শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

এমন কিছু তো হওয়ারই কথা!

এমন কিছু তো হওয়ারই কথা!

‘মানুষটার প্রতি অন্যায় হচ্ছে’, ‘নো-বল কাণ্ডে’র পর থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখ বুলিয়ে তামিম ইকবালের সমবেদনা জনতার রোষানলে পতিত তানভীর আহমেদের প্রতি। দীর্ঘদিন ঘরোয়া ক্রিকেটে এ আম্পায়ারের পরিচালনায় ম্যাচ খেলে আসছেন। একবার তানভীরের সঙ্গে বচসায় জড়িয়ে নিষেধাজ্ঞার কবলেও পড়েছিলেন তামিম। তবু তিনি বিশ্বাস করেন, ‘তিনি ভালো মানুষ। কখনোই মনে হয়নি অন্যায়ভাবে কোনো দলের পক্ষে সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন। ভুল করলেও সেগুলো ছিল অনিচ্ছাকৃত। মানুষ মাত্রই তো ভুল করে।’

২০১৬ সালের সে শাস্তির সময় তামিম ইকবাল ছিলেন আবাহনীর অধিনায়ক। ঢাকা ডায়নামাইটসের অধিনায়ক সাকিব আল হাসানও তানভীরের সঙ্গে অসদাচরণ করে বিপিএলে এক ম্যাচের জন্য নিষিদ্ধ হয়েছিলেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে চলমান সিরিজে সাকিবের ১৫ শতাংশ ম্যাচ ফি জরিমানা ও একটি ডিমেরিট পয়েন্ট যুক্ত হওয়ার প্রেক্ষাপট তৈরি করা প্রতিবেদনে স্বাক্ষর ছিল তানভীরের। কে না জানে যে, বাংলাদেশ ক্রিকেটের এ দুই তারকার বিপক্ষে প্রতিবেদন দিতে সাহস লাগে। তাতে তানভীর বিশেষ কোনো দলকে অন্যায় সুবিধা দেন না—তামিমের এ মূল্যায়নে কিছু আস্থা অন্তত রাখা যায়।

তবে ভুল তিনি করেন, শনিবারে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজের শেষ টি-টোয়েন্টিতে যা করেছেন, তা মহা ভুল। একই ওভারে ওশানে থমাসের বিরুদ্ধে তানভীরের ডাকা দুটি নো বলের সিদ্ধান্তই ছিল ভুল। ক্যারিবীয়দের চাপাচাপিতে রিভিউর সাহায্য নিয়েছেন তিনি। এরপর নো বল বাতিল করে লিটন কুমার দাশকে আউট ঘোষণার হাস্যকর সিদ্ধান্তও নিয়েছেন তানভীর। যদিও ক্রিকেট আইনে নো-বল ডেকে সেটির যথার্থতা প্রমাণের জন্য টিভি আম্পায়ারের সাহায্য নেওয়ার কোনো বিধান নেই। আর নো বল বাতিলের তো প্রশ্নই আসে না। তবু তানভীর সিদ্ধান্ত পাল্টেছিলেন, মিনিট আটেকের নাটকের পর যা শুধরে দিয়েছেন ম্যাচ রেফারি। তবে কি ক্রিকেট আইনের বইটা ঠিকঠাক পড়া নেই তানভীরের? তামিমের ধারণা, ‘আসলে উনার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার কেবলই শুরু হয়েছে। আমার মনে হয় প্রথম ম্যাচে ভুল একটা সিদ্ধান্ত (এলবিডাব্লিউ) দেওয়ার পর থেকে প্রবল চাপে ছিলেন তিনি। এরপর ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানরা চাপ দেওয়ায় তা আর নিতে পারেননি।’

চাপ নিতে না পারার অতীতও রয়েছে তানভীরের। ২০১৬ সালের ওই ম্যাচে তামিমের ‘বকাবকি’র জেরে অসুস্থ বোধ করায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন এ আম্পায়ার। ঘরোয়া ক্রিকেটের চাপই যিনি নিতে পারেন না, তাঁর জন্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের পরিবেশ তো অস্বস্তিকর হবেই!

অবশ্য তানভীরের একার ভুলেই কি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এমন হাসির খোরাক জুগিয়েছে বাংলাদেশের ক্রিকেট? মাঠের সহযোগী আম্পায়ার মাসুদুর রহমান মুকুলের সঙ্গে পরামর্শ করেই টিভি আম্পায়ারের কাছে ‘রিভিউ’ চেয়েছিলেন তানভীর। নো বলের সিদ্ধান্ত পাল্টানোর সুযোগ যে নেই, সে আইনটির কথা বলে কি তানভীরকে রিভিউ চাওয়া থেকে নিবৃত্ত করতে পারতেন না স্কয়ার লেগ আম্পায়ার? রিভিউ যাঁর কাছে চাওয়া হয়েছে, সেই টিভি আম্পায়ার গাজী সোহেলও তো আইনি ব্যাখ্যা দিতে পারতেন তানভীরকে। মাঠের ওই কয়েক মিনিটের নাটকীয়তার পূর্ণাঙ্গ স্ক্রিপ্ট জানা যায়নি। তবে সাদা চোখে দেখা গেছে, নো বল ডাকা নিয়ে ক্যারিবীয় অধিনায়ক কার্লোস ব্রাথওয়েট প্রতিবাদ জানাচ্ছেন আম্পায়ারের কাছে। সেই চাপে ভেঙে পড়ে রিভিউ চেয়ে নো বল বাতিল করে লিটনকে আউট ঘোষণা করেন তানভীর। তাতে একযোগে ম্যাচ পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তিন আম্পায়ারের চাপ নিতে পারার সামর্থ্য প্রশ্নবিদ্ধ।

অবশ্য দীর্ঘদিন ধরেই প্রশ্নবিদ্ধ এ দেশের আম্পায়ারিং মান। বিসিবির অধীন আম্পায়ার পুলে তিন ক্যাটাগরির আম্পায়ার আছেন। একদল আছেন, যাঁদের ম্যাচ পরিচালনার যোগ্যতাই নেই। তবু বিসিবির আম্পায়ার্স পুলে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন তাঁরা নির্বিচারে কর্তাব্যক্তিদের নির্দেশ মেনে ম্যাচ পরিচালনা করে। একদল আছেন যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও রুটি-রুজি নিশ্চিত করতে অযোগ্যদের দলে ভিড়ে গেছেন। আরেকটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী আছেন, যাঁরা আত্মসন্মান বাঁচাতে বিশেষ বিশেষ ম্যাচ পরিচালনা থেকে গা বাঁচিয়ে চলেন। এমন পরিবেশে তানভীর কেন, ভুলের ফাঁদে জড়িয়ে পড়তে পারেন যেকোনো আম্পায়ারই। ভালো এবং আত্মবিশ্বাসী আম্পায়ার হওয়ার পথই যে রুদ্ধ করে রেখেছেন কর্তাব্যক্তিরা!

অবশ্য স্থানীয় আম্পায়ারদের ওপর চাপের আরো উৎস রয়েছে। ক্ষমতাধর ক্লাবের কথা তো শুরুতেই বলা হয়েছে। এর বাইরে ক্ষমতাধর বোর্ড পরিচালকের ক্লাবের পক্ষেও ‘ঝোল টানতে’ হয় আম্পায়ারদের। বড় ক্লাব, ক্ষমতাবান কর্মকর্তার সঙ্গে তারকা ক্রিকেটারদের মেজাজ মর্জিও সামলে চলতে হয় স্থানীয় আম্পায়ারদের। এই ত্রিমুখী চাপ সয়ে বছরে একজন আম্পায়ার খুব বেশি সুযোগ পান না নিজের সামর্থ্যের ওপর আস্থা থেকে ম্যাচ পরিচালনার। নিজের ওপর আস্থাহীনতা থেকেই ভুল শোধরাতে গিয়ে মহা ভুল করেন স্থানীয় আম্পায়াররা, বিকশিত হয় না তাঁদের সামর্থ্য।

ঘরোয়া ক্রিকেটে অলিগলি পেরিয়ে ভুলের সে রোগ ছড়িয়েছে অনেক দূর। অবধারিতভাবে যা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকেও ছুঁয়ে দিল ২০১৮ সালের ২২ ডিসেম্বর। তানভীরের জায়গায় অন্য কেউও হতে পারতেন ‘মধ্যমণি’!

দৈনিক বগুড়া