রোববার, ১৭ আগস্ট ২০২৫, ১ ভাদ্র ১৪৩২

সনাতন

জন্মাষ্টমী: মানবমুক্তির এক ঐশ্বরিক আবির্ভাব

জন্মাষ্টমী: মানবমুক্তির এক ঐশ্বরিক আবির্ভাব

সংগৃহীত

সেই পুরাকাল থেকেই প্রেমের অবিসংবাদিত নায়ক হিসেবে শ্রীকৃষ্ণের আকর্ষণকে এখন পর্যন্ত কোনো চরিত্রই টপকে যেতে পারেনি। আজও প্রেমের প্রতীক হিসেবে তাঁর পাশে নায়িকারূপে রাধার স্থান অম্লান হয়ে আছে। কৃষ্ণকে নিয়ে পুরাণসহ বিভিন্ন প্রাচীন পুঁথিতে নানা ধরনের কিংবদন্তি বা কাহিনি লিপিবদ্ধ রয়েছে। তবে প্রাচীনতম গ্রন্থ বেদের কোনো ভাগেই কৃষ্ণের সম্পর্কে কোনো কিছুই লেখা নেই।

ঐতিহাসিকদের দীর্ঘ গবেষণা থেকে জানা গেছে, কৃষ্ণকে নিয়ে প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় খ্রিষ্টপূর্ব সাতের শতকে ছান্দোগ‍্য উপনিষদ-এ। প্রেমের প্রতীক এই মহানায়কের জন্মবৃত্তান্তের প্রথম উল্লেখ আছে তৃতীয় শতকে রচিত বিষ্ণুপুরাণ-এ। তারপর এক শতক পর হরিবংশ-এ। এই গ্রন্থগুলোতে বালক কৃষ্ণের বা গোপালের (কৃষ্ণের অপর নাম) নানা লীলার উল্লেখ রয়েছে।

যিশু জন্মান ঘোড়ার জীর্ণ আস্তাবলে, পাশাপাশি কৃষ্ণের জন্মও বদ্ধ কারাগারের অন্ধকার কুঠরিতে। ছোটবেলায় দুজনের এতই মিল ছিল যে উভয়েই বেড়ে উঠছিলেন পশুপালকদের মধ‍্যে।

আধুনিক যুগে কৃষ্ণকে নিয়ে বিস্তারিত লেখা লিপিবদ্ধ করেছেন আলব্রেখট হেবার। ১৮৭৪ সালে তাঁর লেখা অ‍্যান ইনভেস্টিগেশন ইনটু দ‍্য অরিজিন অব কৃষ্ণ জন্মাষ্টমীতে কৃষ্ণ সম্পর্কে অনেক তথ‍্য প্রকাশ করা হয়। এই বইতেই তাঁকে যিশুর মতোই ঈশ্বরপ্রেরিত অবতাররূপে বর্ণনা করা হয়েছে। যিশু যেমন পৃথিবীর পরিত্রাণের জন্য আবির্ভূত হয়েছিলেন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে, কৃষ্ণের আবির্ভাবেও সেই একই প্রাকৃতিক প্রতিকূল পরিবেশ। যিশু জন্মান ঘোড়ার জীর্ণ আস্তাবলে, পাশাপাশি কৃষ্ণের জন্মও বদ্ধ কারাগারের অন্ধকার কুঠরিতে। ছোটবেলায় দুজনের এতই মিল ছিল যে উভয়েই বেড়ে উঠছিলেন পশুপালকদের মধ‍্যে।

কৃষ্ণের জন্ম হয়েছিল ভাদ্র মাসের অষ্টমী তিথিতে, মথুরায় নিজের মাতুল কংসের কারাগারে। কিন্তু কেন কারাগারে তাঁর জন্ম হয়েছিল, তা নিয়ে নানা কাহিনি রচিত হয়েছে। যেমন তখন ছিল দ্বাপর যুগ। সেই যুগের প্রবল প্রতাপশালী রাজা কংসের নানা অত‍্যাচারে মথুরার অধিবাসীরা অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল। কংসের নিত‍্যদিনের এই অত‍্যাচার সহ‍্য করতে না পেরে তারা কংসের হাত থেকে নিষ্কৃতি লাভের আশায় ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে। শেষ পর্যন্ত তাদের দুর্দশা দেখে ঈশ্বর সাড়া দেন।

একদিন রাজা কংস আদরের ছোট বোন দেবকী আর তাঁর স্বামী বসুদেবকে সঙ্গে নিয়ে রথে চেপে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ কংস আকাশ থেকে এক দৈববাণী শুনতে পান। সেই দৈববাণীতে কংস জানতে পারেন যে নিজের ছোট বোন দেবকীর গর্ভের অষ্টম সন্তানই হবে তাঁর মৃত্যুর কারণ। এমন প্রাণনাশের দৈববাণীতে কংস ভয় পেয়ে রুদ্ররূপ ধারণ করেন। তারপর বোন দেবকী আর বাসুদেবকে হত‍্যা করতে উদ্ধত হন।

একদিন রাজা কংস আদরের ছোট বোন দেবকী আর তাঁর স্বামী বসুদেবকে সঙ্গে নিয়ে রথে চেপে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ কংস আকাশ থেকে এক দৈববাণী শুনতে পান।

নিজেদের মৃত্যু নিশ্চিত জেনে বাসুদেব তখন রাজা কংসকে বলেন, ‘আপনার কারাগারে আমাদের আটকে রাখুন। আমাদের সন্তান হলে জন্মের পরপরই আপনি তাকে হত‍্যা করে নিজের প্রাণসংশয় কাটাবেন।’ ভগ্নিপতির এই প্রস্তাব কংসরাজের পছন্দ হওয়ায় তার পর থেকে তিনি দেবকী আর বাসুদেবের ছয়টি সন্তানকেই জন্মের পর হত‍্যা করেন। দাদা কংসের এমন নৃশংসতায় অতিষ্ঠ হয়ে দেবকী তাঁর সপ্তম সন্তানকে দৈবশক্তির দ্বারা রোহিনীর গর্ভে দান করলে বলরামের জন্ম হয়।

এর কিছুদিন পর এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে একটি ফুটফুটে শিশুর জন্ম দেন দেবকী। সেদিন রাতভর প্রবল বৃষ্টি, সঙ্গে ঝড়। এমন সময় আরেক দৈববাণী এল দেবকী ও বাসুদেবের কাছে। ‘এই সন্তানকে তোমরা বৃন্দাবনের নন্দালয়ে রেখে এসো ও নন্দরানী যশোদা যে কন‍্যাসন্তান প্রসব করেছেন, তাকে নিয়ে এসো।’ বাসুদেব আর কালবিলম্ব না করে সদ‍্যোজাত পুত্রসন্তানকে নিরাপদে গোকুলের দম্পতি নন্দ ও যশোদার কোলে পৌঁছে দিতে চললেন। দৈববলেই কারাগারের সব শিকল খুলে যায়। কারাগারের দরজায় কেউ প্রহরারত ছিল না।

বাসুদেব প্রবল ঝড়-জলের মধ‍্যে শিশুপুত্রকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। বাসুদেব করজোড়ে অশান্ত দুই কূল ছাপিয়ে যাওয়া যমুনার কাছে প্রার্থনা করলে যমুনা দুই ভাগে ভাগ হয়ে গিয়ে তাঁকে পথ করে দেয়। বিষ্ণু তখন সপ্তমুখী সাপের রূপ নিয়ে শিশু কৃষ্ণ ও বাসুদেবকে রক্ষা করেন। সমস্ত ঝড়ঝঞ্ঝা সামলে বাসুদেব শিশুকে সঙ্গে নিয়ে পৌঁছে যান নন্দালয়ে। সেখানে নিজের পুত্রসন্তানকে যশোদার বিছানায় শুইয়ে দিয়ে যশোদার সদ‍্যোজাত কন‍্যাকে চুপিসারে নিয়ে ফিরে আসেন কারাগারে।

ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষে যেহেতু বিষ্ণুর অবতার হিসেবে কৃষ্ণের জন্ম, তাই শৌর্য, বীর্য, তেজ, জ্ঞান, শ্রী ও বৈরাগ‍্য—এই ষড়্‌গুণের প্রতীক হিসেবে হিন্দুধর্মের মানুষ জন্মাষ্টমীতে কৃষ্ণের আরাধনা করে থাকে।

কংস এসবের কিছুই টের পাননি। দেবকীর কোলে কন‍্যাসন্তান দেখে ও তার কান্না শুনে কংস এসে আগের মতো শিশুটিকে আছাড় দিয়ে মারতে গেলে শিশুটি শূন‍্যে ভেসে হাসতে হাসতে কংসকে সতর্ক করে বলতে থাকে, ‘তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে।’ ওদিকে নন্দালয়ে তখন কৃষ্ণের জন্ম উপলক্ষে সবাই আনন্দ–উৎসবে মেতে উঠেছিল আর সেই আনন্দ–উৎসবের নামই জন্মাষ্টমী।

ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষে যেহেতু বিষ্ণুর অবতার হিসেবে কৃষ্ণের জন্ম, তাই শৌর্য, বীর্য, তেজ, জ্ঞান, শ্রী ও বৈরাগ‍্য—এই ষড়্‌গুণের প্রতীক হিসেবে হিন্দুধর্মের মানুষ জন্মাষ্টমীতে কৃষ্ণের আরাধনা করে থাকে। তারা মনে করে, এই দিনে ব্রত পালন করলে মনের মলিনতা দূর হয়, সৎগুণের বিকাশ হয় এবং মৃত্যুর পর আত্মা মুক্তি পায়।

সূত্র: প্রথম আলো

সর্বশেষ: