শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশ-কাতার বাণিজ্য ছাড়ালো পৌনে তিনশ কোটি ডলার

বাংলাদেশ-কাতার বাণিজ্য ছাড়ালো পৌনে তিনশ কোটি ডলার

সংগৃহীত

বাংলাদেশ-কাতার দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য পৌনে তিনশ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি), সারের মতো পণ্যে ভর করে ২০২২ সালে কাতার থেকে আমদানি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭৪ কোটি ডলারে। অন্যদিকে দেশটিতে বিভিন্ন পণ্য ও সেবা রফতানি করে বাংলাদেশের ৯ কোটি ডলারের মতো আয় এসেছে। কাতারে ২০০০ সালে বাংলাদেশ থেকে রফতানি হয় প্রায় ২৪ লাখ ডলারের পণ্য, বিপরীতে আমদানি হয় ৪৫ লাখ ডলারের। 

দুই দেশের এ সম্পর্ককে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে দুদিনের রাষ্ট্রীয় সফরে ঢাকায় আসছেন কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি। বিশেষ একটি বিমানে নোমবার বিকেল ৫টায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তার অবতরণের কথা রয়েছে। রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তাকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানাবেন। 

জানুয়ারিতে নতুন সরকার গঠনের পর মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশ থেকে এটিই প্রথম উচ্চ পর্যায়ের রাষ্ট্রীয় সফর। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে এ সফরে আসছেন কাতারের আমির। তার এ সফরে দুই দেশের মধ্যে ১১ চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হবে। এর মধ্যে ছয়টি চুক্তি ও পাঁচটি সমঝোতা স্মারক।

বাংলাদেশে কাতারের বাণিজ্যিক সহযোগিতা বাড়ে মূলত ২০১৮ সালের পর থেকে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও আমদানি-রফতানির বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০০০ সালে কাতার থেকে ৪৫ লাখ ডলারের পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ। বিপরীতে রফতানি হয়েছে ২৩ লাখ ডলারের কিছু বেশি পণ্য। সেখান থেকে প্রায় আড়াই দশকে বাংলাদেশে কাতারের পণ্য রফতানি বেড়ে পৌনে তিনশ কোটি ডলারে পৌঁছেছে। ২০২২ সালে কাতার বাংলাদেশে মোট ২৭৩ কোটি ৯৩ লাখ ডলারের পণ্য রফতানি করে। এসব পণ্যের মধ্যে বড় অংকের অর্থই ব্যয় করতে হয়েছে এলএনজি, সার, প্লাস্টিক পণ্য, পেপার ও অর্গানিক রাসায়নিক পণ্যের পেছনে। 

কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দ্বিপক্ষীয় এ সহযোগিতা বেড়েছে বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা।  এরই ধারাবাহিকতায় কাতার থেকে বড় ধরনের জ্বালানি সহযোগিতা পাচ্ছে বাংলাদেশ। ২০২৩ সালকে বাংলাদেশ ও কাতারের মধ্যে সম্পর্কের টার্নিং পয়েন্ট বলে মনে করেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা। 

দেশটির আমিরের আমন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২৩ সালে কাতার সফর করেন। এ সফরে দেশটির সঙ্গে জ্বালানি সহযোগিতা, বিনিয়োগ, বাণিজ্যসহ নানা সহযোগিতার বিষয়ে আলোচনা হয়।  পাশাপাশি দুই দেশের পারস্পরিক সম্পর্ক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য বিভিন্ন খাতে যৌথভাবে কাজ করার সুযোগের কথাও তুলে ধরেন বাংলাদেশের সরকারপ্রধান। 

বাংলাদেশ-কাতার সম্পর্কের বিষয়টি নিয়ে নিয়মিত লেখালেখি ও বিশ্লেষণ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন। জানতে চাইলে তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, গালফ অঞ্চলে কাতারের সঙ্গে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি এখন অনেক উন্নত ও শক্তিশালী। দুই-তিন বছরে বাংলাদেশ সরকার বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে বলেই এ সম্পর্ক বেড়েছে। বাংলাদেশে জ্বালানি সংকটে কাতারের সহযোগিতা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। এর বাইরে সার, স্বাস্থ্য, প্রতিরক্ষা সহযোগিতাসহ নানা খাতে এ সহযোগিতা বেড়েছে। এটি কূটনৈতিক সম্পর্কের বড় অর্জন।

সম্পর্ককে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে আরো কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানো প্রয়োজন উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ অধ্যাপক আরো বলেন, একটা সময় এটি ওয়ান-ওয়ে ট্রাফিকের মতো ছিল, এখন সেটি টু-ওয়ে ট্রাফিকে পরিণত হয়েছে। কাতারে আমাদের দেশের জনশক্তি রফতানি হচ্ছে। দক্ষ জনশক্তি, বিভিন্ন অবকাঠামো খাতে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ সাম্প্রতিক সময়ে প্রশংসাও কুড়িয়েছে। এ সম্পর্ককে গুরুত্ব দিতে হবে। চীন, জাপান, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বড় উন্নয়ন সহযোগী। এর বাইরে কাতারসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা জোরালো হলে তা হবে বড় ধরনের অর্জন।

তেল-গ্যাসসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতার থেকে এলএনজি, সার, পেট্রোলিয়াম পণ্য আমদানি করে থাকে বাংলাদেশ। ২০১৭ সালে করা দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় বছরে ৪০ কার্গো এলএনজি আমদানি হয়। কাতারের রাশ লাফফান লিকুইফায়েড ন্যাচারাল গ্যাস কোম্পানি থেকে ১৫ বছর মেয়াদে এ গ্যাস পাবে পেট্রোবাংলা। এর মধ্যে ২০২২ সালে গ্যাসের দাম খোলাবাজারে কয়েক গুণ বেড়ে যায়। বাড়তি চাহিদা মেটাতে তাই হিমশিম খেতে হয় বাংলাদেশকে।

এদিকে গত বছরের মার্চে কাতারের রাজধানী দোহায় স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জাতিসংঘ সম্মেলনের ফাঁকে দেশটির আমিরের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় বাংলাদেশে এলএনজি সরবরাহ বাড়ানোর জন্য কাতারের আমিরকে আহ্বান জানান তিনি। এ ধারাবাহিকতায় গত জুনে আরো একটি চুক্তি সই হয় দুদেশের মধ্যে, যার মাধ্যমে ২০২৬ সাল থেকে বছরে আরো দেড় মিলিয়ন টন এলএনজি পাবে পেট্রোবাংলা।

জ্বালানি খাতের পাশাপাশি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অংশ হিসেবে গত বছর বড় ধরনের সহায়তা পায় বাংলাদেশ। এর মধ্যে ১ হাজার ১২৯ সেনাসদস্যের জন্য কাতারে কাজ করার সুযোগ তৈরি হয়। এ-সংক্রান্ত একটি চুক্তি সই হয় গত বছরের ৭ মার্চ। সেই সঙ্গে ৬ লাখ ৬০ হাজার প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষার্থীর জন্য ২ দশমিক ২৭ মিলিয়ন ডলারের সহায়তা দেয় কাতার। এছাড়া দেশটির বিভিন্ন সেক্টরে কাজের ক্ষেত্রে কর্মীদের নিরাপত্তাসহ নানা খাতে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়িয়েছে বাংলাদেশ।

এদিকে কাতারের আমিরের বাংলাদেশ সফর উপলক্ষে গতকাল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সেখানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ জানান, কাতারের আমিরের এ সফরে দুই দেশের মধ্যে ১১ চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হবে। এর মধ্যে দ্বৈতকর পরিহার, আইনগত বিষয়ে সহযোগিতা, সাগরপথে পরিবহন, বিনিয়োগ উন্নয়ন ও সুরক্ষা, দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের বদলি ও যৌথ ব্যবসা পরিষদ গঠনসংক্রান্ত চুক্তি রয়েছে। 

