শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কালের সাক্ষী হযরত শোয়াইবের (আ.) শহর মাদায়েন

কালের সাক্ষী হযরত শোয়াইবের (আ.) শহর মাদায়েন

লোহিত সাগরের পশ্চিম উপকূলবর্তী সিরিয়া ও হিজাজের সীমান্তবর্তী জনপদ মাদায়েন। বর্তমানে পূর্ব জর্ডানের সামুদ্রিক বন্দর ‘মোআনের’ অদূরে অবস্থিত এটি।

সৌদি আরবের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর তাবুক থেকে ১৭০ কিলোমিটার দূরত্বে মরুর পাহাড় কেটে প্রাচীন মানুষ বানিয়েছিল মাদায়েন শহর। এ শহরের স্থাপনাসমূহকে দেশের বিশেষ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে মর্যাদা দিয়েছে সৌদি আরব।

হযরত শোয়াইবের (আ.) স্মৃতিবিজড়িত হাজার হাজার বছরের পুরনো এ শহর আজও প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রমাণ বহন করে চলছে। এখানের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হল পাথরে খোদাই করা প্রাচীন স্থাপনা ও গুহা থেকে বের হওয়ার পথসমূহ।

আল আরাবিয়া জানায়, সৌদি আরবের আল বাদি এলাকায় অবস্থিত ঐতিহাসিক এ স্থানকে মাদায়েনে শোয়াইব, মাদিয়ান ইত্যাদি বলা হয়। গ্রিক ঐতিহাসিক টলেমি এটাকে সবুজ মরুদ্যান নামে আখ্যায়িত করেছেন।

সৌদি ফটোগ্রাফার আব্দুল্লাহ আল ফারিস ঐতিহাসিক এসব স্থানসমূহের ছবি ধারণ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছাড়ার পর আকর্ষণীয় ও বিস্ময়কর এ দৃশ্যগুলো সারা বিশ্বের ভ্রমণপিপাসু মানুষের দৃষ্টি কেড়েছে।

আল ফারিস বলেন, হযরত শোয়াইবের (আ.) এই শহরের পোড়াকীর্তির সঙ্গে মিশে আছে হাজার বছরের ইতিহাস। মহাপ্লাবনের কবল থেকে বাঁচার জন্য সুউচ্চ স্থানে এসব স্থাপনা নির্মিত হয়েছিল।

মাদায়েন একটি বিস্তৃত উপত্যকা। মাদায়েনে যেসব প্রত্বতাত্ত্বিক নিদর্শন রয়েছে তা পৃথিবীর অন্য কোন ঐতিহাসিক নিদর্শনের চেয়ে কোন অংশে কম নয়।

ঐতিহাসিকরা বলেন, পাথুরে পাহাড় কেটে মাদায়েন শহর স্থাপন করা হয়েছে। আজকের ধ্বংসাবশেষ প্রমাণ করে এখানে ছিল মানুষের বসবাসের জন্য পর্যাপ্ত ঘর ও উপাসনালয়।

প্রাচীন নবতীয় সভ্যতার সঙ্গে এ শহরের যেমন মিল পাওয়া যায় তেমনি মাদায়েনে সালেহ বা হযরত সালেহের (আ.) শহরের সঙ্গেও রয়েছে এর পরিপূর্ণ মিল।

কোন কোন প্রত্নতাত্ত্বিক মনে করেন এটি খ্রিস্টপূর্ব দু’হাজার বছরেরও অধিক পুরনো শহর। মাদায়েন সম্প্রদায়ের বসবাস ছিল এখানে। তাওরাত গ্রন্থে মাদায়েন শহরের আলোচনা এসেছে অনেকবার।

কোরআন শরীফে উল্লেখ হয়েছে হযরত মুসা (আ.) ফেরাউনের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে মাদায়েন এসে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন।

সৌদি ঐতিহাসিক হামদ আল জাসির তার গ্রন্থাবলীতে মাদায়েনকে আল বাদিয় নামে অখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন, এটি প্রাচীন মরুদ্যান।

খ্যাতনামা ঐতিহাসিক আল ইয়াকুবি লিখেছেন- এটি একটি প্রাচীন শহর। ঘরবাড়ি, চাষাবাদের জমি, অগণিত সুপেয় পানির ঝর্ণা, মিঠা পানির পুকুরসহ সবই রয়েছে এখানে।

ব্রিটিশ পর্যটক রোপিল ১৮৫০ সালে শোয়াইবের (আ.) এই শহর ভ্রমণ করেন। রোপিলই প্রথম ব্রিটিশ পর্যটক যিনি এ বিষয়কে কলমের ভাষায় প্রকাশ করেছেন। তার লেখা পড়েই পশ্চিমা স্কলারগণ উৎসাহিত হন এবং এখানে ভ্রমণে আসেন।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, আল্লাহর গজবে ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাচীন জাতির মধ্যে একটি হল মাদায়েন সম্প্রদায়। এই শহরের অধিবাসীরা ওজনে কম দিত, রাহাজানি ও লুটপাট করত, অন্যায়ভাবে জনগণের মাল-সম্পদ ভক্ষণ করত।
আল্লাহ হযরত শোয়াইবকে (আ.) তাদের কাছে নবী হিসেবে প্রেরণ করেন।

আল্লাহ বলেন, ‘আর মাদায়েনবাসীর প্রতি তাদের ভাই শোয়াইবকে পাঠিয়েছিলাম। সে বলল, হে আমার সম্প্রদায়! আল্লাহর ইবাদত করো, তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোনো উপাস্য নেই। আর মাপে ও ওজনে কম দিও না, আজ আমি তোমাদের সমৃদ্ধিশালী অবস্থায় দেখছি; কিন্তু আমি তোমাদের ব্যাপারে সর্বগ্রাসী দিনের শাস্তির ভয় করছি।’ (সুরা : হুদ, আয়াত : ৮৪)

তারা শোয়াইবের (আ.) কথা অমান্য করলে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের প্রতি নেমে আসে কঠিন আজাব।

পবিত্র কোরআনে এই সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘আইকাবাসী রাসুলগণকে অস্বীকার করেছিল, যখন শোয়াইব তাদের বলল, তোমরা কী সাবধান হবে না। আমি তোমাদের জন্য একজন বিশ্বস্ত রাসূল।

সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর। আমি তোমাদের কাছে এজন্য কোনো প্রতিদান চাই না। আমার পুরস্কার তো জগৎসমূহের পরিচালক আল্লাহর কাছে আছে। মাপে পূর্ণমাত্রায় দেবে; যারা মাপে ঘাটতি করে তোমরা তাদের অন্তর্ভুক্ত হইও না এবং ওজন করবে সঠিক দাঁড়িপাল্লায়।

লোকদের তাদের প্রাপ্য বস্তু কম দেবে না, পৃথিবীতে বিপর্যয় ঘটাবে না। ভয় কর তাকে, যিনি তোমাদের এবং তোমাদের আগে যারা গত হয়েছে তাদের সৃষ্টি করেছেন। তারা বলল, তুমি তো জাদুগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত; তুমি আমাদের মতোই মানুষ। আমরা মনে করি, তুমি মিথ্যাবাদীদের অন্যতম।

তুমি যদি সত্যবাদী হও, তবে আকাশের একখণ্ড আমাদের ওপর ফেলে দাও। সে বলল, আমার প্রতিপালক ভালো জানেন তোমরা যা কর। অতঃপর তারা তাকে প্রত্যাখ্যান করল, পরে তাদের মেঘাচ্ছন্ন দিনের শাস্তি গ্রাস করল। এটা ছিল এক ভীষণ দিনের শাস্তি। (সুরা আশ-শুআরা, আয়াত : ১৭৬-১৮৯)

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসিরকারকরা লেখেন- তখন মাদায়েনে কয়েক দিন প্রচণ্ড গরম পড়ল। গরমে লোকজন ছটফট করতে লাগল। এরপর কাছাকাছি একটা ময়দানের ওপর গাঢ় মেঘমালা দেখা দিল। ময়দানে মেঘের ছায়া পড়ল। শীতল বাতাস বইতে লাগল।

এলাকার সবাই ওই ময়দানে উপস্থিত হল। বলতে লাগল, এই মেঘ থেকে আমাদের ওপর বৃষ্টি বর্ষিত হবে। কিন্তু তাদের ওপর অগ্নিবৃষ্টি শুরু হল। আর নিচের দিকে শুরু হল প্রচণ্ড ভূমিকম্প। ফলে তারা সবাই সেখানে ধ্বংস হয়ে গেল।

ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল পাহাড় কেটে তৈরি করা শোয়াইব (আ.) এর মাদায়েন শহরের ধ্বংসাবশেষ।

দৈনিক বগুড়া