শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ইসলামে পোশাক পরিধানের বিধি-বিধান

ইসলামে পোশাক পরিধানের বিধি-বিধান

 

ইসলামী শিক্ষা জীবনের প্রতিটি শাখা-প্রশাখায় বিস্তৃত। তাই এর সম্পর্ক সামাজিক কার্যক্রমের সঙ্গে।জীবনে কোনো দিক ইসলামী শিক্ষার বাহিরে নয়।

‘পোশাক’ ও জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাই কোরআন ও হাদীসেও এ বিষয়ে বিস্তারিত দিক নির্দেশনা রয়েছে।

বর্তমান যুগের অপপ্রচার:

ইসলামের বিরুদ্ধে অপপ্রচার আজ ধুমায়িত করা হচ্ছে। পোশাকের ব্যাপারেও চলছে নানামুখী প্রোপাগান্ডা। বলা হচ্ছে, পোশাক ব্যক্তি, পরিবেশ ও দেশের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত; এ ব্যাপারে মানুষ সম্পূর্ণ স্বাধীন। যেকোনো পোশাক পরিধান মানুষের নিজস্ব অধিকার। এ ক্ষেত্রে ইসলামকে টেনে আনা উচিত নয়। এটা সম্পূর্ণ সংকীর্ণতার পরিচয়। এসব মূলত: মোল্লা-মৌলভীর কাজ! ধর্মকে নিজস্ব মতানুসারে চালানোই তাদের লক্ষ্য। তারা ধর্মের ঠিকাদারী নিয়েছে। নিজেদের পক্ষ থেকে কতো কতো ‘শর্ত’ জুড়ে দিয়েছে। অন্যথায় ধর্ম তো সহজ বিষয়। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এতো নিয়ম-কানুন দেননি। মোল্লা-মৌলভীদের সংকীর্ণতার কারণে আজ মানুষ ধর্মকে ‘কঠিন’ মনে করছে। মোল্লারা নিজেরাও বিরত হচ্ছে, অন্যদেরকেও বিরত করছে।

সকল পোশাকের নিজস্ব প্রভাব রয়েছে:

জেনে রাখুন, এসব অপপ্রচারে প্রভাবিত হয়ে এগুলোকে সত্য ভেবে বসবেন না। এগুলো স্রেফ অপপ্রচার এবং ইসলাম ও মুসলমানদের স্বকীয়তা নষ্ট করার ষড়যন্ত্র। অন্যথায় পোশাক কোনো সাধারণ বিষয় নয়।। কেউ চাইলেই নিজের ইচ্ছে মতো পোশাক পরতে পারে না। পোশাকের প্রভাব মানুষের আত্মা, চরিত্র, ধর্ম ও কর্মে পড়ে। মনোবিজ্ঞানীরাও আজ একথা স্বীকার করতে বাধ্য যে, পোশাক নিছক কোনো কাপড় নয়, বরং পোশাকের একটা প্রভাব আছে। মানুষের বাস্তবজীবনে ও জীবনের চিন্তাধারায় এর প্রভাব অনস্বীকার্য।

হজরত ওমর (রা.) এর মনে জুব্বার প্রভাব:

বর্ণিত আছে, একবার হজরত ওমর (রা.) মূল্যবান একটি জুব্বা পরে মদীনার মসজিদে খুতবা দেয়ার উদ্দেশ্যে গেলেন। খুতবা শেষে বাড়িতে ফেরার সময় জুব্বাটি খুলে ফেললেন। বললেন, ভবিষ্যতে আমি আর এ জুব্বা পরব না। এ তো জুব্বা নয়; বরং অহংকারের উৎস। এটি পরে আমি নিজেকে অহংকারী হিসেবে আবিস্কার করেছি। সুতরাং ভবিষ্যতে এটি পরা যাবে না।

একটি আড়ম্বর জুব্বা হজরত ওমর (রা.) এর হৃদয়ে এভাবে রেখাপাত করল। অথচ সত্তাগতভাবে জুব্বাটি হারাম ছিল না। আল্লাহ তায়ালা তাদের মেযাজকে পবিত্র করেছিলেন। স্বচ্ছ আয়নার মত সবকিছু ধরা পড়ে যেত তাদের হৃদয়ের আয়নায়। সাদা কাপড়ের দাগের মতো সহজেই ধরে ফেলতেন তাদের হৃদয়ের ক্ষুদ্রতম দাগও। যেমনটি ধরে ফেলেছেন হজরত ওমর (রা.)। পোশাকের প্রভাব তিনি অনুভব করেছেন। জীবন ও চরিত্রে তার অশুভ প্রতিক্রিয়া উপলব্ধি করেছেন।

অথচ আমাদের অন্তর আজ দাগে ভরে গেছে। ময়লাযুক্ত কাপড়ের মতো ভেতরটা কালো হয়ে গেছে। তাই নতুন কোনো গুনাহের দাগ আমাদের কাছে ধরা পড়ে না। গুনাহর দাপাদাপির সঙ্গে আমরা পেরে ওঠি না। যাক, ইসলামে পোশাকের গুরুত্ব অবশ্যই রয়েছে। পোশাকের ব্যাপারে ইসলামের দিকনির্দেশনাও রয়েছে। তাই এ সম্পর্কে মৌলিক নীতিমালা জানতে হবে এবং সে অনুযায়ী আমল করার চেষ্টা করতে হবে।

বর্তমান যুগের আরেকটি অপপ্রচার ও প্রোপাগান্ডা: এ অপপ্রচারটিও বেশ হাস্যকর। বলা হচ্ছে, জনাব! ধর্মের সম্পর্ক অন্তরের সঙ্গে; শরীরের সঙ্গে নয়। বাহ্যিক পোশাক-আশাক নিয়ে ধর্মের কোনো মাথাব্যথা নেই। আমাদের লেবাস-পোশাক এমন হলে কী হবে, অন্তর তো ঠিক আছে। নিয়ত পরিষ্কার আছে। আর যার অন্তর সাফ, তার বাহ্যিক দিক ঠিক না থাকলে এমন কী-ই-বা আসে যায়? ইসলাম মানুষের অন্তর দেখে। নিয়ত শুদ্ধ হলেই আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক রাখা যায়।

ভেতর ও বাহির উভয়টাই ঠিক থাকতে হবে:

মনে রাখবেন, এসব হাস্যকর অপপ্রচার শুনে সে দিকে ঝুঁকে পড়বেন না। কেননা ইসলামের বিধি-বিধান ভেতর ও বাহির উভয় ক্ষেত্রেই রয়েছে। অন্তর যেমন সাফ হতে হয়, বাহ্যিক অবয়ব তেমনি পরিশুদ্ধ হতে হয়। নিয়ত যেমনিভাবে বিশুদ্ধ হতে হয়, তেমনিভাবে শরীর-পোশাকও রুচিশীল হতে হয়। এ মর্মে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে-

وذروا ظاهرا الاثم و باطنه

‘তোমরা প্রকাশ্য ও পোপন গুনাহ পরিত্যাগ কর।’ (সূরা: আনআম, আয়াত: ১২০)

আসলে যার অন্তর স্বচ্ছ থাকে, তার বাহ্যিক চাল-চলনও পবিত্র থাকে। ভেতর ঠিক না হলে বাহির খারাপ হবে অবশ্যই।

একটি চমৎকার উদাহরণ:

এ প্রসঙ্গে এক বুযুর্গ চমৎকার একটি উপমা দিয়েছেন। ফল নষ্ট হলে চামড়াতেও দাগ পড়ে। ফলের ভেতর পচে গেলে বাইরে পচে যায়। তেমনিভাবে কারো অন্তরে অবক্ষয় শুরু হলে, বাহ্যিক অবস্থাতেও তার প্রভাব পড়বে। অন্তর খারাপ হলে উপরের অবস্থাও খারাপ হবে এবং অবশ্যই হবে।

দুনিয়াবি কাজে বাহ্যিক দিকও বিবেচ্য হয়:

বাড়ি বানালে তার ওপর প্লাস্টার করতে হয়। রঙ করতে হয়। শুধু ছাদ ঢালাই আর চার দেয়াল তৈরি করলেই বাড়ি হয়ে যায় না। হ্যাঁ, এর দ্বারা বাড়ির ভেতরে থাকার উপযোগী হয়, তবে বাড়ির আসল সৌন্দর্য প্রস্ফুটিত হয় না।

অনুরূপভাবে একটি গাড়ির কথাই ধরুন। শুধু ভেতর তথা ইঞ্জিন থাকলেই গড়ি হয়ে যায় না। রবং ওপর তথা ‘বডি’র প্রয়োজনও সবাই স্বীকার করে। এজন্য কোনো ব্যক্তি গাড়ির ইঞ্জিনের মালিক হওয়ার অর্থ গাড়ির মালিক হওয়া নয়। বরং এর জন্য বডিও লাগে।

বুঝা গেল, পার্থিব সব ক্ষেত্রে শুধু ভেতর ঠিক হলেই চলে না; ওপরও ঠিক হওয়া লাগে। অথচ যতো বাহানা কেবল দ্বীনের ক্ষেত্রে। দ্বীনকে আজ আমরা ‘বেচারা’ বানিয়ে রেখেছি। দ্বীন আমাদের কাছে আজ অবহেলিত বিষয়। দ্বীনের কোনো বিষয় আসলেই ‘ভেতর ও ওপর’ এর দর্শন আমাদের মাঝে উতলে ওঠে।

এটি শয়তানের ধোকা:

মূলত এ ধরণের ‘দর্শন’ শয়তানের ধোঁকা বৈ কিছু নয়। কারণ প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য, ভেতর ও বাহিরের অবস্থা একই সঙ্গে টিক থাকতে হবে। পোশাক-আশাক পানাহার ও সামাজিক শিষ্টাচারের সম্পর্ক যদিও মানুষের বাহ্যিক অবস্থার সঙ্গে, তবে এগুলোরও একটা প্রভাব অবশ্যই আছে। যে প্রভাবটা পড়ে মানুষের অন্তরের মাঝে। বিধায় পোশাককে যারা সাধারণ বিষয় মনে করে তারা ইসলামের তাৎপর্য সম্পর্কে এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। যদি তাদের ধারণাই সঠিক হত, তাহলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পোশাকের ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা দিতেন না। যেসব ক্ষেত্রে মানুষ ভুলের শিকার হয়, সেসব ক্ষেত্রেই তো তাঁর দিকনির্দেশনা প্রয়োজন। তাই পোশাক সম্পর্কেও তার নির্দেশনা ও নীতিমালা জানা অবশ্যই জরুরি।

শরীয়ত কোনো পোশাক নির্দিষ্ট করেনি:

ইসলাম পোশাকের ব্যাপারে দিয়েছে যথোপযুক্ত নীতিমালা। ইসলাম কোনো নির্দিষ্ট পোশাক কিংবা ডিজাইন নির্ধারিত করে একথা বলেনি যে, ইসলামি পোশাক এটাই এবং এর বাইরে অন্য যেকোনো পোশাক ইসলাম পরিপন্থী। সুতরাং এটাই পরতে হবে। বরং ইসলাম উদার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পোশাকের মূল্যায়ন করেছে, যেহেতু ইসলাম হলো, প্রকৃতির ধর্ম। তাই দেশ, জাতি, রুচি, অবস্থা ও মৌসুমের কারণে পোশাকের ভিন্নতার প্রয়োজনীয়তা ইসলাম অস্বীকার করেনি। ইসলামের নীতিমালা অনুসরণ করে যেকোনো ধরণের পোশাক পরিধানের অনুমতি ইসলাম দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে শুধু ইসলামরে মূলনীতির প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। মূলনীতি রক্ষা করে সব ধরণের পোশাক পরা যাবে।

পোশাক সংক্রান্ত চারটি মূলনীতি:

কোরআন মাজীদের একটি আয়াতে পোশাক সম্পর্কে চারটি মূলনীতি উল্লেখ করা হয়েছে। আয়াতটি হল-

يا بنى آدم قد انزلنا عليكم لباسا يوارى سو اتكم وريشا ولباس التقوى ذالك خير

‘হে বনী আদম! আমি তোমাদের জন্য পোশাক অবতীর্ণ করেছি, যা তোমাদের লজ্জাস্থান আবৃত করে এবং অবতীর্ণ করেছি সাজসজ্জার বস্ত্র এবং পরহেযগারীর পোশাক; এটি সর্বোত্তম।’ (সূরা আরাফ: ২৬)

পোশাকের প্রথম মৌলিক উদ্দেশ্য:

আলোচ্য আয়াতে পোশাকের প্রথম মূল লক্ষ্য চি‎হ্নি‎তকরণকল্পে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘যা দ্বারা তোমাদের গুপ্তাঙ্গ আবৃত করতে পার। এখানে سوآة শব্দের অর্থ হলো, ওই সব বস্তু বা বিষয় যার আলোচনা করা কিংবা খোলা রাখা মানুষ স্বভাবতই লজ্জাজনক মনে করে। উদ্দেশ্য হলো, সতর ঢেকে রাখা, পুরুষ ও নারীর কিছু অঙ্গকে আল্লাহ তায়ালা ‘সতর’ হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। যে অঙ্গগুলো আবৃত রাখা আবশ্যক। এক্ষেত্রে পুরুষের সতর ভিন্ন এবং নারীর সতর ভিন্ন। পুরুষের সতর হলো, নাভি থেকে নিয়ে হাঁটু পর্যন্ত। আর নারীর জন্য মুখমন্ডল ও পায়ের গোড়ালি ছাড়া সম্পূর্ণ শরীরটাই সতর। সতর ঢাকা ফরজ। যে পোশাক সতর আবৃত রাখতে ব্যর্থ তা শরীয়তের দৃষ্টিতে পোশাকেরই অন্তরভুক্ত নয়।

পোশাকে তিনটি দোষ:

তিন ধরণের পোশাক প্রথম মূলনীতি তথা সতর আবৃত করতে ব্যর্থ-

এক. এমন সংক্ষিপ্ত পোশাক যা পরলে সতর সম্পূর্ণ আবৃত্ত হয় না।

দুই. এমন পাতলা-ফিনফিনে পোশাক যা পরিধান করলে সতর আবৃত হয় বটে; তবে পাতলা হওয়ার কারণে শরীর স্পষ্ট দেখা যায়।

তিন. এমন আঁট-সাঁট পোশাক যা পরিধান করা সত্তেও শরীরের স্পর্শকাতর অঙ্গসমূহ দেখা যায়। এ তিন ধরণের পোশাক পরিপূর্ণভাবে সতর আবৃত করতে ব্যর্থ বিধায় শরীয়তের দৃষ্টিতে হারাম হিসেবে বিবেচিত হবে।

বর্তমান যুগের নগ্ন পোশাক: বর্তমান যুগের ফ্যাশন হলো, নগ্ন পোশাক। ফ্যাশনের নিয়ন্ত্রণহীন গতি পোশাকের মূলনীতিকে রক্তাক্ত করে তুলেছে। দেহের কোন অঙ্গ উন্মুক্ত আর কোন অঙ্গ আবৃত এ নিয়ে কারো যেন মাথা ব্যথা নেই। অথচ ইসলামের দৃষ্টিতে এ জাতীয় পোশাক পোশাকই নয়। যে নারী এ জাতীয় পোশাক পরে তার সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

كاسيات عاريات

‘তারা পোশাক পরেও নগ্ন হবে।’ (মুসলিম, হাদীস নং- ৩৯৭১, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং- ৮৩১১)

যেহেতু তাদের এ জাতীয় পোশাক পোশাকের মূল উদ্দেশ্যকেই আহত করেছে, তাই যদিও তারা পোশাক পরেছে, মূলত তারা উলঙ্গ। আধুনিক যুগের নারীদের মাঝে এসব নগ্নতা আজ ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়েছে। তাদের অঙ্গশোভার রঙনাচন আজ যুব সমাজকে অনৈতিকতার দুর্গন্ধময় নর্দমায় নিক্ষেপ করছে। লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে নারীরা আজ নেচে-গেয়ে বেড়াচ্ছে।

আল্লাহর ওয়াস্তে এগুলো বর্জন করুন। নিজের আত্মমর্যাদাবোধ জাগিয়ে তুলুন। পণ্যপ্রবণ জীবন নয়, বরং মর্যাদাপূর্ণ জীবন যাপন করুন। প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশনা মতো জীবনকে পরিচালনা করুন।

দৈনিক বগুড়া