এছাড়া শ্রমশক্তি, বন্দর পরিচালনা, উচ্চ শিক্ষা ও বৈজ্ঞানিক গবেষণা, যুব ও ক্রীড়া সহযোগিতা এবং কূটনৈতিক প্রশিক্ষণ সহযোগিতাবিষয়ক সমঝোতা স্মারক রয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আওতাধীন কালশীর বালুর মাঠে নির্মিত পার্ক এবং মিরপুর ইসিবি চত্বর থেকে মিরপুর উড়াল সড়ক পর্যন্ত সড়কটি আমিরের নামে নামকরণ করা হবে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাতারের আমিরের সফরটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এতে জ্বালানি বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে বহুমুখী আলোচনা হবে। কাতার থেকে আমরা জ্বালানি কিনি। ফলে সেখানে ডেফার্ড পেমেন্টের (কেনার নির্দিষ্ট সময় পর টাকা পরিশোধ প্রক্রিয়া) বিষয় আসতে পারে। এছাড়া বিপুল অংকের সার্বভৌম তহবিল রয়েছে। কাতার ও বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনাময় বিনিয়োগের উৎস হতে পারে ঐ তহবিল। বাংলাদেশ ও কাতারের মধ্যে বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর, বন্ধুত্বপূর্ণ ও বহুমুখী। কাতার বঙ্গবন্ধুর সরকারকালীন (১৯৭৪ সালে) বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানকারী অন্যতম মুসলিম রাষ্ট্র।’

কাতারের আমিরের সফরসূচির বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, রাষ্ট্রপতির স্বাগত জানানোর পর কাতারের আমিরকে গার্ড অব অনার দেওয়া হবে। সফরসঙ্গীদের নিয়ে তিনি লা মেরিডিয়ান হোটেলে থাকবেন। ২৩ এপ্রিল সকালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ কাতারের আমিরের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। তারপর গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কাতারের আমিরের সঙ্গে প্রথমে একান্ত বৈঠক এবং পরে আনুষ্ঠানিক দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন। ওইদিন কাতারের আমির রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বঙ্গভবনে সৌজন্য সাক্ষাৎ ও রাষ্ট্রীয় মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেবেন। সন্ধ্যায় বিশেষ উড়োজাহাজে তিনি ঢাকা ত্যাগ করবেন।

কাতারের আমিরের সফরে বাংলাদেশে ইকোনমিক জোন করে দেয়ার প্রস্তাব রাখা হবে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। তিনি বলেন, আমাদের সিরামিক আছে, গার্মেন্ট প্রডাক্ট আছে, আরো অনেক রফতানি পণ্য আছে, এগুলো রফতানির জন্য বলব। এছাড়া আমাদের ওষুধ আছে। এটা রফতানি হয়, ভলিউমটা বাড়ানোর জন্য বলব। বাংলাদেশে যাতে তাদের বিনিয়োগ হয়, বিশেষ করে অর্থনৈতিক অঞ্চলে যাতে তাদের বিনিয়োগ হয় সেটাও আলোচনা করব। তারা চাইলে আমাদের ব্যাংক খাতে বিনিয়োগ করতে পারে, জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ করতে পারে। আমরা বিনিয়োগ চাইব। কাতার নানা ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে পারে, অর্থনৈতিক খাতে বিনিয়োগ করতে পারে।

হাছান মাহমুদ জানান, পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাসসমৃদ্ধ সর্বোচ্চ গড় মাথাপিছু আয়ের দেশ কাতার। শক্তিশালী অর্থনীতি, ভূরাজনৈতিক অবস্থান, কূটনৈতিক তৎপরতা ও মধ্যস্থতার কারণে মধ্যপ্রাচ্যে একটি প্রভাবশালী দেশ হিসেবে বিবেচিত। কাতার মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের অন্যতম শ্রমবাজার, যেখানে প্রায় চার লাখ বাংলাদেশী কর্মরত।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমি বলতে চাই, কাতারের আমিরের এ সফর বাংলাদেশ ও কাতারের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হিসেবে পরিগণিত হবে।

সূত্র: ডেইলি বাংলাদেশ

সর্বশেষ: