শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১

বগুড়ায় বোরোর বাম্পার ফলন, কৃষকের স্বপ্ন পূরণের হাতছানি

বগুড়ায় বোরোর বাম্পার ফলন, কৃষকের স্বপ্ন পূরণের হাতছানি

বগুড়ায় দিগন্ত জোড়া সবুজ ফসলের মাঠ এখন সোনালী রঙে পরিণত হয়েছে। সবুজ পাতা আচ্ছাদিত সোনালী শীষগুলো রৌদ্রে জ্বল-জ্বল করছে। এসব দৃশ্য দেখে কৃষকের চোখে-মুখের সোনালী স্বপ্নগুলো প্রস্ফুটিত হয়ে উঠছে। ফসলের বাম্পার ফলনের স্বপ্ন ঘরে তুলতে তাইতো মুখে হাসির ঝিলিক নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছে চাষিরা।

ধান চাষ ও পরিচর্যার পর ধান কাটার অনাবিল আনন্দ কৃষকের ঘরে ঘরে। কৃষান-কৃষাণি মিলে মাঠে মাঠে ধান কাটার কাজ করে যাচ্ছে। তবে চলতি বছর বোরোর বাম্পার ফলনের মাধ্যমে প্রায় সাড়ে ৭ লাখ মেট্রিক টন চাল আকারে ফলন পাওয়া যাবে বলে কৃষি কর্মকর্তারা অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

জানা যায়, বগুড়ার ১২টি উপজেলায় বোরো ধান কাটা মাড়াই শুরু হয়েছে চলতি সপ্তাহেই। অনুকূল আবহাওয়ায় ইতোমধ্যে ধান মাড়াই শুরু হয়েছে। ধান মাড়াইয়ে পর খড় ভালোভাবে শুকিয়ে বাড়িতে তুলতে পারছেন তারা। তবে আগামী দুই/তিন সপ্তাহের মধ্যে সব বোরো ধান কাটা ও মাড়াই শেষ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে দাবী করেছে কৃষি বিভাগ।

সরেজমিনে জেলার বিভিন্ন উপজেলার বোরো ধানের মাঠ ঘুরে দেখা যায়- প্রায় বোরো জমির ধান পেঁকে সোনার বর্ণ ধারণ করে শীষগুলো বাতাসে দুলছে জমিতে। পাকা ধান কাটায় ব্যস্ত কৃষক-শ্রমিক। শ্রমিকের পাশাপাশি ধান কাটায় ব্যবহার হচ্ছে আধুনিক যন্ত্র কম্বাইন্ড হারভেস্টার মেশিন ও রিপার মেশিন।

কৃষকরা বলছেন, নানা প্রতিকূলতার পরও ধানের ফলন ভালো হয়েছে। তবে চলতি বোরো মৌসুমের শুরু থেকেই বৈরী আবহাওয়ার ধকল, তারপর দফায় দফায় কৃষি উপকরণের দাম বৃদ্ধি হওয়ায় বেশ বেগ পেতে হয়েছে কৃষককে।

চাষিরা বলছেন, গত মৌসুমের চেয়ে এবার চাষাবাদে বিঘাপ্রতি আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা বেশি খরচ হয়েছে। কৃষি উপকরণের বাড়তি দর আর বৈরী আবহাওয়ার ধকল থাকলেও শেষ মুহূর্তে কাঙ্খিত ফলন হওয়ায় আশার আলো দেখছেন কৃষকেরা। তবে নতুন ধান হাটে তোলার পর ন্যায্য মূল্য পাবেন কি না, তা নিয়ে কৃষকদের মনে সংশয় রয়েছে।

কৃষি বিভাগ বলছে- প্রতিকূল আবহাওয়া, সহায়ক ধানের জাত নির্বাচন আর কৃষকদের আধুনিক কলাকৌশল প্রদান করায় এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি ফলন হবে। জেলায় চলতি মৌসুমে অন্তত ১২ থেকে ১৩ জাতের ধানের আবাদ করা হয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাষ করা হয়েছে উচ্চ ফলনশীল কাটারিভোগ, নাজিরশাইল, জিরাশাইল ও ব্রি৪৯, ব্রি২৮, ব্রি২৯, শুভলতা ও কাজললতা জাত।

বগুড়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে জেলায় ১ লাখ ৮৭ হাজার ৬৫০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ লাখ ৩৫ হাজার ৫৩ মেট্রিক টন। গত বছরে বোরা চাষ হয় ১ লাখ ৮৮ হাজার ৫১০ হেক্টর জমিতে। বগুড়ায় এ পর্যন্ত ধান কাটার উপযোগী হয়েছে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ। যার পরিমান ৩ হাজার ৭০০ হেক্টর। এখন পর্যন্ত ৫৭০ হেক্টর জমির ধান কাটা হয়েছে।

