্থায় মসজিদে অবস্থান কর ততক্ষণ পর্যন্ত স্ত্রীদের সাথে মিশো না। এই হলো আল্লাহ কর্তৃক বেধে দেওয়া সীমানা। অতএব এক কাছেও যেও না। এমনিভাবে বর্ণনা করেন, আল্লাহ নিজের আয়াতসমূহ মানুষের জন্য যাতে বাঁচতে পারে। (আয়াত : ১৮৭)
শানে নুযুল : ইসলামী সুচনা লগ্নে ইতিকাফ রত অবস্থায় স্ত্রী মিলামেশা বৈধ ছিল পরবর্তীতে আল্লাহ তায়ালা এই আয়াত নাজিল করে তা নিষিদ্ধ করে দেন।
وَلاَ تَأْكُلُواْ أَمْوَالَكُم بَيْنَكُم بِالْبَاطِلِ وَتُدْلُواْ بِهَا إِلَى الْحُكَّامِ لِتَأْكُلُواْ فَرِيقًا مِّنْ أَمْوَالِ النَّاسِ بِالإِثْمِ وَأَنتُمْ تَعْلَمُونَ.
অর্থ : একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ কর না। এ উদ্দেশ্যে বিচারকের কাছে মোকাদ্দমা দায়ের কর না যখন মানুষের সম্পদের কোনো অংশ জেনে-বুঝে জবর দখলের করার পাপের সুযোগ পাবে। (আয়াত-১৮৮)।
শানে নুযূল : আবদান ইবনে আশওয়া ইবনে হাযরামী নামের এক ব্যক্তি ইমরাউল কায়েস ইবনে আমের এর ওপর একটি জমির মালিকানার দাবি করল, অথচ তার কোনো সাক্ষী ছিল না। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, এমতাবস্থায় বিবাদীর শপথের ওপর সিদ্ধান্ত নাও। তখন ইমরাউল কায়েস শপথ করার জন্য উদ্যত হলে তদঘটনার প্রেক্ষিতে উপরিউক্ত আয়াত নাজিল হয়। অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি তোমাদের মতো একজন মানুষ তোমাদের মধ্যে অনেক আছে ছল-চাতুরী। অতঃপর যে ব্যক্তি আমার নিকট বানোয়াট দাবি নিয়ে ধোঁকা দ্বারা মিথ্যাকে সত্যরূপে প্রমাণ করার জন্য। তাহলে আমি প্রকাশ্য প্রমাণানুযায়ী রায় দেব; কিন্তু তার জন্য উহা হবে আগুনের টুকরা। এ প্রসঙ্গে উক্ত আয়াতটি নাজিল হয়। (বুখারী, মুসলিম)।
وَلَيْسَ الْبِرُّ بِأَنْ تَأْتُوْاْ الْبُيُوتَ مِن ظُهُورِهَا وَلَـكِنَّ الْبِرَّ مَنِ اتَّقَى وَأْتُواْ الْبُيُوتَ مِنْ أَبْوَابِهَا وَاتَّقُواْ اللّهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
অর্থ : আর কোনো পুণ্য নেই পেছনের দিক দিয়ে ঘরে প্রবেশ করার মধ্যে বরং নেকের কাজ হচ্ছে, মানুষ তাকওয়া অবলম্বন করবে। তোমরা ঘরে প্রবেশ কর দরজা দিয়ে, আল্লাহকে ভয় কর তবে তোমরা কৃতকার্য হয়ো না। (আয়াত-১৮৯)।
শানে নুযূল : হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত। হজরত হাসান বসরী রহ. বলেন, জাহিলি যুগে অধিকাংশ গোত্রের মধ্যে এমন প্রথা ছিল যে, তারা সফরে বের হলে, কোনো কারণে সফর অসমাপ্ত থাকলে তারা বাড়ি ফিরে ঘরের সম্মুখের দরজা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করত না; বরং ঘরের পেছন দিক দিয়ে প্রবেশ করত। আলোচ্য আয়াত অবতীর্ণ করে জাহিলি প্রথাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ইমাম বুখারী রহ. হজরত বারা (রা.) হতে বর্ণনা করেন। জাহিলিয় যুগের লোকেরা ইহরাম বাঁধা অবস্থায় ঘরের পেছন দিক দিয়ে ঘরে ঢুকে তাদের স্ত্রীদের সঙ্গে দেখা করে চলে যেত, সামনের দিক দিয়ে ঘরে ঢুকত না। এ ধরনের কু-প্রথাকে চিরতরে বন্ধ করার লক্ষ্যে উক্ত আয়াত অবতীর্ণ হয়।
وَقَاتِلُواْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ الَّذِينَ يُقَاتِلُونَكُمْ وَلاَ تَعْتَدُواْ إِنَّ اللَّهَ لاَ يُحِبِّ الْمُعْتَدِينَ
অর্থ : যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তোমরা আল্লাহর পথে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর; কিন্তু সীমালংঘন করো না। নিশ্চয় আল্লাহ সীমালংঘনকারীদেরকে ভালোবাসেন না। (আয়াত-১৯০)।
শানে নুযুল : হজরত আবুল আলীয়া হতে বর্ণিত। এ আয়াতটিই প্রথম আয়াত, যা মদিনার জীবনে যুদ্ধের ব্যাপারে প্রথম অবতীর্ণ হয়েছিল। এ আয়াত অবতীর্ণ হবার পর যারা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করত তাদের বিরুদ্ধে তিনিও যুদ্ধ করতেন। যারা বিরত থাকত তিনিও তাদের থেকে বিরত থাকতেন। এ অবস্থায় শেষ পর্যন্ত সূরায়ে তওবার আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয়। (তাফসীরে ইবনে কাসির)।
لشَّهْرُ الْحَرَامُ بِالشَّهْرِ الْحَرَامِ وَالْحُرُمَاتُ قِصَاصٌ فَمَنِ اعْتَدَى عَلَيْكُمْ فَاعْتَدُواْ عَلَيْهِ بِمِثْلِ مَا اعْتَدَى عَلَيْكُمْ وَاتَّقُواْ اللَّهَ وَاعْلَمُواْ أَنَّ اللهَ مَعَ الْمُتَّقِينَ
অর্থ : পবিত্র মাস পবিত্র মাসের বিনিময়ে। যার পবিত্রতা অলঙ্ঘনীয় তার অবমাননা সকলের জন্য সমান।। সুতরাং যে কেউ তোমাদেরকে আক্রমন করবে তোমরা তাদেরকে অনুরূপ আক্রমণ করবে এবং তোমরা আল্লাহকে ভয় করো আর জেনে রাখ যে, আল্লাহ মুত্তাকিদের সঙ্গে থাকেন। (১৯৪)।
শানে নুযুল : হুদাইবিয়ার সন্ধি স্থাপন হওয়ার পরের বৎসর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ওমরাহ এর কাজা আদায় করতে মক্কায় যান তখন এ সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল যে, কাফেরগণ মুসলমানদেরকে ওমরাহ আদায় করতে বাধা প্রদান করবে। তখন মুসলমানগণ এতে বিচলিত হয়ে পড়েন যে, কীভাবে নিষিদ্ধ মাসে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বিগ্রহ করবে? তখন উক্ত আয়াত অবতীর্ণ হয়।
وَأَنفِقُواْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَلاَ تُلْقُواْ بِأَيْدِيكُمْ إِلَى التَّهْلُكَةِ وَأَحْسِنُوَاْ إِنَّ اللهَ يُحِبُّ الْمُحْسِنِيْنَ
অর্থ : তোমরা আল্লাহর পথে ব্যয় কর এবং নিজেদের হাতে নিজেদেরকে ধ্বংসের হাতে নিক্ষেপ করো না। তোমরা সৎ কাজ কর, আল্লাহ সৎকর্ম পরায়ন লোককে ভালবাসেন। (আয়াত-১৯৫)।
শানে নুযুল : হজরত আবু আইয়ুব আনসারী (রা.) হতে বর্ণিত আছে, মক্কা বিজয়ের পর যখন আরবের সর্বত্র ইসলামের পতাকা উডডীন হয় এবং দিকে দিকে শিরক ও কুফর উৎখাত হয়ে ঈমানের জয় জয়কার ধ্বনি উত্থিত হয় তখন একদা তিনি আত্মতৃপ্তিতে বলেন, ‘এক্ষণে মহান আল্লাহ ইসলামকে সর্বত্র বিজয়ী করেছেন, ফলে মুসলিম সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। আর আমরা শঙ্কাহীন হয়ে পরিবার-পরিজনের কাছে গৃহে ফিরে এসেছি। এমতাবস্থায় আমরা নির্বিঘ্নে গৃহে অবস্থান করতে পারব এবং এতদিনের অনুপস্থিতিতে এলোমেলো সংসার গুছিয়ে নিতে সুযোগ পাব।’ এ উক্তির পরিপ্রেক্ষিতে উক্ত আয়াতটি নাজিল হয়। (তাফসীরে ইবনে কাছীর)। চলবে...
দৈনিক বগুড়া