শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

যে অবাক করা বোলিংয়ের কথা কখনো ভুলবেন না আফতাব

যে অবাক করা বোলিংয়ের কথা কখনো ভুলবেন না আফতাব

ইতিহাস জানাচ্ছে- তিন পেসার মাশরাফি বিন মর্তুজা, রুবেল হোসেন আর মোস্তাফিজুর রহমানের ওয়ানডেতে এক ম্যাচে ৬ উইকেট করে আছে। এছাড়া বাঁহাতি স্পিনার মোহাম্মদ রফিক, আব্দুর রাজ্জাক, সাকিব আল হাসান, পেসার তাসকিন আহমেদ, জিয়াউর রহমান ও ফরহাদ রেজারও এক ম্যাচে ৫ উইকেট শিকারের কৃতিত্ব আছে।

কিন্তু অবাক করা সত্য হলো, ওপরে যাদের নাম বলা হলো তারা কিংবা তাদের পূর্বসুরী- জিএম নওশের প্রিন্স, হাসিবুল হোসেন শান্ত, মঞ্জুরুল ইসলাম, তাপস বৈশ্য-এরা কেউই দেশের হয়ে প্রথম ৫ উইকেট শিকারি নন।

একদিনের ক্রিকেটে বাংলাদেশের হয়ে প্রথম ৫ উইকেট দখলের কৃতিত্বটি এমন একজনের যিনি মূলত ব্যাটসম্যান। আর মাঝে মধ্যে মানে অনিয়মিত বোলিং করতেন। ক্রিকেটীয় পরিভাষায় যাকে বলে ‘অকেশনাল বা পার্টটাইম বোলার’।

ওয়ানডেতে দেশের প্রথম ৫ উইকেট শিকারি সেই ক্রিকেটার আর পার্টটাইম বোলার হলেন আফতাব আহমেদ। জাতীয় দলের জার্সি গায়ে ৮৫ ম্যাচ খেলা চট্টগ্রামের এ তুখোড় উইলোবাজ ১৬ বছর আগে ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৩১ রানে ৫ উইকেটের পতন ঘটিয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছিলেন।

দিনটি ছিল ২০০৪ সালের ৫ নভেম্বর। ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে দিবারাত্রির ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে আফতাব আহমেদ ঐ জাদুকরী বোলিং নৈপুণ্য দেখিয়েছিলেন। তার দুর্দান্ত বোলিংয়েই একদম নিষ্প্রাণ, নির্জিব ও একপেশে ম্যাচটি হয়ে উঠেছিল আকর্ষণীয়, উপভোগ্য আর জমজমাট প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ঠাসা।

আফতাব কোন সময়ই নিয়মিত বোলার হিসেবে পরিচিত ছিলেন না। ৮৫ ওয়ানডেতে তার উইকেট মোটে ১২ টি। যার মধ্যে ঐ এক খেলায়ই ৫টি।

ম্যাচে বাংলাদেশের পুঁজি ছিল মাত্র ১৪৬ রানের। ১৪৭ তাড়া করতে গিয়ে নিউজিল্যান্ড প্রথম উইকেটেই তুলে ফেলেছিল ৭২ রান (১৯.৫ ওভারে)। কে জানতো, ঐ ম্যাচেই অপেক্ষা করছে বড়সড় চমক । নিশ্চিত পরাজয় দেখে বাংলাদেশের অর্ধেক সমর্থক মাঠ ছেড়ে বাড়ির পথে পা বাড়িয়েছিলেন।

কিন্তু অকেশনাল স্লো মিডিয়াম আফতাব বোলিংয়ে এসে এক দুই ওভারের মধ্যেই ব্রেক থ্রু আনেন। ফিরিয়ে দেন অ্যাসলেকে। তারপর ভোজবাজির মত বদলে যায় প্রেক্ষাপট।

স্কট স্টাইরিসের উইকেট উপড়ে দিয়ে আফতাব হঠাৎই কিউই ব্যাটসম্যানদের পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ান। ১ উইকেটে ৭২ থেকে ১২৫ রানে ৬ উইকেট খুইয়ে বসে নিউজিল্যান্ড। ঐ ৬ উইকেটের ৫ টিই নেন আফতাব। পরে অবশ্য ক্রিস কেয়ার্নস এসে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন। শেষ পর্যন্ত ব্ল্যাকক্যাপসরা পায় ৩ উইকেটের স্বস্তির জয়।

কিন্তু বাংলাদেশও খালি হাতে মাঠ ছাড়েনি। সেই ১৯৮৬ সালে ওয়ানডে শুরুর ১৮ বছর পর কোনো বোলারের প্রথম ৫ উইকেট শিকারের কৃতিত্ব হয় অর্জিত।

বোলার না হয়েও বোলিং রেকর্ডের অধিকারী বনে যান আফতাব। তাতে দেশের ক্রিকেট ইতিহাসে তার নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখা হয়ে গেছে। তার পরে আরও অনেকেই ৫ উইকেট পেয়েছেন। সেরা বোলিংয়ের তালিকায় আফতাবের ঐ স্পেলটা ৯ নম্বরে।

কিন্তু প্রথম ৫ উইকেট শিকারি বাংলাদেশি বোলার হিসেবে আফতাব আছেন অন্য উচ্চতায়। কেমন ছিল সেই ম্যাচের স্মৃতি? আফতাব কি তা মনে রেখেছেন? তার স্মৃতিতে কতটা ভাস্বর সে দিনের ম্যাচটি?

আজ বৃহস্পতিবার সকালে সাথে একান্ত আলাপে সেই ম্যাচের স্মৃতির ঝাপি খুলে দিয়েছেন আফতাব। তিনি বলেন, ‘এখনো মনে আছে অধিনায়ক সুমন ভাই (হাবিবুল বাশার) যখন আমার হাতে বল তুলে দেন, তখন আমরা প্রায় হারের পথে। আমাদের ছোট্ট পুঁজি তাড়া করে কিউইরা প্রথম উইকেটেই মনে হয় প্রায় অর্ধেক পথ পাড়ি দিয়ে ফেলেছিল। তারপর আমার হাতে বল দেয়া হলো। আমার তো তখন আর কিছু করার ছিল না। চেষ্টা ছিল ভাল জায়গায় বল ফেলে রান গতি কমিয়ে রাখা ‘

আফতাব যোগ করেন, ‘ভাল জায়গায় বল ফেলতে পারলে যদি ওরা ভুল করে, তাহলে হয়তো উইকেট পাবো- এমন চিন্তায় শুরু। কিন্তু বিশ্বাস করুন আল্লাহই জানেন, সেদিন আমার বলে কি জাদু ছিল! আল্লাহই হয়তো আমার বলে কিছু একটা দিয়ে দিয়েছিলেন। আর তাই নিউজিল্যান্ড ব্যাটসম্যানরা খেলতেই পারছিল না । এমন নয় উইকেট খারাপ ছিল। পিচ ছিল একদম ফ্ল্যাট। নির্ভেজাল ব্যাটিং ট্র্যাক।’

১৬ বছর আগের স্মৃতিটা এখনও একদম তরতাজা আফতাবের মনে। বলছিলেন, ‘আমি শুধু জায়গায় বল করার চেষ্টা করেছি। একটু আধটু ম্যুভমেন্টও পাচ্ছিলাম। যেখানে ওদের ১০ উইকেটে জেতা কথা, সেখানে আমার বলে দেখি একের পর এক নিউজিল্যান্ড ব্যাটসম্যান আসছেন আর যাচ্ছেন। প্রথমে অ্যাসলেকে আউট করলাম। তারপর স্টাইরিশের বোল্ড হবার দৃশ্যটা এখনো চোখে ভাসে। বল পড়ে অল্প একটু কাট করলো আর তাতেই স্টাইরিসের মত ব্যাটসম্যান হলেন বোল্ড। তারপর একে একে হামিশ মার্শাল, ক্রেইগ ম্যাকমিলান আর ব্রেন্ডম ম্যাককালামের মত নামি ব্যাটসম্যানরাও গেলেন ফিরে।’

আফতাব বলেন, ‘আমরা ‘ফ্রম নো হোয়ার’ ম্যাচে ফিরলাম। জয়ের সম্ভাবনাও তৈরি হলো। তাদের ক্রিস কেয়ার্নস এসে ভাল পার্টনারশিপ তৈরি করে ম্যাচের নিয়ন্ত্রন নিয়ে নেয়। না হয় ঐ অল্প পুঁজি নিয়ে আমাদের জিতেও যেতে পারতাম। বোলার না হয়েও বোলারের রেকর্ড গড়ে ফেললাম আমি। ভাবলে ভালোই লাগে। অবাক হই! সৃষ্টিকর্তার অনেক দয়ায় হয়তো ওমন বোলিং কৃতিত্ব দেখাতে পেরেছিলাম।’

দৈনিক বগুড়া