আগামী ২ সপ্তাহের মধ্যে অধিকাংশ জমির ধান কাটার উপযোগী হবে এমনটাই আশা করছেন জেলার কৃষি কর্মকতারা। গতবারের চেয়ে এ বছর ফলন ভালো হয়েছে। এবার ধান কাটা শ্রমিক সংকট হবে না। জেলার বিভিন্ন উপজেলায় কম্বাইন্ড হারভেস্টার ও রিপার মেশিন দিয়ে ধান কাটা ও মাড়াই করছেন কৃষকরা। তবে কৃষকরা যাতে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেজন্য সরকার চলতি মৌসুমে ধান-চাল সংগ্রহ করতে এবার ধানের মূল্য ৩০টাকা কেজি ও চালের মুল্য ৪৪ টাকা কেজি নির্ধারণ করেছে।

শেরপুর উপজেলার ভবানীপুর ইউনিয়নের ধান চাষী আব্দুল জলিল জানান, ১২ বিঘা জমিতে কাজললতা জাতের বোরো ধান চাষ করেছেন। কাটা মাড়াই শুরু করেছেন, ৩ বিঘা কাটা মাড়াই সম্পূর্ণ হয়েছে প্রতি বিঘায় গড়ে ২৪ মণ করে ফলন পেয়েছেন।

কুসুম্বী ইউনিয়নের আমইন গ্রামের কৃষক আবু বকর, শাহাদৎ, নজরুল ইসলামসহ একাধিকরা বলেন, এবার পোকা মাকড় বেশি দেখা দিলেও কীটনাশক প্রয়োগ করার পর তা সেরে গেছে। তবে আমরা বিভিন্ন জাতের ধানের আবাদ করেছি। এবার বিঘা প্রতি ২০ থেকে ২৫ মন ধান হয়েছে। ১ বিঘা জমিতে বোরো ধানের আবাদে মোট খরচ পড়ে ১৪ থেকে ১৫ হাজার টাকা। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ধান ও খড় ভালো ভাবে শুকিয়ে বাড়িতে তুলতে পারছি। তবে গত মৌসুমের চেয়ে এবার চাষাবাদে বিঘাপ্রতি আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা বেশি খরচ হয়েছে। শ্রমিক মুজরীসহ সবকিছুর দাম চড়া। তবে খরচ বাদ দিয়ে ৩ হাজার টাকা জমিতে থাকবে।

বিশালপুর ইউনিয়নের তেতুলিয়া গ্রামের চাষী রাশেদুল ইসলাম জানান, তিনি ১৭ বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছেন। কৃষিকাজে ব্যবহৃত উপকরণের মূল্য বৃদ্ধি হয়েছে, তাছাড়া এবার শ্রমিক মজুরীও বেশি। ১ বিঘা জমির ধান কাটতে প্রায় ৬ জন শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। এতে প্রতি বিঘা জমির ধান ঘরে তুলতে শ্রমিক মজুরী দিতে হয় ৫ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে আগের বছরের চেয়ে লাভের অংশ কমে গেছে। সারের দাম বেড়েছে। বাজারে ধানের ন্যায্য মূল্য পেলে পুষিয়ে যাবে। বহিরাগত শ্রমিকরা না আসায় এলাকার শ্রমিক দিয়ে বাড়তি মুল্যে ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজ করছেন।

জেলার শেরপুর উপজেলার বিভিন্ন ধানের হাট ঘুরে দেখা গেছে, হাটে বিআর-২৮ ৯০০ থেকে ৯৩০ টাকা, মিনিকেট ১১’শ থেকে ১১৫০ টাকা এবং স্থানীয় কাটারীভোগ ১০২০ থেকে ১১৭০ টাকা, আতপ ৯০ (সুগন্ধী) ধান ১৯২০ টাকা মণ দরে নতুন ধান বিক্রি হচ্ছে।

শেরপুর উপজেলা কৃষি অফিসার ফারজানা আক্তার বলেন, শেরপুর উপজেলায় চলতি মৌসুমে ২০ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২ হাজার হেক্টও জমির ধান কাটা হয়েছে। মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে পুরোদমে ধান কাটা মাড়াই শুরু হয়েছে। চলতি মৌসুমে বোরো ধানের আশানুরুপ ফলন হয়েছে।

বগুড়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মতলুবর রহমান জানান, বগুড়ায় বিগত দিনের মত চলতি মৌসুমেও ভালো ফলন পাওয়া যাচ্ছে। যে পরিমাণ ধান কাটা হয়েছে তা দেখে ধারণা করা হচ্ছে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যেতে পারে। আবহাওয়া অনুকূলে এবং বগুড়ার মাটি বোরো ধানের আদর্শ থাকায় ভালো ফলন পাওয়া গেছে। জেলার বেশ কিছু হাটে নতুন ধান বেচাকেনাও শুরু হয়েছে।

দৈনিক বগুড়া

সর্বশেষ: